নন-লাইফে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নতুন হার: যা বললেন মূখ্য নির্বাহীরা

আবদুর রহমান আবির: প্রিমিয়াম আয়ের ৫০% পর্যন্ত কমিশন ও ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করতে পারবে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। এই হার নির্ধারণ করে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা, ২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। খুব শিগগিরই এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

নতুন এ হার বীমা খাতের জন্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডি কথা বলে বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীদের সঙ্গে। এ বিষয়ে ৯ জন মূখ্য নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলা হয়। এর ভেতরে অধিকাংশ মূখ্য নির্বাহী-ই ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নতুন হারের সম্পের্কে জানেন না বলে জানান। তবে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পক্ষ থেকে নতুন এ হার সম্পর্কে অবহিত করা হলে এ বিষয়ে তারা ইতিবাচক মন্তব্য করেন।

মূখ্য নির্বাহীদের মন্তব্যগুলো ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি'র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাহবুবুল করিম বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর অনেক দিনের দাবি ব্যয়সীমা বাড়ানো। বর্তমানে যেভাবে খরচ বেড়েছে তাতে ১৯৫৮ সালের বিধিমালায় নির্ধারিত ব্যয়সীমা অবাস্তব বলেই মনে হচ্ছিল। নতুন বিধিমালায় খরচের সীমা বাড়ানো হলে বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ভালো হবে। এখন যে খরচটা সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে, নতুন বিধি কার্যকর হলে তা হবে না। কোম্পানিগুলো তাদের সীমার মধ্যেই থাকতে পারবে।

এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. ইমাম শাহীন বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা আরো আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। এটা না হওয়ার কারণে প্রতিটি বীমা কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় অতিরিক্ত হয়ে গেছে। নতুন বিধিমালাটি আগেই করা হলে ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে কোম্পানিগুলোকে কোর্ট-কাচারিতে যেতে হতো না। আসলে '৫৮ সালের বিধিমালা দিয়ে এখন বীমা কোম্পানি পরিচালনা করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, এখন যেটা করা হয়েছে তাতে আমরা আশা করি ব্যবস্থাপনা ব্যয় কভার হবে। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমার মধ্যেই থাকবে। প্রকৃত পক্ষে ৩০/৪০ বছর আগের খরচ আর এখনকার খরচ তো সমান হবে না। বর্তমানে নানান দিক থেকে বীমা কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়েছে। অফিসের ভাড়া বেড়েছে, বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে, সেবা প্রদানকারী সকলের খরচ বেড়েছে। দিন দিন খরচ আরো বাড়বেই। তাই নতুন এ বিধিমালা প্রয়োজন ছিল।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দাবি-ই ছিল যে, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়াতে হবে। কারণ, ১৯৫৮ সালের টাকার মূল্য আর এখনকার টাকার মূল্য সমান নয়। তখন যে টাকা বাড়ি ভাড়া দিতাম, এখন তো তা দেয়া যায় না। বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, বেতন-ভাতা সবই তো বেড়ে গেছে। সুতরাং ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমাও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. জামিরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক জিনিসের খরচ বেড়েছে। কোন জিনিসের খরচ কমেনি। ১৯৫৮ সালের বাড়ি ভাড়া এবং ২০১৮ সালের বাড়ি ভাড়া এক নয়। কর্মীদের খরচ বেড়েছে, কর্মকর্তাদের বেতনও বেড়েছে। এখন যতই চেষ্টা করি আগের খরচে কোম্পানি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে সবাই চায় একটা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতে। তাই সরকার সময়োপযোগী কোন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করলে সেটা অবশ্যই বীমাখাতের জন্য ভালো হবে।

সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামিম বলেন, ব্যয়সীমা কিছুটা বাড়ানো দরকার ছিল। তবে আমাদের জন্য এটা খুব বেশি কার্যকর হবে না। কারণ, আমরা এখনো ১৯৫৮ সালের বিধিমালায় নির্ধারিত সীমার মধ্যেই ব্যয় করে আসছি। তবে আগের ব্যয়সীমা মেনে চলা বেশ কঠিন। এ জন্য নতুন বিধিমালায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যে সীমা বাড়ানো হয়েছে তা খুবই ভালো হয়েছে।

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খালেদ মামুন বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানোটা যুক্তিসম্মত। বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য এটা খুবই ভালো হয়েছে। কারণ, ১৯৫৮ সালে কোম্পানিগুলোর যে পরিমাণ খরচ হতো এখন তা অনেক বেড়েছে। সঙ্গতকারণেই এখন ব্যয়সীমা বাড়ানো দরকার। তাই ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নতুন যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছি, যুক্ত করেন খালেদ মামুন।

অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নতুন প্রবিধানমালায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে, এটা আমাদের জন্য ভালো। সময়ে সময়ে এগুলো রিভিউ করা হলে এবং কোম্পানিগুলো এগুলো মেনে চললে বীমাখাতে শৃঙ্খলা আসবে। এরইমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বীমাখাতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আসলে এখন সব ধরণের খরচ বেড়ে গেছে তাই ব্যয়সীমা বাড়ানো দরকার ছিল।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, নতুন প্রবিধানের গেজেট আমাদের হাতে আসলে সেটা বিশ্লেষণের পর বুঝতে পারব যে, সেটা আমাদের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য। তবে ১৯৫৮ সালের বিধান এখন ২০১৮ সালে এসে কতটা কার্যকর তা সাধারণভাবেই বোঝা যায়। তাই আগের বিধানের চেয়ে বর্ধিত সীমার নতুন বিধান অবশ্যই আমাদের জন্য সহায়ক হবে। অন্তত মন্দের ভালো হবে বলে আমরা আশা করছি।

ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অরুণ কুমার সাহা বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নতুন যে প্রবিধান হচ্ছে সেটা এখনো আমাদের কাছে আসেনি, তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমাদের আগের যে ৫৮'র রুল ছিল, সেটা কোনভাবেই এখনকার সময়ের সাথে উপযোগী ছিল না। যার জন্য আমাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় সব সময় ওই রুলের আওতায় অতিরিক্ত হয়েছে।

উল্লেখ্য, নতুন প্রবিধানমালার ৩ -এ টেবিল উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, "কোন নন-লাইফ বীমাকারী কোন পঞ্জিকা বৎসরে সাকুল্যে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ সর্বোচ্চ নিম্ন বর্ণিত অর্থ ব্যয় করিতে পারিবে, যথা:- সংশ্লিষ্ট বৎসরে- (ক) পরিচালিত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বীমা এজেন্ট ও ব্রোকারগণকে পরিশোধিত কমিশন খরচ ও অন্যান্য পারিশ্রমিক; এবং (খ) বাংলাদেশে সরাসরি লিপিবদ্ধ মোট গ্রস প্রিমিয়াম আয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর উপর নিম্নবর্ণিত টেবিলে বর্ণিত অর্থ,"

২০১৮ সালের এ প্রবিধানে সরাসরি বাংলাদেশে ইস্যুকৃত বীমাকারীর মোট গ্রস প্রিমিয়াম আয়কে ৮টি অংশে বিভক্ত করে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ ছাড়াও বীমা এজেন্ট ও ব্রোকারগণকে পরিশোধিত কমিশন খরচ ও অন্যান্য পারিশ্রমিক ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বাইরে রাখা হয়েছে। ১৯৫৮ সালের প্রবিধানেও এটি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বাইরে ছিল। তবে ২০১৬ সালের রহিত প্রবিধানে কমিশনকে মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের বিধির চেয়ে নতুন প্রবিধানে ১১.২৯ শতাংশ ব্যয়সীমা বাড়ানো হয়েছে।

চূড়ান্ত করা নতুন এ প্রবিধান অনুসারে, প্রথম ১৫ কোটি টাকা প্রিমিয়ামে অগ্নি ও অন্যান্য বীমার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা খাতে গড়ে ৩৫ শতাংশ এবং বীমা এজেন্ট ও ব্রোকারগণকে পরিশোধিত কমিশন খরচ ও অন্যান্য পারিশ্রমিক বাবদ ১৫ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে। অর্থাৎ প্রথম ১৫ কোটি টাকায় কমিশন ও ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বমোট ৫০ শতাংশ খরচ করার অনুমোদন দিয়েছে। যা নৌ বীমার ক্ষেত্রে সর্বমোট ৪১ শতাংশ।

তবে ১২০ কোটি টাকার ওপরে যেকোন অংকের ক্ষেত্রে অগ্নি ও অন্যান্য বীমার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কমিশনসহ ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বমোট ৩৭ শতাংশ ব্যয়ের অনুমোদন রাখা হয়েছে ২০১৮ সালের প্রবিধানমালায়। আর নৌ বীমায় কমিশনসহ ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বমোট ৩১ শতাংশ ব্যয়ের অনুমোদন রাখা হয়েছে নতুন এ বিধিমালায়।