আইডিআরএ’র এসএমএস সার্ভিস: হুমকিতে গ্রাহক নিরাপত্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে এবং বীমাকারীর ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম বা ইউএমপি চালু করছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ।  তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই প্লাটফর্মকে বীমা কোম্পানিসহ গ্রাহকের ব্যক্তিগত ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনা অনুসারে ইউএমপি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইডিআরএ। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের ১১২তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে গত ২৮ জানুয়ারি বীমা কোম্পানিগুলোকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

নির্দেশনায় প্রতিটি বীমা কোম্পানির সকল পলিসি ও পলিসিহোল্ডার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ইউএমপি বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুয়ার (ডিওইআর) সার্ভিস লিমিটেডকে সরবরাহ করতে বলা হয়। একইসঙ্গে কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম সংগ্রহের সকল তথ্য ইউএমপি পোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম বাস্তবায়নে বীমা কোম্পানির প্রতিটি পলিসির বিপরীতে ত্রৈমাসিক ভিত্তিক তথা প্রতি ৩ মাসে ৮ টাকা হারে খরচ করতে হবে। পে-অর্ডার অথবা পে-চেকের মাধ্যমে প্রথম মাসের ১ তারিখের মধ্যে দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড বরাবর এ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে আইডিআরএ’কে জানিয়ে বীমা কোম্পানিগুলোকে এ টাকা পরিশোধ করতে হবে।

বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নির্বাহীরা জানান, ইতোমধ্যেই তারা গ্রাহকদের এসএমএস প্রদান করে আসছেন। কোন মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি করে এসব এসএমএস পাঠানো হয়। বীমা কোম্পানিই এসএমএস তৈরি করে দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে বীমা গ্রাহকের ব্যক্তিগত কোন তথ্য বা পলিসি স্টেটমেন্ট সংক্রান্ত কোন তথ্য মোবাইল অপারেটরকে প্রদান করতে হয় না।

কোম্পানিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিটি পলিসি গ্রাহককে সাধারণভাবে বছরে ২ থেকে ২৪টি এসএমএস পাঠানো হয়। অর্থাৎ বাৎসরিক প্রদেয় প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের আগে প্রিমিয়াম পরিশোধে তাগাদা দেয়ার জন্য একবার এবং প্রিমিয়াম গ্রহণের পর গ্রাহককে তা নিশ্চিত করতে আরেকবার নোটিফিকেশন পাঠানো হয়।

একইভাবে ষান্মাসিক প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে বছরে ৪টি, ত্রৈমাসিক ১২টি এবং মাসিক ২৪টি এসএমএস পান বীমা গ্রাহকরা। প্রতিটি এসএমএস পাঠাতে বীমা কোম্পানির খরচ হয় ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৫৭ পয়সা। অর্থাৎ কোন পলিসি গ্রাহককে সর্বোচ্চ সংখ্যক এসএমএস পাঠানো হলেও কোম্পানির খরচ হয় বছরে ১৩ টাকা ৬৮ পয়সা। বার্ষিক প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে এই খরচ ১ টাকা ১৪ পয়সা। আর ১৫টি এসএমএস এর মূল্য ৮.৫৫ টাকা। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত আইন ও বীমা আইনে গ্রাহকের কোন তথ্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার বিধান নেই। তবে বিশেষ কোন ঘটনার তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য প্রদান করা যায়।

তারা বলছেন, সকল বীমা গ্রাহকের তথ্যই জাতীয় সম্পদ। এসব তথ্য বেসরকারি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে সোপর্দ করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বীমা গ্রাহকের বক্তিগত ও আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়াও বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে এ ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউএমপি চালুর জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এমনকি এটি বাস্তবায়নে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য কোন দরপত্র আহবান করা হয়নি। বরং কোন যাচাই-বাছাই না করেই দুয়ার এর প্রস্তাবনা অনুসারে তড়িঘড়ি করে এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় আইডিআরএ।

তবে প্রস্তাবিত ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম বা ইউএমপি বাস্তবায়নে আইডিআরএ’র কোন খরচ করতে হবে না বলে সরকারি ক্রয় নীতিমালা- ২০১৮ (পিপিআর-২০০৮) অনুসরণের বাধ্যবাধকতা নেই বলে উল্লেখ করেছে বীমা খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

ইউএমপি দেশের বীমাখাত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাভুক্ত নয় বলে জানা গেছে। তবে জাতীয় বীমা নীতি- ২০১৪ এর ২.৫ অনুচ্ছেদের ৫-এ ইলেক্ট্রনিক ডাটা ও তথ্য বিনিময় চালু করাকে প্রধান ‌প্র‌তিপালনীয় বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।  তবে কেন্দ্রীয়ভাবে তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ইলেক্ট্রনিক ডাটা বা তথ্য প্রদান করার কোন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড নামক এই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের মে মাসের প্রথমার্ধে আইডিআরএ’র কাছে এসএমএস এলার্ট সার্ভিস চালুর জন্য একটি কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবনা দাখিল করে। বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে দুয়ার সার্ভিসকে এ বিষয়ে একটি প্রেজেন্টেশন ও কারিগরি ডেমন্সট্রেশন দেয়ার আহবান জানান আইডিআরএ।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান, সদস্যমণ্ডলী এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম বা ইউএমপি’র বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিস্তারিত প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করে দুয়ার কর্তৃপক্ষ। মে মাসের শেষের দিকে এ প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়।

এরপর বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কক্ষে সকল সদস্যের উপস্থিতিতে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সবাই ইউএমপি’র কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। ইউএমপি বাস্তবায়নের যাবতীয় খরচ দুয়ার কর্তৃপক্ষ বহন করবে বলে এর আর্থিক প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে।

দুয়ার এর প্রস্তাবনা অনুসারে, ইউএমপি’র মাধ্যমে প্রত্যেক পলিসিহোল্ডারকে বছরে সর্বোচ্চ ১৫টি এসএম প্রদান, ইউএমপি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি পলিসির বিপরীতে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ৮ টাকা হারে আইডিআরএ কর্তৃক প্রদেয় হবে। পরে বীমা কোম্পানিগুলোর কাছ থকে এ টাকা পুনর্ভরণ করবে এইডিআরএ, এমন সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়।

দুয়ার সার্ভিস লিমিটেডের এ প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আইডিআরএ’র ১১২তম সভায় এটি নীতিগত অনমোদন দেয়া হয়। এরপর কার্যাদেশ প্রদান করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) অনুযায়ী এ বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করতে বলা হয় দুয়ার সার্ভিসকে।

তথ্য অনুসারে, ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম এর জন্য পলিসিহোল্ডারদের নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, পলিসি নম্বর, পরিকল্প, মেয়াদ, মোট বীমা অংক, প্রিমিয়াম, প্রিমিয়াম দেয় তারিখ, পলিসির মেয়াদোর্ত্তীর্ণের তারিখ, পলিসির সুবিধাদি, অফিসের নাম, এলাকা, পলিসি মেয়াদোর্ত্তীর্ণের তথ্য, মেয়াদোর্ত্তীর্ণ দাবি পরিশোধের তথ্য প্রদান করতে হবে।

এ ছাড়াও পলিসির অন্য কোন চাহিদা থাকলে তার তথ্য, পলিসি তামাদি হয়ে থাকলে তার তথ্য, পলিসহোল্ডারের বিবরণ, বীমা পলিসির হাল নাগাদ তথ্য, বীমা পলিসির বিপরীতে কোন ঋণ থাকলে তার হাল নাগাদ তথ্য, সার্ভাইবেল বেনিফটের তথ্য এবং মনোনীতকের তথ্য প্রদান করতে হবে। প্রতিটি নোটিফিকেশনের তথ্য আইডিআরএ’র ডাটা বেইজে সংরক্ষিত থাকবে।

দুয়ার সার্ভিস লিমিটেডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের ৪টি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দুয়ার গঠন করেছে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্ক ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটেড ইন্টেলিজেন্স ইনক. এবং ঢাকা ভিত্তিক ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত স্পেক্ট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম লি., ২০০৫ সালের এডাপ্টিভ এন্টারপ্রাইজ লি. ও ২০১৪ সালের সেলেসকোপ লি. এটির মালিক।

রাজধানী ঢাকার আদাবরে শ্যামলী রিং রোডের বায়তুল আমান টাওয়ারে ডোয়ার সার্ভিস লিমিটেড এর সদর দফতর। সেখান থেকেই বাংলাদেশে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার এ প্রতিষ্ঠান। তবে রাজধানীর দিলকুশায় সানমুন স্টার টাওয়ারে প্রতিষ্ঠানটির লেয়াজু অফিস রয়েছে।

ওয়েবসাইটে আরো দেখা গেছে, অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের একটি চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুসারে, অগ্রনী-ডোয়ার নামে ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পরিচালনা করছে ডোয়ার। তবে এর বাইরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডোয়ার এর কার্যক্রম রয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই।