পরিচয় গোপন করে সিইও’র ছেলেকে মোটা বেতনে নিয়োগসহ ইসলামী কমার্শিয়ালের ১০ অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক: পরিচয় গোপন করে মোটা অংকের বেতনে নিজের ছেলেকে নিয়োগ দেয়াসহ অবলিখন কর্মকর্তাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ এবং অনভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ করে অবৈধভাবে বেতন উত্তোলন করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা।

এছাড়াও বীমা আইন ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, গড়মিল তথ্য প্রদানসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স। এসব প্রমাণ পেয়েছে নন-লাইফ বীমাখাতে অবৈধ কমিশন, দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে গঠিত বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র সার্ভিলেন্স টিম।

এ ঘটনায় ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জরিমানাসহ মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অপসারণ এবং কোম্পানিটির সিটি সেন্টার শাখা কার্যালয় বন্ধের সুপারিশ করেছে সার্ভিলেন্স টিম। সুপারিশের ভিত্তিতে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বীমা কোম্পানিটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নোটিশের প্রেক্ষিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি এসব ঘটনার ব্যাখ্যাও দিয়েছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স।

তবে, বর্তমানে বিষয়টির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. শেখ মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বর রাজধানীর মতিঝিলে সিটি সেন্টারে অবস্থিত ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান কার্যালয় এবং সিটি সেন্টার শাখা পরিদর্শন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র সার্ভিলেন্স টিম। পরিদর্শনে বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮৯১), ৬০, ৬৩, ৭২ এবং ১৩১ ধারা ও কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নন-লাইফ ৩২/২০১২, নন-লাইফ ৩২(ক)/২০১২, নন-লাইফ ৩৪/২০১২, নন-লাইফ ৬৪/২০১৯ এবং ৭০/২০১৯ নির্দেশনা লঙ্ঘনসহ ১০টি অনিয়ম-জালিয়াতির তথ্য পায় সার্ভিলেন্স টিম।  

উন্নয়ন কর্মকর্তাকে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব প্রদান:

নোটিশে বলা হয়েছে, বীমা আইন ২০১০ এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০ অনুযায়ী ব্যবসা সংগ্রহের জন্য ‘উন্নয়ন কর্মকর্তা’ নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবসা সংগ্রহকারী এজেন্ট হিসেবে নিয়োগের কোন আইনগত ভিত্তি নেই। অথচ এজেন্টের অনুরূপ মোট ব্যবসা সংগ্রহের হার অনুসারে এবং নির্দিষ্ট বেতনে উভয় পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা রেখে উন্নয়ন কর্মকর্তার নামে বিভিন্ন পদ সৃষ্টি করে কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নতুনভাবে অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। এ সকল নিয়োগে তিনি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কোন অনুমোদন গ্রহণ করেননি।

মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বীমা গ্রাহককে বিধিবহির্ভুতভাবে ১৫% কমিশন এবং ১৫% এর অধিক কমিশন প্রদানের উদ্দেশ্যে এ সকল উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন এবং সিটি সেন্টার শাখায় আগস্ট ২০১৯ মাসে নীট প্রিমিয়ামের ৪৭.৯০% অর্থ বেতন ও কমিশন বাবদ প্রদান করে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(১), ৬০ ধারার বিধান এবং কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং নন-লাইফ৩২/২০১২, নন-লাইফ ৩২(ক)/২০১২ এবং ৩৪/২০১২ এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছেন।

অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স ২০১৮ সালে ৩.৫১ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে প্রথম কোয়ার্টারে ১.৫৭ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ০.৫৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে। কোম্পানির অনুমোদিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের প্রবণতার ফলে কোম্পানির বিনিয়োগ কম হয় এবং বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস পেয়ে বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে। একইসঙ্গে বিধিবহির্ভুতভাবে কমিশনের নামে গ্রাহককে সুবিধা প্রদান এবং বীমাকারী কর্তৃক অর্থ আত্মসাতের সত্যতাও প্রমাণ করে অতিরিক্ত ব্যয়। অনুমোদিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করে বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৬৩ এর লঙ্ঘন করা হয়েছে।

পরিচয় গোপন করে অস্বাভাবিক বেতনে ছেলেকে নিয়োগ:

সার্ভিলেন্স টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ তার ছেলে মীর তাসীন ইসমাম আহমেদ রেদোয়ানকে বীমা কাজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা লক্ষ্যমাত্রার ওপর এবং মাসিক ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্দিষ্ট বেতনে জেনারেল ম্যানেজার (উন্নয়ন) পদে কোম্পানিতে নিয়োগ প্রদান করেন। তবে তার নিয়োগপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দাখিলের শর্ত থাকলেও তার ব্যক্তিগত নিথতে কোন সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও পিতার পরিচয় গোপন করার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্তভাবে ‘এম এন আহমেদ’ ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) এর কাছে সাক্ষাতকারে মীর তাসীন সেপ্টেম্বর, ২০১৯ মাসে ৭/৮টি মোটর ইন্স্যুরেন্স পলিসি সংগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে কোম্পানির কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সা ১১০টি পলিসির মাধ্যমে মোট প্রিমিয়ামের ৪০% সংগ্রহ হয়েছে মূখ্য নির্বাহীর ছেলে মীর তাসীন ইসমাম আহমেদ রেদোয়ানের মাধ্যমে। মীর তাসীনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিনি মোট প্রিমিয়ামের ৪০% সংগ্রহ করেননি এবং এতে প্রমাণিত হয় উন্নয়ন কর্মকর্তাগণের দ্বারা প্রিমিয়াম সংগ্রহের ডকুমেন্টটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা তথ্যের ওপর প্রদর্শিত।

লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও এজেন্টের অনুরূপ উন্নয়ন কর্মকর্তাদের কমিশন পরিশোধের জাল কাগজপত্র তৈরি:

প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি সেন্টার শাখায় আগস্ট ২০১৯ মাসে নীট প্রিমিয়াম ২০ লাখ ৪০ হাজার ৯৮৯ টাকা সংগ্রহের জন্য উক্ত নীট প্রিমিয়ামের মোটি ৪৭.৯০% অর্থ বেতন ও কমিশন বাবদ প্রদান করা হয়েছে মর্মে দেখানো হয়েছে। এজেন্ট এবং উন্নয়ন কর্মকর্তাদের হাজির করার জন্য বলা হলে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সিটি সেন্টার শাখার সকল উন্নয়ন কর্মকর্তাকে হাজির করতে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় যে, কোম্পানিটি সিটি সেন্টার শাখা উক্ত প্রিমিয়াম সংগ্রহের লক্ষ্যে নীট প্রিমিয়ামের ৪৭.৯০% উত্তোলন করে অধিকাংশ পরিমাণ অর্থ বীমা গ্রাহককে প্রদান করেছে, যা বীমা আইন ২০১০ এর ৬০ ধারার বিধানের লঙ্ঘন।

আইডিআরএ’র কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, উন্নয়ন কর্মকর্তার কোন এজেন্ট লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও তাদের দ্বারা ব্যবসা সংগ্রহ বা পলিসি বিক্রয় করে সংগৃহীত প্রিমিয়ামের ওপর এজেন্টের কমিমন প্রদানের অনুরূপ পারিশ্রমিক প্রদানের জাল ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স এবং উন্নয়ন কর্মকর্তাকে এজেন্ট হিসেবে কাজ করানোর আইনগত কোন ভিত্তি না থাকায় এখানে বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(১) ধারা বিধান এবং কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং নন-লাইফ ৩৪/২০১২ এর নির্দেশনার লঙ্ঘন হয়েছে।

অবলিখন কর্মকর্তাকে এজেন্ট নিয়োগ:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মোহাম্মদ সোলায়মান কোম্পানির একজন অবলিখন কর্মকর্তা এবং তার পদবী সিনিয়র ম্যানেজার হলেও তিনি লাইসেন্স প্রাপ্ত একজন এজেন্ট। তবে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এজেন্ট লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কোম্পানির শাখা থেকে প্রদত্ত হিসাব মোতাবেক এজেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ সোলায়মান ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৩১ লাখ ৪৫ হাজার ১৩৫ টাকা ব্যবসার বিপরীতে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৭০ টাকা কমিশন প্রাপ্ত হয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি উক্ত মাসে স্থায়ী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপত্রে নির্ধারিত মাসিক বেতন-ভাতাদিও গ্রহণ করেছেন।

তদন্তকালে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিনিয়র কর্মকর্তা সোলায়মান বীমা এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা হতে প্রাপ্ত কমিশনের অর্থ ১৪.২৫% হারে পলিসি গ্রাহকককে বুঝিয়ে দেন। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আরও স্বীকার করেছেন যে, আইন অনুসারে এজেন্ট কমিশন গ্রাহককে দেয়া যায় না। কিন্তু চলতি বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরসহ চলতি মাসে প্রাপ্ত কমিশনের অর্থ পলিসি গ্রাহককে প্রদান করে ব্যবসা সংগ্রহ করেছেন। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আরো জানান, কোম্পানির কোন কোন শাখায় একই ব্যক্তি কর্মকর্তা এবং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, যা বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৬৬(১)(গ) এর পরিপন্থী।

অবৈধভাবে বেতন উত্তোলন:

সার্ভিলেন্স টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানির কমিশন সংক্রান্ত অনিয়ম দূর করার লক্ষ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত সকল সার্কুলারের নির্দেশনা পরিপালন না করে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করে। তন্মধ্যে অপেশাদার এবং অনভিজ্ঞ লোককে কোম্পানির উচ্চ পদে অধিক বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক সুবিধা দিয়ে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং নন-লাইফ ৬৪/২০১৯ এবং নন-লাইফ ৭০/২০১৯ জারির পর অবৈধ কমিশনের নামে গ্রাহককে নির্ধারিত প্রিমিয়ামের চেয়ে হ্রাসকৃত রেটে অবৈধ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে অক্টোবর ২০১৯ মাসে উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন পদবী দিয়ে নতুন নতুন উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করে। কর্মকর্তাদের বেতন শীটের সাথে তাদের ব্যক্তিগত নথি পরীক্ষান্তে দেখা যায়, প্রকৃত লোক স্বাক্ষর ব্যতিরেকে বেতন উত্তোলন করেছেন এবং স্বাক্ষর না করেও বেতন উত্তোলন করেছে।

অপেশাদার, আত্মীয়-স্বজন এবং ভুয়া লোক নিয়োগ:

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়ে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার সিটি সেন্টার শাখার উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের অফিসে হাজির হতে নির্দেশনা প্রদান করলে তিনি সকলকে হাজির করতে সক্ষম হন নাই। কর্তৃপক্ষে উপস্থিত হওয়া কর্মকর্তা (উন্নয়ন) মনির শরীফ জুয়েলকে ইংরেজিতে ইন্স্যুরেন্স বানান করতে বললেও ঠিকভাবে তা বানান করতে পারেনি এবং তিনি ইন্স্যুরেন্সের সার্টিফিকেট এবং বীমা সংক্রান্ত কগজপত্র বোঝেন না। তাছাড়া ইন্স্যুরেন্সের বাজার সম্পর্কেও তার ধারণা নেই।

২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বীমা কোম্পানিটির সিটি সেন্টার শাখার উন্নয়ন কর্মকর্তাদের সাক্ষাতকারে দেখা গেছে তাদের মধ্যে অনেকের বীমা বিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান নেই এবং এদের অনেকেই ২০১৯ সালের জুলাই মাসের পর শাখায় যোগদান করেছেন। তাদের মধ্যে কোম্পানির একজন কর্মকর্তার স্ত্রীও রয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র অবৈধভাবে কমিশনের নামে টাকা পলিসি গ্রাহককে যোগানের এবং বীমাকারী কর্তৃক আত্মসাতের উদ্দেশ্যে এ অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে নগদে আদান-প্রদান:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যথাক্রমে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের বৈদেশিক শাখার এসটিডি নং ৪০৩ এর চেক নং ১৪৪৭১০৯ এর মোট ৮ লাখ ১৩ হাজার ১৩৯ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকের হিসাব নং ১০৭০৬ এর চেক নং ৩৭০৫২৮৫ এ মোট ৬ লাখ ৬১ হাজার ১৯০ টাকা নগদ উত্তোলন করে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নামে বিতরণ দেখানো হয়েছে। যা কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং নন-লাইফ ৬৪/২০১৯ এর ৭ নং নির্দেশনার লঙ্ঘন। যেহেতু কোম্পানির শাখায় কর্মকর্তাদের বেতন ভাতাদি চেকের মাধ্যমে দেয়া হয়নি তাতে প্রমাণিত হয় যে, বেতনের নামে উত্তোলিত অর্থ বীমা গ্রাহককে প্রদান এবং আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নগদে প্রদান দেখানো হয়েছে। 

কোম্পানির প্রিমিয়াম হিসাবের তথ্যে পার্থক্য:

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানির নিরীক্ষিত রাজস্ব হিসাবের সাথে কোম্পানি থেকে প্রদত্ত তথ্যে ২০১৭ সালে ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৪ টাকা এবং ২০১৮ সালে ৬৮ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৭ টাকার পার্থক্য বা গরমিল রয়েছে। কোম্পানির ব্যালেন্স সীটেও এ ধরণের গরমিলের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, কোম্পানি উক্ত টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং উক্ত আত্মসাতের সাথে কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কোম্পানি ভুল তথ্য প্রদান করে কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করায় বীমা আইন, ২০১০ এর ১৩১ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  

এ ছাড়াও বীমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থতাও উঠে এসেছে পরিদর্শক দলের পর্যবেক্ষণে।

কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স দাবি করেছে, সকল নন-লাইফ কোম্পানিতে উন্নয়ন কর্মকর্তার মাধ্যমে বীমা ব্যবসা আহরণ করা হয়ে থাকে। যদিও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের ব্যবসা সংগ্রহকারী হিসেবে বীমা আইনে কোন ভিত্তির উল্লেখ নাই। আগে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের ব্যবসা সংগ্রহের জন্য এজেন্ট লাইসেন্স গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল না। উন্নয়ন কর্মকর্তাদেরকে তাদের সংগৃহীত ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে বেতন দেয়া হয়, যা কমিশনের আকারে নয়।

বীমা কোম্পানিটি জানিয়েছে, তাদের সকল নিয়োগের ক্ষেত্রেই পরিচালনা পর্ষদের নির্ধারিত সদস্যের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। ভিজিলেন্স টিম যেসব ফাইল নিয়েছে তাতে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার জাল বা ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয় নাই কিংবা কোন ভুয়া উন্নয়ন কর্মকর্তা নাই। ভিজিলেন্স টিমের নির্দেশে কোম্পানির সকল উন্নয়ন কর্মকর্তাকে ভোটার আইডি, ছবি ও নিয়োগপত্রসহ হাজির করা হয় এবং তাদের সকল কাগজপত্রই কর্তৃপক্ষের অফিসে জমা আছে।   

নোটিশের জবাবে বীমা কোম্পানিটি আরো জানিয়েছে, ব্যবসা সংগ্রহকারীকে প্রতিমাসে ১৫% নির্দিষ্ট হারে কেন বেতন দেয়া হয় না। তবে তাদের জন্য ১৫% কে একক ধরে টার্গেট অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করা হয় এবং সংগৃহীত ব্যবসার ওপর ভিত্তি করেই তার বেতন দেয়া হয়। উন্নয়ন কর্মকর্তাদের প্রদত্ত বেতনের দ্বারা বীমা গ্রাহককে ১৫% এর অধিক কমিশন প্রদানের কোন উদ্দেশ্য নাই। এক্ষেত্রে কোম্পানির ব্যবসা উন্নয়নের লক্ষ্যেই বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদের বেতন-ভাতা একাউন্টোর মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ তার ছেলে মীর তাসীন ইসমাম আহমেদ রেদোয়ানের পরিচয় গোপন করে উচ্চ বেতনে নিয়োগের বিষয়ে জানিয়েছেন, কোম্পানির যথাযথ নিয়ম প্রতিপালন করে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে সে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে কাজে যোগদান করেছে। তাকে কোন ধরণের অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ যদি নির্দেশনা প্রদান করেন তবে আমার ছেলে চাকরি ছেড়ে দিবে।

তিনি আরো জানান, রেদোয়ান স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে এ লেভেল শেষ করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৯ সালে ফোর্থ ইয়ার গ্রাজুয়েশন করেছেন। বীমা শেল্প তার আগ্রহের কারণে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্সুরেন্সে ইন্টার্নশীপ করে ইউনিভার্সিটিতে যে টার্ম পেপার জমা দিয়েছে তা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। টার্ম পেপারের কপি ভিজিলেন্স টিমের কাছে তার ব্যক্তিগত ফাইলের সাথে রক্ষিত আছে।  

কোম্পানির অবলিখন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলায়মানকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স। একইসঙ্গে মোহাম্মদ সোলায়মানকে এজেন্ট নিয়োগের বিষয়টি গ্রাহকের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ হওয়ায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন বীমা কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ।

এ ছাড়াও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে প্রাইম ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে যথাক্রমে ৮ লাখ ১৩ হাজার ১৩৯ টাকা ও ৬ লাখ ৬১ হাজার ১৯০ টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়নি বলে জানিয়েছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স। এ টাকা সিটি সেন্টার শাখার প্রাইম ব্যাংকের বৈদেশি শাখার ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে চেকের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের পরিশোধ করা হয়েছে। যার ব্যাংক স্টেটমেন্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দাখিল করেছে বীমা কোম্পানিটি।

এসব বিষয়ে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, আইডিআরএ’র ভিজিলেন্স টিম ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর এবং ৭ নভেম্বর আমাদের সিটি সেন্টার শাখা পরিদর্শনকালে যে সকল অনিয়ম লক্ষ্য করেছেন বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তার প্রতিটি পয়েন্টের উত্তর যথাসাধ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি গত ১২ ফেব্রুয়ারির জবাবে। একইসঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে আমাদের ছোট ছোট ভুলগুলোকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে আমাদের ভুলগুলো শুধরানোর সুযোগ দেয়ার আবেদন জানিয়েছি। 

এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. শেখ মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, বিষয়টির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়ের শুনানি আপাতত আটকে আছে। আসলে পুরো বীমাখাতেই সমস্যা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আইডিআরএ’র এই নির্বাহী পরিচালক।