৩০ কোটি টাকা পুঁজি খেয়ে ৫৩ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত- কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বছরের পর বছর ধরে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে যাচ্ছে বেসরকারি এ লাইফ বীমা কোম্পানি।

শেষ দু’বছরের নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ এবং তা থেকে পরের বছরের নবায়ন খাতে ৫৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৬১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এ ব্যয়ে নতুন গ্রাহকের জমা করা পুরো টাকাই শুধু নয়, পুরনো গ্রাহকের তহবিল থেকেও ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে নতুন গ্রাহকের এই দায় পরিশোধেও কোম্পানিটিকে ব্যয় করতে হবে আরো ২১ কোটি ৫০ টাকা।

আইন অনুসারে এ ব্যয় অবৈধ। এ ধরনের অবৈধ ব্যয়ের ফলে কোম্পানির আর্থিক ভিত মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ফলে মেয়াদ শেষে গ্রাহকের ন্যায্য পাওনা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই গ্রাহকদের ন্যায্য পাওনা সময় মতো পরিশোধ করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিলকৃত ব্যবসার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সানফ্লাওয়ার লাইফের ২০১৮ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোন টাকাই কোম্পানির তহবিলে জমা হয়নি। উল্টো এ টাকা সংগ্রহ করতে কোম্পানিটি তহবিল থেকে ব্যয় করেছে ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। আবার প্রথম বছরের ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বছরের নবায়ন এসেছে ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা।

পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানিটি ২০১৮ সালের নতুন প্রিমিয়াম ও ২০১৯ সালের দ্বিতীয় বর্ষের নবায়ন প্রিমিয়ামসহ ৫৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করলেও তার কোন টাকাই কোম্পানিতে জমা হয়নি। উল্টো কোম্পানির তহবিল, যা পুরনো গ্রাহকদের টাকা, তা থেকে ৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। অবৈধ এ ব্যয়ে লাভবান হচ্ছে কোম্পানি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ব্যয় করা হয়েছে এজেন্টদের কমিশন, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া ও কোম্পানি পরিচালনার অন্যান্য খাতে।

পর্যালোচনায় আরো উঠে এসেছে, ২০১৮ সালে সানফ্লাওয়ার লাইফ নতুন ব্যবসা করেছে ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এ টাকা সংগ্রহে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অথচ আইন অনুসারে ব্যয় করতে পারে ৩৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যা নতুন প্রিমিয়ামের ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বেশি ব্যয় করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ। আইন অনুসারে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ব্যয় অবৈধ।

আবার ২০১৮ সালে সানফ্লাওয়ার লাইফের নতুন গ্রাহকদের দেয়া ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম থেকে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম (নতুন গ্রাহকদের দ্বিতীয় বছরের বীমার প্রিমিয়ামের কিস্তি) এসেছে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩১ কোটি ৯৯ টাকা প্রিমিয়াম ল্যাপস হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা নবায়ন সংগ্রহে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা।

পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহে আইন অনুসারে ৯০ শতাংশ ব্যয় করলে কোম্পানির তহবিলে জমা হতো ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অথচ ৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয় করায় কোম্পানির তহবিলে প্রিমিয়াম কোন টাকা জমা তো হয়ইনি উল্টো কোম্পানির তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। আইন অনুসারে ব্যয়ের হিসাব ধরলে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

আবার ২০১৮ সালের নতুন গ্রাহকরা ওই বছর প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম দিয়েছে ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বছরের প্রিমিয়াম দিয়েছে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এই হিসাবে ২০১৮ সালের নতুন গ্রাহকরা ২ বছরে প্রিমিয়াম দিয়েছে ৫৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আর এ প্রিমিয়াম সংগ্রহে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ৬১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির তহবিল ভেঙ্গে ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৬৭ টাকা। অথবা এ টাকা ব্যয় করা হয়েছে পুরনো গ্রাহকের কোম্পানিতে জমা দেয়া বীমার কিস্তির টাকা থেকে, যা বেআইনি ।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের নতুন গ্রাহকদের মধ্যে যারা দ্বিতীয় বছরে বীমার দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা প্রিমিয়াম জমা দিয়েছে তাদের ২ বছরে মোট প্রিমিয়াম জমা হয়েছে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এসব গ্রাহক যদি পরবর্তী বছরগুলোতে আর কোনো প্রিমিয়াম জমা না করে তাহলেও গ্রাহকের দায় দাঁড়াবে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর যদি তৃতীয় বছরের বীমার কিস্তি জমার আগেই কোন গ্রাহক মারা যায় তাহলে বীমা অংকের পুরো টাকাই কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হবে। আবার এসব গ্রাহক পরবর্তী বছরগুলোতে নিয়মিত কিস্তি দিলেও দায় বাড়বে।

এই হিসাবে দেখা যায়, প্রথম বর্ষে ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ ও দ্বিতীয় বছরে ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে কোম্পানির তহবিল থেকে ব্যয় ৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর সাথে গ্রাহকের ন্যুনতম দায় ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যবসা সংগ্রহে অবৈধভাবে ব্যয় করার কারণে কোম্পানিকে লোকসান গুণতে হচ্ছে ৩০ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

বীমা বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যয় অবৈধ। অস্বভাবিকভাবে অতিরিক্ত ব্যয় হলে সেখানে নানা খাতে ব্যয়ের নামে টাকা আত্মসাতের সুযোগ থাকে। অন্যদিকে তহবিল ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ থেকে আয় কমে যায়। ফলে কোম্পানির বর্তমান ও ভবিষ্যত আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।

তাদের মতে, লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রিমিয়ামের টাকা গ্রাহকের আমানত। নির্ধারিত সময় পরে এ টাকা ফেরত দিতে হবে। তাই যা ইচ্ছে তাই খরচ করার কোনো সুযোগ নেই। মেয়াদ শেষে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।

তাদের মতে, কোন কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যয় ও প্রিমিয়াম ল্যাপসের পরিমাণ বেশি হলে গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা বিনিয়োগ করেও লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সানফ্লাওয়ার লাইফ সর্বমোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১০৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ১০৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে নতুন প্রিমিয়াম এসেছে ৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৯ সালে এসে কোম্পানিটির নতুন ব্যবসা কমেছে ১৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল আলমের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত প্রশ্ন চান। পরবর্তীতে বীমা কোম্পানিটির অফিসে গিয়ে প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে তার কাছে উপস্থাপন করে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। কিন্তু লিখিত প্রশ্নেরও কোন জবাব দেয়নি সানফ্লাওয়ার লাইফ। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে আবারো যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।