বীমা কোম্পানির অফিস বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহক

আবদুর রহমান আবির: পারভেজ হোসেন চৌধুরী। বেসরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন। থাকেন ঢাকায়। সীমিত বেতনে কোনভাবে চলে তার সংসার। টানাপড়েনের মধ্যেও ভবিষ্যৎ আর্থিক সুরক্ষার জন্য কিনেছিলেন একটি লাইফ বীমা পলিসি। প্রত্যাশা ছিল বড় কোন প্রয়োজনে আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পাশে দাঁড়াবে বীমা। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। প্রয়োজনের সময় কাজে লাগেনি তার সেই বীমা পলিসি।

সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশ যখন করোনা ভাইরাস মহামারীতে জর্জরিত। সংক্রমন প্রতিরোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। তখন আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে নিজের বীমা পলিসির বিপরীতে ঋণের আবেদন করেছিলেন পারভেজ হোসেন। কিন্তু বীমা কোম্পানি তার সেই আবেদন অমীমাংসিত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। জানিয়েছে সাধারণ ছুটিতে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ, তাই এখন ঋণ দেয়া সম্ভব নয়।

শুধু পারভেজ হোসেন-ই নয়, এমন হাজার হাজার বীমা গ্রাহক রয়েছেন যারা বিপদের এই সময়ে পাশে পাচ্ছেন না তাদের বীমা কোম্পানিকে। মেয়াদোত্তীর্ণ বীমা দাবি, সার্ভাইভাল বেনিফিট, বীমা পলিসির বিপরীতে ঋণ ও মৃত্যুদাবিসহ বিভিন্ন বীমা দাবি নিষ্পত্তির কার্যক্রম এখন আটকে গেছে। অফিস বন্ধ থাকায় এসব বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না বীমা কোম্পানিগুলো। যার ভুক্তভোগী এখন হাজার হাজার বীমা গ্রাহকরা।

ভুক্তভোগী বীমা গ্রাহক পারভেজ হোসেন চৌধুরী বলেন, টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। তাই বীমা কোম্পানির কাছে লোনের প্রস্তাব করেছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার ৩ দিন আগে এই আবেদন পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় আমার সেই আবেদন পেন্ডিং রেখেছে। বিপদের দিনে যদি বীমা কাজে না লাগে তাহলে বীমা করেই কি লাভ! তাই সরকারের কাছে আমার আবেদন জরুরি সেবার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোর অফিস খুলে দেয়া হোক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইফ বীমা খাতে প্রতি মাসে গড়ে পুরনো বীমা কোম্পানিগুলোতে সহস্রাধিক বিভিন্ন বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়। আর নতুন বীমা কোম্পানিগুলোতে পরিশোধ করা হয় শতাধিক বীমা দাবি। প্রতিটি বীমা দাবি পরিশোধ কার্যক্রম কোম্পানির একাধিক বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। যার কারণে সীমিত পরিসরে অফিস চালু করেও এসব বীমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। বীমা দাবি সংশ্লিষ্ট সব বিভাগই চালু করা প্রয়োজন।

তারা আরো বলছেন, বীমা দাবি পরিশোধ ছাড়াও প্রিমিয়াম গ্রহণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও কমিশন দেয়ার জন্য অফিসে যাওয়া প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে বীমা খাতের স্বার্থে সপ্তাহে অন্তত এক দিন অফিস খোলা রাখা জরুরি। তা না হলে বীমা কোম্পানি ও গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর বিপদের সময় গ্রাহক বীমা সুবিধা না পেলে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হবে। যা প্রত্যাশিত নয়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে দেশের লাইফ বীমাখাতে ৭ হাজার ২৩১ কোটি টাকা বীমা দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে বীমা কোম্পানিগুলোর ৬ হাজার ৫১১ কোটি টাকা দাবি পরিশোধ করে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫৪২ কোটি টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করেছে বীমা কোম্পানিগুলো।

এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত লাইফ বীমায় উত্থাপিত ২ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বীমা দাবির মধ্যে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করে কোম্পানিগুলো। আর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত লাইফ বীমায় বীমা দাবি পরিশোধ করা হয় ১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।

সরকারি-বেসরকারি ৭৮টি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে। বর্তমানে লাইফ বীমায় ৯০ লাখ ২০ হাজার এবং নন-লাইফে ৩০ লাখ ৮০ হাজার বীমা পলিসি চালু রয়েছে। উভয় খাতে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ১৩ হাজার ২৯০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আর বীমার আওতায় রয়েছে ২ কোটি জনসংখ্যা।

এ বিষয়ে জেনিথ ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রিমিয়াম জমা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় বাড়ানো হলে চালু বীমা পলিসির গ্রাহকরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। কিন্তু যাদের বীমা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে বা সার্ভাইভাল বেনিফিট পাওয়ার সময় হয়েছে অথবা কেউ বীমা পলিসির বিপরীতে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন তাদের কি অবস্থা হবে! আর যেসব গ্রাহক মৃত্যুবরণ করবেন তাদের পরিবারও তো এখন বীমার টাকা পাবে না। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন অফিস খোলা রাখা জরুরি।

গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম মনিরুল আলম বলেন, গ্রাহকের প্রয়োজনের সময় যদি বীমা কোম্পানি তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারে তাহলে গ্রাহক কেন বীমা করবে! আর বীমা দাবি পরিশোধ করার অর্থ তো গ্রাহকের টাকাই গ্রাহককে ফেরত দেয়া। প্রয়োজনের সময় একসঙ্গে টাকাগুলো হাতে পাওয়ার আশা নিয়েই গ্রাহক বীমা করে।

তিনি বলেন, গ্রাহকের সেই প্রত্যাশা পূরণেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অফিস বন্ধ থাকায় আমরা অনলাইনেই বীমা দাবি গ্রাহণ ও পরিশোধ শুরু করেছি। তবে সব কোম্পানির পক্ষে হয়তো সেটা সম্ভব নয়। তবে বীমা গ্রাহকের প্রয়োজনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার। এ জন্য যেকোন পথ আমাদের খুঁজে নিতে হবে।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম শরীফুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় আমাদরে কয়েক কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ আটকে গেছে। অফিস খোলা থাকলে প্রিমিয়াম সংগ্রহ যেমন হতো তেমনি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করাও যেতো। অন্তত কোম্পানি ফান্ডে গ্রাহকের বীমা দাবির যে টাকা রয়েছে সেটা তো পরিশোধ করা যেতো।

তিনি বলেন, নতুন কোম্পানিগুলোর মধ্যে যারা সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের পক্ষে অনলাইনে বীমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হলেও পুরনো কোম্পানিগুলোর পক্ষে অনলাইনে বীমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তাই অফিস খোলা রাখা জরুরি। তা না হলে বীমা কোম্পানি ও গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটি’র জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, প্রয়োজনের এই সময়ে বীমা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারলে বীমা করে তাদের কি লাভ! বীমার কাজই তো গ্রাহকের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো। দীর্ঘ এই বন্ধে বীমা কোম্পানি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বীমা গ্রাহক।

এ কে এম এহসানুল হক আরো বলেন, ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানি উভয়ই আর্থিক প্রতিষ্ঠান। জনসেবায় প্রতিষ্ঠান দু’টি পরস্পরের সঙ্গে আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেক্ষেত্রে ব্যাংক যদি সপ্তাহে ৫ দিন খোলা রাখা যায় তাহলে গ্রাহক সেবার স্বার্থে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা প্রয়োজন।