ডেল্টা লাইফে প্রশাসক নিয়োগের দাবি শেয়ারহোল্ডারদের

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিভিন্ন ধরণের আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি ও কোম্পানিতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের অভিযোগে ডেল্টা লাইফের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু শেয়ারহোল্ডার। গত ৫ নভেম্বর নিয়ন্ত্রক সংস্থায় এ সংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়েছে। কোম্পানিটির ১৮জন শেয়ারহোল্ডার ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। এ ছাড়াও কোম্পানির একজন পলিসি হোল্ডারও একই ধরণের অভিযোগ করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থায়।

শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, পরিশোধিত মূলধনের ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে স্ত্রী, তিন কন্যা ও পুত্রের নামে রেখে কোম্পানিতে নিজের শক্তি অর্জন করেন ডেল্টা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান। আর বড় মেয়ে আদিবা রহমানকে উচু পদে দায়িত্ব প্রদান এবং পরিচালনা পর্ষদের নিজেদের লোকজন নিয়োগ দিয়ে কোম্পানিকে পরিণত করেছেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।

কোম্পানির ৩৬ পরিচালকের মধ্যে ২৪ জন পরিচালক যখন মঞ্জুরুর রহমানের একক কর্তৃত্বে চলে আসে তখন বাবা-মেয়ে মিলে শুরু করেন লুটপাট। ভবন নির্মাণ, গাড়ি ক্রয়সহ অন্যান্য ক্রয়-বিক্রয় এমনকি লাইফ পলিসি থেকে কমিশন আত্মসাতসহ বিভিন্ন প্রকার আর্থিক দুর্নীতি করে কোম্পানিকে একটি হরিলুটের কারখানা বানিয়েছেন ডেল্টা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান।

অভিযোগ করা হয়েছে, মঞ্জুরুর রহমান ৩শ’ পলিসি হোল্ডারের স্বাক্ষর নকল করে নিজস্ব ১২ জন পলিসি হোল্ডারকে কোম্পানির পরিচালক নির্বাচন করেন। আর এই অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেন তার মেয়ে আদিবা রহমান, সে সময় তিনি কোম্পানিটির সার্ভিসিং বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। এর মাধ্যমে কোম্পানির ৩৬ জন পরিচালকের ২৪ জনই তিনি নিয়ন্ত্রণে নেন।

এ ঘটনায় ২০০৪ সালে আবদুল হক নামে কোম্পানিটির একজন পলিসি হোল্ডার এবং পলিসি হোল্ডার পরিচালক পদে নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী অ্যাডভোকে সিদ্দিকি পিতা ও কন্যা যথাক্রমে মঞ্জুরুর রহমান ও আদিবা রহমানকে আসামি করে মতিঝিল থানায় ফৌজদারি মামলা করেন। মামলা নম্বর যথাক্রমে ২০০৪/৬০ এবং ২০০৪/৬১। মামলাগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

শেয়ারহোল্ডারদের দাবি, মঞ্জুরুর রহমানের লুটপাট যখন চরমে পৌঁছায় তখন কোম্পানির প্রাথমিক উদ্যোক্তারা অনেক ক্ষিপ্ত হন এবং এক পর্যায়ে ডেল্টা লাইফের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারিত হন মঞ্জুরুর রহমান এবং চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আদিবা রহমান।

তবে পরবর্তীতে বিএসইসি’র নতুন বিধান অনুসারে উদ্যোক্তা পরিচালকরা ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক না হওয়ায় তারা পরিচালক পদ হারান এবং প্রায় সাত বছর পর পুনরায় কোম্পানির চেয়ারম্যান হন মঞ্জুরুর রহমান। অন্যদিকে কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান আদিবা রহমান।    

শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, পিতা চেয়ারম্যান ও মেয়ে মূখ্য নির্বাহী এবং পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের সদস্য হওয়ায় তারা কোম্পানিতে দুর্নীতি শুরু করেন। মঞ্জুরুর রহমানের ছেলে ও আদিবা রহমানের ভাই হওয়ায় কোম্পানিটির পরিচালক যিয়াদ রহমান লাইফ ফান্ডের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা একক হাতে বিনিয়োগ করেন এবং শেয়ারবাজারে খাটিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন।

এ ছাড়াও ডেল্টা লাইফে আর্থিক দুর্নীতির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিতে প্রচলিত ব্যাংক সুদহারের চেয়ে কম সুদে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকে এফডিআর করা। জেড ক্যাটেগরিসহ বিভিন্ন দুর্বল প্রতিষ্ঠানের কম মূল্যের শেয়ার অধিক মূল্যে ক্রয় করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ। দরপত্র আহবান না করে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনগুণ বেশি দামে সফটওয়্যার কিনে বাড়তি অর্থ আত্মসাৎ।

গাড়িসহ প্রতিটি দ্রব্যম্যূ প্রকৃত ক্রয়মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে বাড়তি অর্থ আত্মসাৎ। আসবাবপত্রসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র টেন্ডার ছাড়াই ভুয়া বিল বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ। কোম্পানির বিল্ডিং মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভূয়া বিল বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ। কোম্পানির টাকায় পরিবারের সকলের বাসা সুসজ্জিত করণ। কোম্পানির সকল জিপ গাড়ি পরিবারের সদস্য কর্তৃক এবং তাদের চা বাগানে ব্যবহার করা।

বীমা গ্রাহকের মেয়াদপূর্তির টাকা প্রদানের বিলম্ব এবং গড়িমসি করা। বিনা প্রয়োজনে কোম্পানির টাকায় বারবার বিদেশ ভ্রমন। মতের অমিল হলে অনেক ভালো কর্মকর্তাকে চাকরি ছাড়াতে বাধ্যকরা ও তাদের পাওনা পরিশোধ না করা। বিদেশি ব্যক্তি আগারওয়ালকে কোম্পানির অতি উচ্চ বেতনের নিয়োগ  দিয়ে তার অংশ যিয়াদ রহমান ভাগ করে নেয়ার কথিত অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে ওই আবেদনে। 

অন্যদিকে হাসিনা আক্তার নামে ডেল্টা লাইফের একজন বীমা গ্রাহকও (পলিসি নং ১০০০০০০৩৫৩১৯) গত ৭ নভেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে কোম্পানিটির উল্লেখিত অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের স্বার্থে প্রশাসক নিয়োগের আবেদন জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, ডেল্টা লাইফ অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

হাসিনা আক্তার আরো অভিযোগ করেছেন, মঞ্জুরুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত অবৈধ বোর্ডের দুর্নীতি তদন্তে ডিজিএফআই যখন মাঠে নামে তখন উপায়ন্তর না দেখে প্রাক্তন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. নুরুদ্দিন খানকে নামমাত্র চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে মঞ্জুরুর রহমানই পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণ করেন।

কোম্পানির সিংহভাগ টাকার মালিক বীমা গ্রাহক হলেও অবৈধ, অন্যায় এবং দুর্নীতি কার্যকলাপ চালু রাখার স্বার্থে কারণে-অকারণে আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়া এবং মামলায় প্রভাব খাটিয়ে জেতার জন্য প্রভাবশালী একজন ব্যরিস্টারকে নিয়মিত মাসোহারা প্রদান করে আসছে ।

এ ছাড়াও বিগত দিনগুলোতে অবৈধ এই বোর্ডের কার্যকলাপ ও আদিবা রহমানের দুর্নীতি সম্পর্কে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে নিস্ক্রিয় রাখতে তাদেরকে ঢাকায় প্লট ও নগদ টাকা প্রদান করেছে ডেল্টা লাইফের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডেল্টা লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনিও কল রিসিভ করেননি।