চাকরি ছাড়তে হচ্ছে নন-লাইফের শত শত উন্নয়ন কর্মকর্তাকে

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ১ মার্চ থেকে চাকরি ছাড়তে হচ্ছে নন-লাইফ বীমা কোম্পানির শত শত উন্নয়ন কর্মকর্তাকে। দীর্ঘদিন থেকে পেয়ে আসা বাড়ি, গাড়ি ও মোটা অংকের বেতন সবই ছাড়তে হবে এসব উন্নয়ন কর্মকর্তাদের। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের গত মঙ্গলবারের সার্কুলার অনুসারে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, সকল উন্নয়ন কর্মকর্তাকে কমিশনের ভিত্তিতে বীমা এজেন্ট হিসেবে পদায়ন করতে হবে।

সূত্র মতে, দেশে ৪৯টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির ১ হাজার ৩৭০টি শাখা অফিস রয়েছে। এসব শাখা অফিসের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেডিডেন্ট পদবির কর্মকর্তারা উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এসব কর্মকর্তারাই মূলত ব্যবসা করে থাকেন। উন্নয়ন বিভাগের এ কর্মকর্তাদের প্রিমিয়াম আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর তারা উচ্চ বেতন, দামি গাড়ি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান। প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় করে কোম্পানিগুলো।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর সাথে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোতে নামে মাত্র এজেন্ট থাকলেও প্রকৃত অর্থে কোনো এজেন্ট নেই।  কোম্পানির ব্যবসা করে থাকে উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তারাই। এসব কর্মকর্তারাই বছরের পর বছর ধরে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় করছে। তারা উচ্চ বেতনসহ গাড়ি বাড়ির সুবিধা পাচ্ছেন। উচ্চ পদের এসব কর্মকর্তার কোনোভাবেই এজেন্ট পদে পদায়ন হতে রাজি হবেন না। অন্যদিকে এজেন্টরা তাদের স্থান উচ্চ পদস্থদের ছেড়ে দিবেন না। তাদের মতে, এজন্টরা ১৫ শতাংশ কমিশন পেয়ে থাকেন। তাদের বেতন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

উন্নয়ন কর্মকর্তাদের এজেন্টে পদায়ন করা নিয়ে ইতোমধ্যেই নন-লাইফ বীমাখাতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল থেকেই অনেক কর্মকর্তা সোস্যাল মিডিয়ায় সার্কুলারটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। বেশ কিছু কোম্পানির উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তারা সার্কুলার বাতিলের করণীয় বিষয়ে বৈঠক করেছে বলেও জানা গেছে।

এ বিষয়ে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা তালুকদার মো. জাকারিয়া হোসেন বলেন, বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। আমরা চাই কমিশন সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়। এই মার্কেট ও শিল্প যেন সঠিক সরল পথে চলে, একটা আস্থার পথে চলে। কমিশন বাস্তবায়ন করতে গেলে এটা আমাদের মানতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমার মনে হয় আইডিআরএ’র এই সার্কুলারের ব্যত্যয় ঘটবে না। এই সার্কুলার মানতে গেলে সবাইকে ছাড় দিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প কিছু নাই। এখন উন্নয়ন কর্মকর্তাদের কেউ যদি এটা মানতে না চায়, সে চাকরি করবে না- এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মার্কেট ঠিক রাখতে এর বিকল্প নেই।

তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশ দিয়েছে সেটা আমাদের মানতে হবে। এর বিরুদ্ধে যদি কারো মতামত থাকেও এটা করার সুযোগ নেই। বীমা আইনের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করা কোন কোম্পানির কোন সিইও’র পক্ষে সম্ভব না, করা উচিত নয় এবং বেআইনি।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সেক্রেটারি জেনারেল ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন বলেন, বীমাখাতের সার্বিক মঙ্গল ও শৃঙ্খলার জন্যই সার্কুলারটি জারি করেছে আইডিআরএ। সম্মিলিতভাবে এটা বাস্তবায়নের জন্য আইডিআরএ’র সঙ্গে আমাদের এসোসিয়েশন ও ফোরামের বসতে হবে। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। এটাতে যদি আমরা কঠোর থাকতে পারি তাহলে শৃঙ্খলাটা আরো শক্ত হবে।

তবে দীর্ঘদিন যাবৎ যারা ডিএমডি, এডিশনাল এমডি হিসেবে মার্কেটিংয়ে আছেন তাদের সামাজিক, পারিবারিক একটা মর্যাদার বিষয় আছে। এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের কাছে প্রশ্ন আসছে, হাতাশা কাজ করছে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের মাঝে- এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত। আমাদের দেশেতো উন্নত দেশের মতো এজেন্ট সিস্টেমটা গড়ে ওঠেনি, সেটা হলে কোন সমস্যা ছিল না। তবে আমাদেরকেও একসময় এই জায়গায় যেতে হবে।

বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে বসবো। তবে এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের সেই সময় এখনো হয়নি। এটার জন্য আরো সময় দিয়ে, সবাইকে জানিয়ে, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এটা করা প্রয়োজন।

শেখ কবির হোসেন বলেন, এজেন্ট হওয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা এবং বর্তমানে যারা কর্মকর্তা আছেন তাদের বুঝিয়ে সেদিকে নেয়া অথবা তাদেরকে বাদ দিয়ে সবকিছুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই এটা করতে হবে। এটাই হওয়া উচিত ছিল। হয়তো তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এই নির্দেশ দিয়েছে, আমরা এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলবো। তবে এটা বাস্তবায়ন হওয়াটা ভালো। এজেন্টের মাধ্যমেই সবকিছু হওয়া ভালো, এটাই আমরা মনে করি। তবে সময়ের প্রয়োজন।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র দু’জন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের কোন বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

হতাশায় উন্নয়ন কর্মকর্তারা:

প্রভাতি ইন্স্যুরেন্সের হেড অফিস বুথের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোখলেছুর রহমান খান বলেন, আমরা ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেছি। আজকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যায়ে এসেছি। দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছি। আমাদের বিভিন্ন ফান্ডও রয়েছে কোম্পানিতে। আর ওনারা (আইডিআরএ) একটা সার্কুলার দিয়ে আমাদেরকে এজেন্ট বানিয় দিবে এটা তো হতে পারে না। এটা বেআইনি এবং অবাস্তব।

মোখলেছুর রহমান খান আরো বলেন, আজকে আমাদের পরিবার পরিজন আছে, আত্মীয় স্বজন সবাই জানে আমরা কোম্পানিতে ভালো পর্যায়ে আছি। গাড়ি বাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। এখন যদি এজেন্ট হতে হয় তাহলে কী একটা অবস্থা হবে আমাদের। আমাদের অফিসে ৩৩ জন উন্নয়ন কর্মকর্তা আছে। আপনারা ভাবেন একবার এদের অবস্থাটা কী হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এরা।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের দিলকুশা শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলেন, আমি নিজেই উন্নয়ন কর্মকর্তা। আমরা আইডিআরএ’র এই বিষয়টি নিয়ে এখন একটা বোর্ড মিটিংয়ে আছি। উন্নয়ন কর্মকর্তাদের এজেন্টে পদায়নের বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি আমরা। কোম্পানির গাড়িসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আমরা ভোগ করছি। এখন আমাদের কেমন পরিস্থিতি হবে একবার চিন্তা করেন।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্স’র গুলশান শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলেন, আইডিআরএ’র এই সিদ্ধান্তে আমরা খুব উদ্বিগ্ন। আমি নিজেও উন্নয়ন কর্মকর্তা। বিষয়টির সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কোম্পানি থেকে একটা মিটিংয়ের আহবান করেছি।

প্রভাতি ইন্স্যুরেন্সের মতিঝিল শাখার কর্মকর্তা বলেন, আমরা আইডিআরএ’র এই বিষয়টি শুনেছি। আমরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। আমাদের অফিসে বেশ কয়েকজন উন্নয়ন কর্মকর্তা আছেন। এটা নিয়ে একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্স’র বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলেন, আমাদের অফিসে ৫ জন উন্নয়ন কর্মকর্তা আছেন। এদের এজেন্টে পরিণত করলে অবস্থাটা কেমন হবে! আইডিআরএ’র এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মতো না। সমস্যাটা নিয়েই আমরা কোম্পানিতে আলাপ-আলোচনা করছি। দীর্ঘদিন থেকে আমরা কোম্পানিতে কাজ করি এখন হঠাৎ করে এজেন্টে পদায়ন তা কেমনে সম্ভব!

ডিউক হুদা নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডিতে ৭৫ নং সার্কুলার বাতিল ও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের চাকরি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।