মাসে ৪ জন আনলেই বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা!

আবদুর রহমান আবির: মাসে শুধু ৪ জন ব্যক্তিকে প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই প্রতিমাসে বেতন দেয়া হবে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর তার চেয়ে বেশি আনা যায় তাহলে বেতন আরো বাড়বে। এমন নিশ্চয়তার কথা শুনেই মতিঝিলে অবস্থিত এনআরবি গ্লোবাল লাইফের প্রধান কার্যালয়ে এসেছেন মো. মিরাজ, ফারাবি, ইমন এবং তাদের মতো আরো অনেকেই।

কেউ এসেছেন কলেজের বড় অপুর কথায়, কেউবা মামার সঙ্গে। তবে সবাই এসেছেন পরিচিতজনের কথায়, যারা আগে থেকেই যুক্ত হয়েছেন এনআরবি গ্লোবাল লাইফে ইন্স্যুরেন্সের এ আশ্বাসে। কেউ এক মাস হলো যোগ দিয়েছেন, কেউবা আরো কম সময়। তবে সবাই এসেছেন চাকরি করতে। আর নতুনদের এনেছেন চাকরিতে যোগদানের জন্য।

আজ রোববার (১২ আগস্ট, ২০১৮) দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে আজিজ ভবনে অবস্থিত বেসরকারি লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠান এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের চিত্র এটা।

এনআরবি গ্লোবাল লাইফের চাকরি নিতে মো. ইমন হোসেন এসেছেন ঢাকার বাসাবো থেকে। একটি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। ইমন জানান, এখানে কাজ করলে মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা বেতন পাওয়া যাবে এমন আশ্বাস দিয়েছে কোম্পানির লোকজন। এ জন্য মাসে ৪ জন লোক নিয়ে আসতে হবে। বেশি লোক আনতে পারলে বেশি বেতন পাওয়া যাবে।

কোন লোক নিয়ে এসেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দু'তিন দিন ধরে এখানে আসছি। কলেজের বড় ভাইয়া ও আপু আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তারা মাসখানিক হলো জয়েন করেছেন। তবে বেতন পেয়েছেন কিনা তা জানি না। আমি এখানে একদিন ট্রেইনিং নিয়েছি। আজ-কালকের মধ্যে আমার জয়েন করার কথা আছে।

ইমন বলেন, আমার বাবার বেডিং এর দোকান আছে। বাবাকে আমার এ চাকরিটা পাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি নিষেধ করেছেন। বলেছেন, এ ধরণের চাকরি করা যাবে না। তাই আমি বাবাকে না জানিয়ে এখানে চাকরি নিতে এসেছি। যখন বেতন পাব তখন জানালে হয়তো বাবা খুশি হবেন।

কবি নজরুল কলেজের দুই শিক্ষার্থী ফারাবি ও মিরাজ। একজন বাণিজ্য বিভাগে আর অন্যজন বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছেন। বাড়ি নোয়াখালিতে। সম্পর্কে দু'জনে মামা-ভাগ্নে। মামা ফারাবি বেশ কয়েকদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছেন। এবার ভাগ্নে মিরাজকে নিয়ে এসেছেন চাকরি দিতে। এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স তাদের কর্মস্থল।

আলাপকালে মিরাজ বলেন, ফারাবি মামা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। দু'জন এক সাথেই পড়ালেখা করি। মামা বললেন মাসে ৪ জন লোক নিয়ে আসতে পারলে সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পাওয়া যাবে। তবে লোক বেশি হলে বেতন বাড়বে, আর কম হলে বেতন কমতেও পারে।

ফারাবি বলেন, অনার্সে পড়ি। ফার্স্ট ইয়ার হওয়া হাতে সময় আছে। তাই একটা চাকরি খুঁজতে ছিলাম। আমার এক বন্ধু এখানে চাকরি করে। সেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অল্প কয়েকদিন হলো আমি এখানে আসতেছি। প্রতি মাসে ৪জন লোককে নিয়ে আসতে হবে। তাই প্রথমেই আমি ভাগ্নেকে নিয়ে এসেছি।

এনআরবি গ্লোবাল লাইফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (ডিএমডি) জসিম উদ্দিন বলেন, লোক নিয়ে আসার দায়িত্ব তাদের (ফিনান্সিয়াল এসোসিয়েট) । আর বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের। অনেক এফএ নিজেই বুঝাতে পারে। সেক্ষেত্রে বীমা পলিসি পূরণ করার সময় আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হয়। আমরা নতুনদের প্রথমে তাদের নিকট আত্মীয়কে সাথে নিয়ে আসতে বলি। অভিভাবকদের বোঝাতে পারলে দু'টি কাজ হয়। বীমাও হয়, আবার এফএ'দের কাজে তারা সহযোগিতাও করেন।

জসিম উদ্দিন আরো বলেন, নতুন কেউ এখানে আসলে আমি তাদের স্পষ্ট করে বলে দেই যে, এটা কোন চাকরি না এবং নির্দিষ্ট কোন বেতনও নেই। বীমা করলে কমিশন পাওয়া যাবে, না করলে নেই। তবে প্রতি মাসে ৪ জন লোকের বীমা করাতে পারলে তাদের সাড়ে ১২ হাজার টাকার বেশি কমিশন আসে। তাই অনেকে মনে করে যে এখানে কাজ করলে মাসে সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পাওয়া যায়।

রূপালী লাইফ থেকে দু'মাস আগে এনআরবি গ্লোবাল লাইফে যোগদান করেছেন ডিএমডি জসিম উদ্দিন। তিনি আরো বলেন, দু'মাস আগেও এখানে লোকজন আসত না। কিন্তু এখন লোকে লোকারণ্য। বসার জায়গা নেই। আগে ৩টি ফ্লোর নিয়ে এ অফিস ছিল। ব্যবসা না থাকায় কোম্পানির কার্যালয়ের আকার কমিয়ে আনা হয়েছে। এখন ভবনটির একটি মাত্র ফ্লোরেই চলছে কার্যক্রম।

তিনি আরো বলেন, আমরা রূপালি লাইফ থেকে প্রায় দেড়শ' লোক জয়েন করেছি। আর ডেসটিনিতে কাজ করত এমন ৮ জনের মতো জয়েন করেছে। মানুষকে বোঝাতে ওরা খুবই দক্ষ। সময় মতো সব কাজ করে ওরা। তাই অল্প দিনের মধ্যে অফিসের চেহারা পাল্টে গেছে। সারাদিনই লোকজন আসে। আর নতুনদের প্রশিক্ষণও চলে সারাদিন।

দু'মাস হলো এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেছেন এস এম জলিল আল জাহিদ। কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজার (উন্নয়ন) ও সেন্ট্রাল ট্রেইনার (উন্নয়ন) পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জাহিদ বলেন, আমি ডেসটিনিতে কাজ করেছি প্রায় ৬ বছর। বিদেশ ভ্রমনের প্যাকেজও পেয়েছিলাম। তবে ওই সময় ডেসটিনি নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হওয়া ভ্রমনের পরিবর্তে আমাদের টাকা দিয়ে দেয়া হয়।

জলিল আল জাহিদ বলেন, ডেসটিনিতে কাজ করতাম এমন ৮ জন আমরা এখানে যোগ দিয়েছি। আমাদের আগের অভিজ্ঞতাকে এখানে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, রফিকুল আমিন স্যার একজন দক্ষ সংগঠক। ডেসটিনি চালু থাকলে এখন বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো। এখনো মানুষ তার মুক্তির অপেক্ষায় আছে।

নির্ধারিত বেতনে চাকরি দেয়ার বিষয়ে কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আবু মুসা সিদ্দিকী বলেন, কাউকে এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে যারা এখানে কাজ করতে আগ্রহী তাদের যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাদেরকে বীমা বিষয়ে বোঝানে হচ্ছে। বেতন দেয়া হবে এমন কথা কাউকে বলা হয়নি। কমিশনের ভিত্তিতেই তাদের নিয়োগ দেয়া হবে।

তবে অন্য কোম্পানি থেকে এখানে যারা এসেছেন তাদের কেউ হয়তো বেতনের কথা বলে এদেরকে আকৃষ্ট করা চেষ্টা করতে পারে। তবে আমরা নিয়োগ দেয়ার সময় কমিশন ভিত্তিতেই নিয়োগ দেব এবং বিষয়টি তাদেরকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হবে।

বেতনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে লোকদের আকৃষ্ট করা ঠিক কিনা এ বিষয়ে আবু মুসা সিদ্দিকী বলেন, আমরা সবাইকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছি কোন রকম মিথ্যা তথ্য না দেয়ার জন্য। নিয়মের বাইরে গিয়ে আমরা কোন কাজ করব না।

এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি নিতে আসা অনেক ছেলে-মেয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হলে আবু মুসা সিদ্দিকী বলেন, ১৮ বছরের নিচে কাউকে বীমা পেশায় নেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা যাচাই-বাছাই করেই তাদের নিয়োগ দেব।

উল্লেখ্য, বীমা আইন অনুসারে এজেন্টদের মাসে নির্ধারিত বেতন দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এমনকি পলিসি বিক্রির জন্য কোন রকম বেতন বা আর্থিক সুবিধা দেয়ারও সুযোগ নেই। লাইসেন্সধারী এজেন্ট ছাড়া কাউকে কমিশন বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা দেয়া বীমা আইনের পরিপন্থী। কোম্পানিটির এ ধরণের প্রলোভন দেয়া বীমা আইনের লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কেননা বীমা আইন ২০১০ এর ৬০ নম্বর ধারার ১ উপ-ধারায় বলা আছে, 'কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে জীবন অথবা সম্পত্তি সংক্রান্ত কোন প্রকারের ঝুঁকির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কোন ব্যক্তিকে কোন বীমা গ্রহণ, নবায়ন অথবা অব্যাহত রাখিবার জন্য উৎসাহিত করিতে কমিশন অথবা তাহার অংশ বিশেষের অথবা পলিসিতে প্রদর্শিত প্রিমিয়ামের কোন রেয়াত প্রদান করিবে না বা প্রদানের প্রস্তাব করিবে না অথবা গ্রাহক বা যে ব্যক্তি পলিসি গ্রহণ, নবায়ন বা সচল রাখিবেন তিনি বীমাকারী কর্তৃক প্রকাশিত নির্দেশিকা কিংবা তালিকা অনুসারে স্বীকৃত রেয়াত ভিন্ন অন্য কোন রেয়াত গ্রহণ করিতে পারিবে না...।'