করোনা মহামারীতে ঘরে বসেই বীমা পলিসি ক্রয় ও সেবা গ্রহণের সুযোগ

আবদুর রহমান আবির: বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা ভাইরাসের মহামারী। সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রেক্ষিতে কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও লকডাউন হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌলিক ব্যবস্থা।

এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান সাধারণ ছুটি বর্ধিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে বন্ধ থাকবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়ে সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দেশের এই পরিস্থিতে বন্ধ রয়েছে বীমা কোম্পানিগুলোর অফিস। এজেন্টের মাধ্যমে বীমা পলিসি বিক্রি এবং সরাসরি গ্রাহক সেবা প্রদানের সুযোগ নেই। তাই ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স সেবা জোরদার করেছে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। ফলে ঘরে বসেই বীমা পলিসি ক্রয় ও বীমা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ।

গার্ডিয়ান লাইফের- ইজিলাইফ:

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স চ্যানেলের যাত্রা শুরু করে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। ইজিলাইফ নামের এই অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে টার্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনতে পারছেন গ্রাহকরা। মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে গিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটে কোন রকম মেডিকেল টেস্ট ছাড়াই একজন গ্রাহক হতে পারেন ইজিলাইফ পলিসিহোল্ডার। এর মাধ্যমে বার্ষিক সর্বনিম্ন এক হাজার ৮৩৪ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার কাভারেজ পাওয়া যাবে।

এই অনলাইন টার্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স মৃত্যু অথবা পূর্ণাঙ্গ অক্ষমতায় সম্পূর্ণ কাভারেজ প্রদান করে। তাছাড়া ইজিলাইফের প্রিমিয়াম রিফান্ড অপশনও আছে যা মেয়াদপূর্তিতে প্রদানকৃত সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম ফেরত প্রদান করে। তবে কোন লাভ বা বোনাস দেয় না। টিআইএন নম্বর আছে এমন ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের যেকোন সুস্থ্য ব্যক্তি ইজিলাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিটি কিনতে পারেন। ইজিলাইফ ব্যবহার করে পলিসি সম্পর্কিত যেকোন তথ্য জানা ও সেবা গ্রহণ করা যায়।

এ ছাড়াও মাইগার্ডিয়ান নামে একটি মোবাইল অ্যাপস রয়েছে বীমা কোম্পানিটির। এটি একটি সেলফ কেয়ার অ্যাপ। এর মাধ্যমে সব পলিসিহোল্ডার গার্ডিয়ান লাইফের সকল বীমা সম্পর্কিত তথ্য জানা এবং পলিসি সার্ভিস অত্যন্ত সহজ ভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। তবে এই মাধ্যম ব্যবহার করে বীমা পলিসি কেনার সুযোগ রাখা হয়নি।

গ্রীন ডেল্টার- ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স:

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স’ সেবার উদ্বোধন করে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স। প্রথম দফায় মোটর ইন্স্যুরেন্স, হেলথ ইন্স্যুরেন্স এবং ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে এ সেবা চালু করা হয়। ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স চালু হওয়ায় গ্রাহকদের কোম্পানির অফিসে গিয়ে পলিসি করতে হয় না। এমনকি বীমা কোম্পানির এজেন্ট কিংবা কর্মকর্তাদেরও গ্রাহকের বাসায় যেতে হয় না।

এজন্য গ্রাহককে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে কোম্পানিটির ওয়েসবাইটে গিয়ে ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স নামের অংশে ক্লিক করতে হয়। সেখানে ৩টি অপশন থেকে গ্রাহকের পছন্দমতো আবেদন ফরমটি পূর্ণ করে নির্দিষ্ট পলিসি গ্রহণ করতে পারেন। যেকোনো ব্যাংকের ভিসা, ক্রেডিট ও মাস্টার কার্ড, বিকাশ, আইপেসহ যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ পলিসির প্রিমিয়াম জমা দেয়া যায়।

ফরম পূরণের পর পলিসির টাকা পরিশোধ করলে অনলাইনে নিশ্চয়তার কাগজপত্র পাঠানো হয় গ্রাহকের কাছে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোম্পানির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে গ্রাহকের কাছে বীমা দলিল পৌঁছে দেয়া হয়। তবে আইপে’র মাধ্যমে পলিসির টাকা জমা দিলে আইপে ব্যবহারকারী গ্রাহকদের ১৫ শতাংশ ক্যাশ ব্যাক সুবিধা প্রদান করে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।

নিটল ইন্স্যুরেন্সের- ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স:

বীমা সেবাকে আধুনিক ও সহজলভ্য করতে অনলাইন বীমা সেবা চালু করে নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। প্রাথমিক অবস্থায় মটর বীমা দিয়ে তারা এই ডিজিটাল বীমা সেবা শুরু করে। নিটল ইন্স্যুরেন্সের এই অনলাইন বীমাকরণ পদ্ধতিতে এখন ঘরে বসেই অনায়াসেই গ্রাহক করে নিতে পারেন তার গাড়ীর কিংবা মটরসাইকেলের বীমা।

সেবাটি পেতে নিটল ইন্স্যুরেন্স এর ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইন মটর ইন্স্যুরেন্স এ ক্লিক করে, গাড়ির প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়েই গ্রাহক তার গাড়ি বা মটরসাইকেলের বীমা করতে পারেন। আর বীমার প্রিমিয়ামের টাকা সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে তথা বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, ইউপে, আইপে, সিটি-টাচসহ যেকোন ব্যাংকের ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রদান করা যায়।

অনলাইনে পেমেন্ট সম্পন্ন করার সাথে সাথে গ্রাহকের ই-মেইলে পৌঁছে যায় একটি ই-ইন্স্যুরেন্স কপি ও অনলাইনে টাকা জমা দেয়ার মানি রিসিটের ই-কপি। পরবর্তীতে গ্রাহকের কাছে বীমার মূল কপি কুরিয়ার এর মাধ্যমে পৌঁছে দেয় নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।

মেটলাইফের- প্রজাপতি:

২০১৭ সালের এপ্রিলে বীমা আবেদন করার ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (মেটলাইফ) । ‘প্রজাপতি’ নামের এই ট্যাবলেট অ্যাপ সহজেই ব্যবহার উপযোগী। এর মাধ্যমে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসোসিয়েট (এফএ) এবং গ্রাহক সম্মিলিতভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বীমা আবেদন জমা দিতে পারেন।

অ্যাপটির সহজবোধ্য স্ক্রিন ডিজাইন নির্দেশনা পড়তে, প্রিমিয়াম হিসাব করতে এবং গ্রাহকের আর্থিক ও ব্যক্তিগত চাহিদা যাচাই করে তার জন্য সঠিক পলিসি বেছে নিতে সাহায্য করে। এরপর বীমা গ্রাহকের পছন্দ করা ওই পলিসি ‘প্রজাপতি’র মাধ্যমে আন্ডাররাইটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। প্রিমিয়াম পরিশোধের ক্ষেত্রেও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারের সুবিধা রেখেছে কোম্পানিটি।

প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের- ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স:

‘ই-বীমা’ নামে মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স (থার্ড পার্টি) এবং ‘নিরাপদ’ নামে কম্প্রিহেনসিভ প্রাইভেট কার ইন্স্যুরেন্স (ফার্স্ট পার্টি) পলিসি চালু করেছে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। যেকেউ কোম্পানিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে অনলাইনে পলিসি দু’টি কিনতে পারবেন।

‘ই-বীমা’ এবং ‘নিরাপদ’ পলিসির জন্য দু’টি আলাদা উইন্ডো রয়েছে কোম্পানির ওয়েবসাইটে। পৃথক দু’টি পলিসি ফর্মে নির্ধারিত সব তথ্য সরবরাহের পর অনলাইনের নির্দেশনা অনুসারে প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়। প্রয়োজনে কোম্পানিটির হটলাইন সেবা গ্রহণ করতে পারেন বীমা গ্রাহকরা।

জেনিথ ইসলামী লাইফের অনলাইন সেবা:

গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে অনলাইনে বীমা সেবা চালু করেছে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। প্রিমিয়াম ক্যালকুলেটর, বীমা পরিকল্প, ব্যবসার তথ্য এবং পলিসি তথ্যের সুবিধা নিয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এ মোবাইল অ্যাপ চালু করে। প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে যেকোন বীমা গ্রাহক এবং বীমা কর্মী এ অনলাইন বীমা সেবা গ্রহণ করতে পারেন।

একইসঙ্গে একজন গ্রাহক জেনিথ ইসলামী লাইফের ওয়েবসাইটে ঢুকে সহজেই তার বীমা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রিমিয়াম ক্যালকুলেটর, বীমা পরিকল্প এবং বিভিন্ন পলিসি তথ্য সংযোজন করা হয়েছে কোম্পানির ওয়েবসাইটে। এ ছাড়াও যেকোন ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড এবং বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে বীমার প্রিমিয়াম জমা দিতে পারবেন গ্রাহক।

জেনিথ ইসলামী লাইফ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের জরুরি বীমা সেবা প্রদানের জন্য নতুন করে ই-মেইল এবং মোবাইল সেবা যুক্ত করা হয়েছে। যেকোন বীমা গ্রাহক কোম্পানির নির্ধারিত ই-মেইল ও মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে বীমা সুবিধা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন।

সোনালী লাইফের- অ্যাপ্লাই অনলাইন:

২০১৬ সালের শেষের দিকে অনলাইন বীমা সেবা চালু করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। মাইক্রোসফট কোম্পানি এই অনলাইন বীমা সেবায় কো-পার্টনার। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাপ্লাই অনলাইনে ক্লিক করে বীমা আবেদন করতে পারেন যেকোন ব্যক্তি। তথ্য প্রদানের পর পলিসিটি আন্ডাররাইটিংয়ে চলে যায়। প্রিমিয়াম পরিশোধের পর গ্রাহকের কাছে বীমা দালিল পৌঁছে দেয়া হয়।

ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্সের- ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স:

ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স সেবা চালু করেছে ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স, মটর ইন্স্যুরেন্স এবং পার্সোনাল এক্সিডেন্ট ইন্স্যুরেন্স এই তিনটি পলিসি সরাসরি অনলাইন মাধ্যমে কিনতে পারবেন গ্রাহকরা। ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স সেবার কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। তবে খুব শিগগিরই এর কার্যক্রম শেষ হবে বলেও জানিয়েছে বীমা প্রতিষ্ঠানটি।

প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অনলাইন সেবা:

অনলাইন মাধ্যমে প্রিমিয়াম প্রদান, পলিসি স্টেটমেন্ট, প্রিমিয়াম ক্যালকুলেট, মোবাইল ব্যাংকিংসহ বেশ কিছু ডিজিটাল সার্ভিস চালু করেছে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে পে প্রিমিয়াম অনলাইনসহ অন্যন্য অপশন ব্যবহার করা যায়। যেকোন প্রয়োজনে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হেলপলাইনে যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফের- ডিজিটাল সার্ভিস:

ডিজিটাল সার্ভিস নামে অনলাইন সেবা চালু করেছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটের ডিজিটাল সার্ভিস থেকে অনলাইন স্টেটমেন্ট, অনলাইন পেমেন্ট, প্রিমিয়াম ক্যালকুলেটর, মোবাইল এসএমএস, ডিজিটাল এক্টিভিটিস ইত্যাদি সেবা নিতে পারবেন বীমা গ্রাহকরা।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের- অনলাইন ইন্স্যুরেন্স:

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি চালু করেছে অনলাইন ইন্স্যুরেন্স সেবা। মটর ইন্স্যুরেন্স, ওভারসিজ মেডিক্লেইম ইন্স্যুরেন্স (হেলথ), ফায়ার ইন্স্যুরেন্স এবং মেরিন ইন্স্যুরেন্স পলিসি কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঘরে বসেই কেনার সুযোগ রয়েছে। পৃথকভাবে নির্ধারিত প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে যেকেউ কিনতে পারবেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এসব বীমা পলিসি।

এ ছাড়াও দেশের অন্যান্য লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি করোনা মহামারীর এই সময়ে বিভিন্নভাবে গ্রাহক সেবা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ই-মেইল ও মোবাইল সেবা চালু করেছে বিভিন্ন বীমা কোম্পানি। ওয়েবসাইগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে হেলপলাইন বা হটলাইন। এসব মাধ্যমে বীমা গ্রাহকরা জরুরি সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। নতুন বীমা পলিসিও কিনতে পারবেন যেকেউ।