বঞ্চিত বীমা কর্মকর্তারা, ১৫ বছরে বেতন বেড়েছে আড়াই হাজার টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: কুয়াকাটার ফাসিপাড়া গ্রামের জামাল উদ্দিন হৃদয়। মাধ্যমিক পাস করে ২০০৪ সালের ১৮ মে জীবিকার তাগিদে টি বয় হিসেবে চাকরি নেন ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৯৫০ টাকা। এরইমধ্যে কেটে গেছে সাড়ে ১৫ বছর। বিয়ে করেছেন। সংসারে তার এক মেয়ে ও এক ছেলে। আছেন মা-বাবাও। সময়ে সাথে তাল মিলিয়ে বড় হয়েছে পরিবার। বেড়েছে সংসারের খরচ, জীবন যাত্রার ব্যয়ভার। কিন্তু সে হারে বাড়েনি বেতন-ভাতা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে ৪ হাজার ৭২৯ টাকা মাসিক বেতন নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় জামাল উদ্দিন। হতাশার সাগরে হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। চাকরির বয়স ১০ বছর হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা স্থায়ীকরণের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় ১৬ বছর হলেও চাকরি স্থায়ীকরণের কোন খবর নেই।

এদিকে বয়স বেড়েই চলেছে। প্রতিযোগিতার এই সময়ে আয় বাড়াতে পেশা বদলের অবস্থাও তার নেই। দীর্ঘ দিনের কর্মস্থলের মায়াও তাকে পিছু টানে। তাই সুযোগ পেয়েও অন্য বীমা কোম্পানিতে যাননি জামাল উদ্দিন। আশায় আছেন চাকরি স্থায়ী হবে, বাড়বে বেতন। তারপরও সংসারের হাল টানতে হিমশিম খাওয়া জামাল উদ্দিনের হতাশা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। ফলে মনের ভেতরে বাড়ছে ক্ষোভ।

শুধু জামাল উদ্দিন নয়, এ অবস্থা ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। যাদের ওপর নির্ভর করেই মূলত সারাদেশে কোম্পানির জোনাল অফিস, সংগঠনিক অফিসসহ ব্লক অফিসগুলো টিকে আছে। বছরের পর বছর বঞ্চিত হওয়া এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্প্রতি ক্ষোভ এতটাই বেড়েছে তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন।

ন্যায্য পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে সারাদেশের বঞ্চিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঢাকায় জড়ো হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। ঢাকায় অবস্থান নিয়ে ন্যাশনাল লাইফের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নিজেদের দাবি তুলে ধরবেন। সেখানে ব্যর্থ হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) দারস্থ হবেন এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এ বিষয়ে জামাল উদ্দিন হৃদয় ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন বলা হয়েছিল- ১০ বছর পর চাকরি স্থায়ী করা হবে। আজ প্রায় ১৬ বছর যাচ্ছে। কিন্তু চাকরি স্থায়ী করা হয়নি। মানবেতর জীবন-যাপন করছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমরা বারবার বিষয়টি জানিয়েছি। তাতেও কাজ হচ্ছে না।

অসুস্থ মা-বাবা, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, সংসারের খরচ –এসব কিছুর চাপে দিশেহারা। খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। বাড়ির কাছে অফিস তাই কখনো ছাড়ার চিন্তা করিনি। ধৈর্য্য ধরে আছি যে, হয়তো চাকরিটা স্থায়ী হবে। বেতন-ভাতা বাড়বে। কিছুটা হলেও কষ্ট কমবে। কিন্তু আর কত দিন!

ন্যাশনাল লাইফের আরেক কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জের আনোয়ার হোসেন। সংসারের হাল ধরতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০১১ সালে জুনিয়র অফিস এসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। গাজীপুরে তার কর্মস্থল। তার বেতন-ভাতা ধরা হয় সর্বসাকুল্যে ৫ হাজার ৪৬০ টাকা। একই পদে প্রায় একই বেতন-ভাতা নিয়ে এরইমধ্যে কেটেছে ৮টি বছর। দীর্ঘ এই সময়ে তার কোন পদোন্নতি হয়নি। তবে এই সময়ে বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৩৮৯ টাকা।

আনোয়ার হোসেন ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, চাকরি স্থায়ীকরণ ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আশায় অনেক কষ্টে পড়ালেখা করেছি। দুই বছর হলো মাস্টার্স পাসের সনদ জমা দিয়েছি কোম্পানিতে। কিন্তু এখনো চাকরি স্থায়ী হচ্ছে না, আবার বেতন-ভাতাও বাড়ছে না। এতদিন পরে এসে কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

এদিকে মাস্টার্স পাস করার পর চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির আশায় বিয়ে করে বিপাকে পড়েছি। থাকার জন্য একটি ভাড়া বাসাও যোগার করতে পারছি না। অর্থের অভাবে বউকে রেখেছি শ্বশুর বাড়িতে। আর আমি থাকছি মেসে। ওদিকে বাড়িতে অসুস্থ মা আর ভাই-বোন তো আছেই।

আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ন্যাশনাল লাইফে প্রায় দেড় হাজার ক্যাজুয়াল স্টাফ আছেন। যাদের সবার অবস্থা প্রায় একই। এমন অনেকে আছেন যাদের চাকরির বয়স ১৫-২০ বছর, কিন্তু এখনো তাদের চাকরি স্থায়ী হয়নি। এমনকি বেতন-ভাতাও তেমন বাড়েনি। প্রায় সবাই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আমরা এই দূরাবস্থার অবসান চাই।

ভুক্তভোগী আরেক বীমা কর্মকর্তা চট্টগ্রামের ছিপাতলী গ্রামের নাসরিন আখতার রেখা। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০০৮ সালের মার্চে জুনিয়র অফিস এসিসট্যান্ট হিসেবে ন্যাশনাল লাইফে যোগদান করেন। বেতন-ভাতা ধরা হয় ৪ হাজার টাকা। প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি কোম্পানিটিতে কাজ করছেন। এই সময়ে তার বেতন বেড়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তবে পদের কোন উন্নতি হয়নি।

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের সনদ দিয়ে চাকরি নিলেও নাসরিন আখতার এখন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ২০১১ সালে ডিগ্রি এবং ২০১২ সালে মাস্টার্স পাস করেছেন। বীমা কোম্পানিতে চাকরির বাইরে তিনি সমাজের জন্যও কাজ করছেন। গত নির্বাচনে ৬ নং ছিপাতলী ইউনিয়নের মহিলা ওয়ার্ড মেম্বর পদে বিজয়ী হয়েছেন। ২ মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে তার স্বামী সংসার।

নাসরিন আখতার ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যোগ্যতা থাকার পরও আমরা নিম্ন বেতনের অস্থায়ী কর্মচারীই রয়ে গেলাম। কোম্পানিকে ভালোবেসে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছি, নিজেদের যোগ্যতাও বাড়িয়েছি। অথচ কোম্পানি আমাদের যোগ্যতা ও কাজের কোন মূল্যায়ন করছে না।

তিনি আরো বলেন, কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কেউ আমাদের নিয়ে ভাবে না। যে যার চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। সিনিয়ররা দিনের পর দিন আমাদের আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যখনই বোর্ড মিটিংয়ের সময় আসে তখন আমরা আশায় থাকি হয়তো এবারের মিটিংয়ে আমাদের কিছু একটা হবে!

এতো বছর ধরে যাদের পরিশ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকেই শোষণ করছে কোম্পানি। এ ধরণের আচরণ শোভনীয় নয়, এর পরিণাম ভালো হয় না। এবার আমরা কোম্পানির কাছে জোর দাবি জানাবো চাকরি স্থায়ী করার জন্য। যদি তাতেও কিছু না হয় তাহলে আমরা কঠোর পদক্ষেপের দিকে আগাবো, বলেন নাসরিন আখতার রেখা।

বেতন দিয়ে সংসার চালাতে না পেরে চাকরি-ই ছেড়ে দিয়েছেন ন্যাশনাল লাইফের অফিস সহকারী মশিউর রহমান। বিএ পাস করে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি কোম্পানিটিতে যোগ দেন। তখন তার বেতন ধরা হয় ৫ হাজার ৪শ’ টাকা। দীর্ঘ ৬ বছর চাকরি করে তার বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৪৪৯ টাকা।

মশিউর রহমানের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদি থানার তেতুলিয়া গ্রামে। স্ত্রী-পুত্র আর মা-বাবা নিয়ে তার সংসার। অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই চলছে তাদের জীবন-যাত্রা। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে অফিসের নিম্ন বেতন দিয়ে সংসার চলে না। তাই চলতি বছরের প্রথম দিকে চাকরি ছেড়ে দেন মশিউর রহমান।

তবে চাকরি ছাড়ার ৩ মাসের মধ্যে ন্যাশনাল লাইফ কর্তৃপক্ষ তাকে ডেকে আবারও চাকরিতে যোগদান করায়। তারা আশ্বাস দেন খুব শিগগিরই চাকরি স্থায়ীকরণ হবে, বাড়বে বেতন-ভাতাও। সেই আশ্বাসে আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু দিনের পর দিন গেলেও চাকরি আর স্থায়ী হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে গত আগস্টে আবারও চাকরি ছেড়ে দেন মশিউর রহমান।

মশিউর রহমান ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’ কে বলেন, ন্যাশনাল লাইফ কর্তৃপক্ষ কথা রাখেনি। যোগদানের কয়েক বছরের মধ্যেই চাকরি স্থায়ীকরণের কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো চাকরি না করায় তারা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। সবশেষ তারা টার্মিনেট করার ঘোষণা দিয়েছে। নূন্যতম মানবিকতা থাকলে তারা এ কাজ করতে পারত না।

বগুড়ার জেলার শেরপুরের শাহীন আলম ১৪ বছর ধরে চাকরি করছেন ন্যাশনাল লাইফে। তিনি ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে জানান, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০০৫ সালে রেকর্ড কিপার হিসেবে কোম্পানিটিতে যোগ দেন। সে সময় তার বেতন ধরা হয় ২ হাজার ৩৪০ টাকা। এই দেড় দশকে তার বেতন বেড়েছে ৩ হাজার টাকা।

কোম্পানির আচরণে ক্ষুব্ধ শাহীন আলম বলেন, চাকরি স্থায়ী করার কথা বললেই তারা বলে- এই বেতনে চাকরি করলে করেন না হয় চলে যান। অনেকেই এই বেতনে চাকরি করার জন্য অপেক্ষা আছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের আন্দোলনের কথা শুনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে হুমকি দিচ্ছেন যে, আমাদের চাকরি থাকবে না। কিন্তু আমরা এতে ভয় পাই না।

ন্যাশনাল লাইফের আরেক কর্মকর্তা লক্ষ্মীপুরের দেলোয়ার হোসেন। ডিগ্রি পাস করে ২০০৯ সালে তিনি জুনিয়র অফিস সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে তার কর্মস্থল। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে কোম্পানিতে চাকরি করছি কিন্তু এখন পর্যন্ত পদোন্নতি হয়নি। চাকরিও স্থায়ী করেনি।

ক্ষুব্ধ দেলোয়ার হোসেন বলেন, কোম্পানি আমাদের কথায় কর্ণপাত করে না। তাই এবার আমরা সবাই একজোট হয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও’কে স্মারকলিপি দেয়ার পরিকল্পনা করছি। এতে কাজ না হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আবেদন করব। প্রয়োজনে দাবি আদায়ের জন্য আমরা মানববন্ধনসহ আরো কঠোর পদক্ষেপ নেব।

কোম্পানিটির আরেক কর্মকর্তা আল আমিন। রেকর্ড কিপার পদে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চাকরি করছেন। এখনো তার চাকরি স্থায়ী হয়নি। এই দেড় দশেক তার মাসিক বেতন-ভাতা দাঁড়িয়েছে সর্বসাকুল্যে ৫ হাজার ৪শ’ টাকা। আল আমিন জানান, এ দিয়ে তার সংসার চলে না। কোম্পানির কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও কাজ হয়নি। তাই ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এবার তারা আন্দোলনের পথে হাঁটছেন।