মাসে সোয়া লাখ টাকা বেশি নিয়েছেন মোহাম্মদী খানম

নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্যান্য ভাতাদিসহ সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন ৪ লাখ টাকা। এর বাইরে আর কোনো আর্থিক সুবিধার নেয়ার অনুমোদন নেই প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী হিসেবে মোহাম্মদী খানমের নিয়োগের অনুমোদন পত্রে। অথচ তিনি প্রতিমাসে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ নিয়েছেন ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিমাসে বেশি নিয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।  এই টাকা তিনি ২০১৪ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩ বছরে নিয়েছেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদী খানমকে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেয় ২০১৪ সালের মার্চে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে মোহাম্মদী খানমের বেতন-ভাতা নেয়ার এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেতন-ভাতা নেয়ার ক্ষেত্রে মোহাম্মদী খানম নিয়োগপত্রে দেয়া আইডিআরএ’র শর্ত মানেননি। শর্ত অমান্য করে অন্যান্য সুবিধার নামে বেশি টাকা নিয়েছেন। আবার মোট বেতন-ভাতার বিভিন্ন খাতে টাকার পরিমাণের পরিবর্তন করার বিধান না থাকলেও আইন লঙ্ঘন করে টাকার অংক বাড়িয়েছেন। 

মোহাম্মদী খানম অনুমোদিত খাতগুলোতে নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা নিয়েছেন। আইডিআরএ’র নির্দেশ অমান্য করে তিনি এ টাকা নিয়েছেন। অন্যদিকে অনুমোদন নেই এমন খাতেও অন্যান্য সুবিধার নামে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে,  ২০১৪ সালের নিয়োগপত্রের শর্ত ছিল মোহাম্মদী খানম অন্যান্য ভাতাদিসহ সর্বসাকুল্যে বেতন পাবেন ৪ লাখ টাকা।  বীমা আইন ২০১০ ও বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা প্রবিধানমালা-২০১২ এর বিধানাববলী পরিপালন করে দায়িত্ব পালন করবেন।  এই শর্ত অনুসারে মোহাম্মদী খানম ২০১৪ সালের মার্চ থেকে পরবর্তী ৩ বছর বেতন-ভাতা বাবদ মোট পান ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।  অথচ আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য অনুসারে তিনি বেতন নিয়েছেন ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৬ টাকা। বেতন বেশি নিয়েছেন ৪৫ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৬ টাকা। যা গড়ে প্রতিমাসে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮৫৫ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে কোম্পানিটি মূখ্য নির্বাহীর বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে ৪৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭০৫ টাকা। যা  প্রতিমাসে গড়ে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৮ টাকা। এই হিসেবে মোহাম্মদী খানমের ৯ মাস ২০ দিনে বেতন নিয়েছেন ৩৫ লাখ ১১ হাজার ৪৭৭ টাকা।

আবার ২০১৫ সালে কোম্পানিটি মূখ্য নির্বাহীর বেতন পরিশোধ করেছে ৬৪ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিমাসে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩  টাকা। ২০১৬ সালে মোট বেতন পরিশোধ করেছে ৭২ লাখ টাকা, যা গড়ে প্রতিমাসে ৬ লাখ টাকা।

২০১৭ সালে কোম্পানিটি বেতন পরিশোধ করেছে ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকা। যা গড়ে প্রতি মাসে ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭০৪ টাকা। অর্থাং মেয়াদ শেষের শেষ ২ মাস ১০ দিনে বেতন নিয়েছেন ১৮ লাখ ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা।

এই হিসেবে মোহাম্মদী খানম প্রথমবার নিয়োগে ৩ বছরে মোট বেতন নিয়েছেন নিয়েছেন ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৬ টাকা। এই টাকা তিনি নিয়েছেন চালকসহ গাড়ি, জ্বালানি, টেলিফোন বিল, মোবাইল বিল ছাড়াই।

অনুসন্ধানে দেখা যায, আইডিআরএ’র নিয়োগ অনুমোদনপত্রে দেয়া শর্ত অনুসারে অন্যান্য সুবধিাদিসহ মোট বেতন-ভাতা ৪ লাখ টাকার মধ্যে রয়েছে মূল বেতন (বেসিক সেলারি) ২ লাখ টাকা, বাড়ি ভাড়া বাবদ ৬০ হাজার টাকা, বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৩০ হাজার, বিনোদন বাবদ ৩০ হাজার টাকা, লীভ ফেয়ার বাবদ ৩০ হাজার টাকা, মেডিকেল বাবদ ৫০ হাজার টাকা। 

মূখ্য নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার -২০১২ এর ৮ এর উপবিধি ৪ এ বলা হয়েছে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ পরবর্তী সময়ে উপ বিধি (২) উল্লিখিত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাবলীর শর্তসমূহ পরিবর্তন করা যাবে না।

অর্থাৎ মোট বেতন-ভাতার খাতগুলোতে নির্ধারিত টাকার পরিমাণ নিয়োগকালিন সময়ে পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ বাড়ি ভাড়া খাতেই প্রতি বছর বেশি নিয়েছেন ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। যা বীমা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মোট বেতনের মধ্যে প্রতিমাসে বাড়িভাড়া বাবদ ছিল ৬০ হাজার টাকা। এই হিসেবে বছরে বাড়ি ভাড়া পাওয়ার কথা ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। অথচ ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে তিনি ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বছরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন ১০ লাখ ৮০ হাজার। অর্থাৎ এই দুই বছরের আইন লঙ্ঘন করে প্রতি বছর বাড়ি ভাড়া বাবদই বেশি নিয়েছেন ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

মোহাম্মদী খানম ২য় মেয়াদের নিয়োগের নিয়োগ পান ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। নিয়োগ চুক্তি অনুসারে  সর্বসাকুল্যে বেতন নির্ধারণ করেন ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই সাথে তিনি চুক্তিপত্রের শর্তানুসারে অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্য হবেন।  এছাড়াও পরবর্তী ২ বছরে তার বেসিক বেতন ৫ শতাংশ হারে বাড়বে।  এই হিসেবে ২০১৮ সালের মার্চ ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে বেতন-ভাতা হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।

হিসেব করে দেখা গেছে, ২য় বার নবায়ন নিয়োগের পর ২০১৭ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার সর্বসাকুল্যে মোট বেতন-ভাতা পাওনা হয় ১ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে টাকার এই অংক চুক্তিপত্র অনুসারে প্রাপ্য অন্যান্য সুবিধা বাদ দিয়ে।

২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদন আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে তিনি ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ নিয়েছেন ১ কোটি ৮৮ লাখ ৯ হাজার ২৭৫ টাকা।  এই টাকা থেকে নিয়োগপত্র অনুসারে তিনি বেতন নেন ১ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ অন্যান্য ‍সুবিধা বাবদ নেন ৬৬ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৫  টাকা।

উল্লেখ্য, এই হিসাব আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া ২০১৭ সালের এক বছরের হিসাব থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত প্রথম নিয়োগপত্রের শর্তানুসারে মাসিক সর্বসাকুল্যে নির্ধারিত বেতন ৪ লাখ টাকা ধরে বাদ দিয়ে হিসাব করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চুক্তিতে অন্যান্য সুবিধা দেয়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণ সংক্রান্ত প্রবিধানমালার নির্দেশ অম্যান্য করা হয়েছে।

আইনে বলা হয়েছে, অন্যান্য সুবিধাদি যেমন- গাড়ি, জ্বালানী, চালক ইউটিলিটি বিল. ছুটি, পরিবহন সহায়তা ইত্যাদির পরিমাণ বা সীমা নির্দিষ্ট থাকতে হবে এবং অন্যান্য সুবিধাসমূহ যতদূর সম্ভব, আর্থিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের চুক্তিতে অন্যান্য সুবিধা আর্থিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করা হয়নি। আবার অনেক খাতেই সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। ২০১৭ সালের নবায়ন চুক্তিতে অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে পূর্ণ সময় চালক ও জ্বালানিসহ গাড়ি প্রকৃত খরচ, কোম্পানির রুলস অনুসারে বোনাস, লীভ ফেয়ার মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ৫ লাখ ৫০ হাজার, বছরে পারফর্মেন্স বোনাস পাবেন বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে, মেডিকেল সুবিধা পাবেন বিজনেস ক্লাসের বিমান হোটেল ভাড়ার প্রকৃত ব্যয়, আবাসিক টেলিফোন ও মোবাইল বিল প্রকৃত ব্যয় অনুসারে, কোম্পানির নিয়ম অনুসারে বার্ষিক লীভ, চুক্তির মেয়াদে ৬ লাখ টাকার ফার্নিচার, গ্রুপ ও হেলথ ইন্স্যুরেন্স সুবিধা, কোম্পানির নিয়ম অনুসারে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচ্যুইটি সুবিধা ।

অথচ প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি, গ্রুপ ও হেলস ইন্স্যুরেন্স মোট বেতনের অন্তর্ভূক্ত থাকার কথা থাকলে মোহাম্মদী খানমের নিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিতে এ খাতগুলো মোট বেতনের অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই।

অন্যদিকে অন্যান্য সুবিধাদির মধ্যে, পূর্ণ সময়ের জন্য চালক ও জ্বালানিসহসহ গাড়ির প্রকৃত খরচ, বাসার টেলিফোন ও মোবাইলের ব্যয় নির্ধারণে  প্রকৃত খরচকে মানদণ্ড ধরে চুক্তি করা হয়েছে।  অথচ আইন অনুযায়ী এসব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ও সীমা নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানম কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।