এসবিসি'র নানা শর্তে পুনর্বীমা চুক্তি নিয়ে বিপাকে বেসরকারি বীমা কোম্পানি

আবদুর রহমান:

সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) নানা শর্তে পুনর্বীমা চুক্তি নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো। এসব শর্তের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি খাতের নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো।

সূত্র মতে, ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুসারে বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো সাধারণ বীমা করপোরেশনে পুনর্বীমা করে থাকে। এই আইনের ২৩ (ক) নম্বর ধারার উপ-ধারা ২ এ বলা হয়েছে, পুনর্বীমাযোগ্য সাধারণ বীমা ব্যবসার ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমা করপোরেশনের সঙ্গে পুনর্বীমা করতে হবে এবং বাকী ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমা করপোরেশন অথবা বাংলাদেশের ভেতরে বা বাইরে অন্য যেকোন পুনর্বীমাকারির সঙ্গে পুনর্বীমা করা যেতে পারে।

তবে সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাথেই পুনর্বীমা করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বীমা আইন ২০১০ এ। এমনকি করপোরেশন আইনে নিবন্ধিত না হওয়ায় বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো আইনটি মানতেও বাধ্য নয়। যদিও অদৃশ্য কারণে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বেসরকারি ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলো।

সূত্র মতে, দেশে অন্যকোনো পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান না থাকা, অধিকাংশ কোম্পানির বিদেশী পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি না থাকা এবং করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর কারণে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো এসবিসি'র সঙ্গে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ পুনর্বীমা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলোর সাথে পুনর্বীমা চুক্তিতে নানা রকম শর্ত আরোপ করছে এসবিসি। এতে করে বিপাকে পড়ছে বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো ।

জানা গেছে, সাধারণ বীমা করপোরেশনের অগ্নি পুনর্বীমা চুক্তিতে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) নামে একটি ক্লজ যুক্ত করছে। যা বীমা কোম্পানিগুলোকে আর্থিকভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলছে।

অপর একটি সূত্র মতে, বিদেশী পুনর্বীমা কোম্পানির চাপের মুখে ১০/১২ বছর আগে থেকে সাধারণ বীমা করপোরেশন এলপিসি যুক্ত করে আসছে। ওই সময়ে কোম্পানিগুলোর ক্লেইম রেশিও বেশি হওয়াতে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ যুক্ত করে সাধারণ বীমা করপোরেশন।

ওই ক্লজ অনুসারে, এসবিসি কোন বেসরকারি বীমা কোম্পানির ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে প্রিমিয়াম এবং ক্ষতিপূরণের রেশিও অনুযায়ী। অর্থাৎ এক বছরে অগ্নি পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের অনুকুলে যে পরিমাণ দাবী আদায় করা হয়েছে তার আনুপাতিক হারে দাবী পরিশোধ করা হবে। এই আনুপাতিক হারের ব্যাপ্তি কোম্পানিভেদে ভিন্ন। কোন কোম্পানির জন্য এই আনুপাতিক হারের ব্যাপ্তি ৭০ থেকে ১৩০ শতাংশ আবার কোন কোম্পানির জন্য এই আনুপাতিক হারের ব্যাপ্তি ৬০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ।

অর্থাৎ যে কোম্পানির আনুপাতিক হারের ব্যাপ্তি ৭০ থেকে ১৩০ শতাংশ সেই কোম্পানি করপোরেশনকে দেয়া এক বছরের পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পুনর্বীমা দাবী আদায় করতে পারবে । আর ৭১ শতাংশ থেকে ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত পুনর্বীমা দাবী করপোরেশনের কাছ থেকে আদায় করতে পারবে না । আবার ১৩১ শতাংশ থেকে বাকী যেকোন পরিমাণ পুনর্বীমা দাবি করপোরেশন থেকে আদায় করতে পারবে।

যদি কোন কোম্পানির এক বছরের অগ্নি পুনর্বীমা প্রিমিয়াম ৫০ কোটি টাকা হয় এবং এক বছরের অগ্নি পুনর্বীমা দাবী ৭০ কোটি টাকা হয় তবে করপোরেশন প্রথমত দিবে ৩৫ কোটি টাকা (৫০ কোটি টাকার ৭০ শতাংশ), বীমা কোম্পানি নিজ তহবিল  থেকে দিতে হবে ৩০ কোটি টাকা (৫০ কোটি টাকার ৬০ শতাংশ) ( ১৩০-৭০=৬০) এবং করপোরেশন দিবে বাকী  ৫ কোটি টাকা ।

সূত্র মতে, বড় কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি বাংলাদেশের বাইরে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) ছাড়া ৫০ শতাংশ পুনর্বীমা করতে পারলেও ছোট ছোট কোম্পানিগুলোর সেই সক্ষমতা নেই । ফলে হুমকির মুখে রয়েছে এসব বীমা কোম্পানি। এরইমধ্যে কয়েকটি কোম্পানি বড় ধরণের বীমা দাবি পরিশোধ করতে গিয়ে বড় ধরণের ক্ষতির মধ্যে পড়েছে।

বীমা আইনের ধারা ১০(১) এ নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলকরণ বিষয়ে উল্লেখিত ১০টি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে পুনর্বীমা সম্পর্কিত। সেখানে বলা হয়েছে- কর্তৃপক্ষ নিম্নবর্ণিত এক বা একাধিক কারণে বীমাকারীর নিবন্ধন সম্পূর্ণরূপে বা বিশেষ কোন শ্রেণীর বা উপ-শ্রেণীর বীমা ব্যবসা স্থগিত বা বাতিল করিতে পারিবে, যথা- যদি বীমাকারী-(ঝ) সন্তোষজনকভাবে পুনঃবীমা ব্যবস্থাকার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন।

বীমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বীমা আইন ২০১০ এর উল্লেখিত ধারা অনুসারে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) এর কারণে সন্তোষজনকভাবে পুনর্বীমা ব্যবস্থাকার্য সম্পাদন ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু আইডিআরএ এ বিষয়ে এখন পর্য্ন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

অন্যদিকে এই ক্লজের কারণে পুনর্বীমার শতভাগ শর্ত পূরণ না হলেও তা গ্রাহকদের কাছে প্রকাশ করছে না বীমা কোম্পানিগুলো। এর কারণ, এতে গ্রাহকরা তাদের সাথে বীমা করা বন্ধ করে দিতে পারে। এ অবস্থায় গ্রাহককে জানানো হচ্ছে তাদের পলিসি শতভাগ পুনর্বীমার আওতায় আছে। এমনকি কোন কোন কোম্পানি আবার পলিসিতে রাবার স্ট্যাম্প এর ছিল দিয়ে বলে দিচ্ছে যে শতভাগ পুনর্বীমা করা হয়েছে। যা প্রতারণা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যেহেতু বীমা গ্রাহকের কোন বীমাকৃত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দাবীর একটি বিরাট অংশ বা কোন কোন সময় পুরোটাই এই লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) এর কারণে বীমা কোম্পানি সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছ থেকে আদায় করতে পারছে না এবং তা নিজের তহবিল থেকে এফডিআর ভেঙ্গে দিতে হচ্ছে তাই বীমা কোম্পানিগুলো তার বীমা গ্রাহকের দাবী পরিশোধের সময় বিভিন্ন টাল বাহানা করছে।

তাদের মতে, যারা বীমা কোম্পানির শেয়ার কিনেছে তারাও জানেন না এই লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) এর কারণে যে কোন সময় বীমা কোম্পানির নিজের জমানো টাকা থেকে একটা বড় অংকের টাকা বেড়িয়ে যেতে পারে । এমন কি এর কারণে বীমা কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ব্যাপারে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কিউএএফএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, পুনর্বীমার আন্ডাররাইটিং বিধিতে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ বা এলপিসি আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এটি চালু আছে। ভালো ব্যবসা সংগ্রহ ও আন্ডাররাইটিংয়ে আরো সতর্ক হওয়ার জন্য এলপিসি যুক্ত করা হয়। তবে ক্লজটি আরোপের ক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্তি থাকতে হবে।

যেসব কোম্পানির ক্লেইম রেকর্ড ভালো না বা লস রেশিও বেশি তাদের ক্ষেত্রে এলপিসি যুক্ত করা যেতে পারে। তবে যাদের লস রেশিও কম তাদের ক্ষেত্রে এটি যুক্ত করা ঠিক হবে না। মূলত পুনর্বীমা কোম্পানির টিকে থাকার জন্য এলপিসি বা অন্যান্য শর্ত আরোপ করা হয়ে থাকে। সাধারণ বীমা করপোরেশন সাধারণত ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ যুক্ত করে।

সিরাজুল ইসলাম আরো বলেন, ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুসারে বেসরকারি কোম্পানিগুলো এসবিসি'র কাছে পুনর্বীমা করে থাকে। বীমা আইন, ২০১০ এ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ বাতিল করেনি বরং সংযুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু আইনটি কার্যকর তাই এসবিসি'র সঙ্গে পুনর্বীমার ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে আইনটি মানতে হবে।

তবে পুনর্বীমা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। উভয়পক্ষ সম্মত না হলে কোন শর্ত আরোপ করা যায় না। দরকষকষির মাধ্যমে পুনর্বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ভালো সুবিধা নেয়া যেতে পারে। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে পুনর্বীমা চুক্তিতে সাধারণ বীমা করপোরেশন এলপিসি যুক্ত করেনি। কারণ, পাইওনিয়ারের দ্বারা এসবিসি কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে লস পার্টিসিপেশন ক্লজটির রেশিও আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে এসবিসি'র কাছে বীমা কোম্পানিগুলোর দীর্ঘ দিন যাবত দাবি করে আসছে বলে তিনি জানান।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, লস পার্টিসিপেশন ক্লজটি যুক্ত করা হয় 'বেসড অন পার্ফর্মেন্স'। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর ভিত্তি করে এই শর্ত আরোপ করা হয়। সব কোম্পানিকে নয়, যাদের ক্লেইম বেশি শুধু তাদের এই শর্ত দেয় সাধারণ বীমা করপোরেশন। এটা স্বভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া যায়। বীমা কোম্পানিও এ ধরণের শর্তারোপ করে। কিন্তু যেসব গ্রাহক ক্লেইম করে না তাদেরকে শর্তারোপ না করে বরং 'নো ক্লেইম বোনাস' দেয়।

ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সংসদ প্রণয়ন করেছে। তাই সংসদ ছাড়া এটা পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারবে না। এ কারণে বীমা আইন, ২০১০ থাকার পরও কোম্পানিগুলোকে এটি মানতে হবে। তবে পুনর্বীমা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো সাধারণ বীমা করপোরেশনের সঙ্গে দরকষাকষি করে এলপিসি বাদ দিতে পারে। কোম্পানির সারা বছরের রেকর্ড ভালো হলে এসবিসি ক্লজটি যুক্ত করে না। প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের পুনর্বীমাতেও এলপিসি যুক্ত করেনি সাধারণ বীমা করপোরেশন।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডিকে বলেন, লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বলবত রয়েছে। এলপিসি না থাকলে কোম্পানিগুলো খারাপ ব্যবসা নিবে। এতে এসবিসি ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পুনর্বীমার শতভাগ চুক্তির যে স্পিরিট তা এই ক্লজে ব্যাহত হচ্ছে কি-না  এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না। কারণ, গ্রাহক যদি ক্লেইম করে, তাহলে এসবিসি এবং বীমা কোম্পানি ভাগাভাগি করে দাবি পূরণ করবে। তাই শতভাগ রিস্ক নেয়ার বিষয়টি পূরণ হয়ে যায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তবে এ বিষয়ে বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লস ভাগাভাগির বিষয়টি শতভাগ পূর্ণ হলেও পুনর্বীমার শর্ত শতভাগ পূর্ণ হয় না। তারা আরও বলেন, লস ভাগাভাগিতে বড় কোন অংক কোম্পানির পক্ষে পড়লে তা পরিশোধ করার সক্ষমতা তাদের নাও থাকতে পারে।অন্যদিকে খারাপ ব্যবসা ও ভালো ব্যবসার শ্রেণীকরণ করা হলে খারাপ ব্যবসা কে করবে এ প্রশ্নও তুলেছেন বীমা সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দেশে নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ছিল ১৬টি। পরবর্তীতে ২০০০ সাল পর্যন্ত আরো ৮টি কোম্পানি অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি বীমা কোম্পানি অনুমোদ দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে আরো ২টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হয়। বর্তমানে মোট ৪৫টি বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে।