বিনিয়োগ নেই ৩৮টিতে, কমেছে ৫টিতে

আরেফিন ফয়সাল: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহ নেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। অন্যান্য খাতের কোম্পানিতে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও বীমা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমছে।

বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়া এবং আর্থিক ভিত দুর্বল হওয়ার কারণে এ খাতের শেয়ারের প্রতি তাদের আগ্রহ কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন কোম্পানিতে যদি বিদেশিদের অংশগ্রহণ কমে যায় তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তারা আস্থা রাখতে পারছে না। বিনিয়োগের পূর্বে তারা অনেক হিসাব নিকাশ ও গবেষণা করে থাকে। বিদেশিরা সেই কোম্পানিতে বেশি বিনিয়োগ করে যেখানে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং যাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলোনামূলক ভালো।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানি রয়েছে ৪৭টি। এর মধ্যে গত বছরে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১০টি কোম্পানিতে। চলতি বছরে আরো একটি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া হয়েছে। বাকি ৩৮টি কোম্পানিতে কোনো বিনিয়োগ নেই বিদেশিদের।

সার্বিক পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯ শতাংশ। তবে বীমাখাতের ৯ কোম্পানিতে তাদের বিনিয়োগ আছে মাত্র ০.২৭ শতাংশ। বর্তমান বাজার দরে এর পরিমাণ ১১০ কোটি ৮৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। তিনটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ আগের অবস্থানে থাকলেও পাঁচটিতেই বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ডিএসইর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২টি খাতের ৫৬৪টি কোম্পানির মোট শেয়ারে বিদেশি লেনদেনের পরিমাণ ৮৩২ কোটি ৭৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, যা সার্বিক বাজারের ৮.৯১ শতাংশ। একই সময়ে সার্বিক বাজারে মোট লেনদেনের পরিমাণ ৯ হাজার ৩৫১ কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই ১৪ দিনে বিদেশিদের লেনদেন ছিল সার্বিক বাজারের ৮.৯১ শতাংশ।

গত বছরের ডিসেম্বরে বীমাখাতের ৪৭টি কোম্পানির মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৯টি তে। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই বিদেশি বিনিয়োগ শূন্যতে নেমে আসে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। এরপর গত ৩১ জুলাই ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কিছু শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিদেশিরা। সব মিলিয়ে ৯ এর কোটাতেই আটকে রয়েছে বিদেশিদের বিনিয়োগ।

 

বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিদেশিদের সব থেকে বেশি বিনিয়োগ আছে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিদেশিদের হাতে আছে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। বর্তমান বাজার দরে এ শেয়ারগুলোর মোট মূল্য ৪৩ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার টাকা।

এর পরেই রয়েছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ২ দশমিক ৩১ শতাংশ বা ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৮টি রয়েছে বিদেশিদের কাছে। যার বাজার মূল্য ৯ কোটি ৭৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। তবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির কোন শেয়ারই বিদেশিদের হাতে ছিল না।

চলতি বছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। গত বছর এ কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ০.৫১ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্টে এসে তা আরো কমে দাড়ায় ০.১৮ শতাংশে। বর্তমান বাজার দরে বাংলাদেশ ন্যাশনালে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ১৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

এছাড়া ঢাকা ইন্স্যুরেন্সে গত বছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ০.১৮ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্টে তা আরো কমে দাড়ায় ০.১৬ শতাংশে। বাজার দারে যার মূল্য ১৫ লাখ ২১ হাজার টাকা।

প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে গত বছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ০.১৬ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্টে তা কমে দাড়ায় ০.০৯ শতাংশে। বাজার দরে যার পরিমাণ ১৫ লাখ ২২ হাজার টাকা।

তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে গত বছরে বিনিয়োগ ছিল ০.২১ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্ট শেষে তা কমে দাঁড়ায় ০.১১ শতাংশে। বাজার দরে যার মূল্য ৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে গত বছরে বিদেশিদের বিনিয়োগ পরিমাণ ১.৩৭ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১.৩৭ শতাংশ। বাজার দরে যা ১ কোটি ৬২ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তে ০.৩২ শতাংশ, যা ৩১ জুলাইয়ে এসে ০.০০ শতাংশে নেমে আসে। এরপর ওই কোম্পানিতে আর বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়নি।

আর বিদেশিদের কাছে শেয়ার থাকা বাকি দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পপুলার লাইফে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ৯২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। আগষ্ট শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের দশমিক ২১ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে। ২০১৬ সাল শেষেও বিদেশিদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির একই পরিমাণ শেয়ার ছিল।

কর্নফুলি ইন্স্যুরেন্সে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের দশমিক শূন্য তিন শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে। ২০১৬ সাল শেষেও একই পরিমাণ বিদেশি শেয়ার ছিল কোম্পানিটিতে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদেশিরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করে। যে কোম্পানি থেকে ভালো রিটার্ণ পাওয়া যাবে, তারা সাধারণত সেই কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করে।

বীমাখাতে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে আসার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ার বাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বিদেশিদের যে অংশগ্রহণ তার পরিমাণটা আসলে খুব বেশি না। মাত্র ৮ শতাংশের মতো। এক্ষেত্রে কোন কোম্পানি বা খাত থেকে যদি তাদের অংশগ্রহণ কমে যায় তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতি তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন।

তিনি আরো বলেন, বিদেশিরা আমাদের মতোই বিনিয়োগ বা লেনদেন করে থাকে। তবে তারা কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগের পূর্বে অনেক হিসাব নিকাশ ও গবেষণা করে থাকে। এ কারণে দেখা যায় আমাদের তুলনায় তারা বেশি লাভবান হচ্ছে। তারা সেই সকল কোম্পানি বা খাতে বেশি বিনিয়োগ করে যেখানে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং যাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলনামূলক ভালো।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, বীম খাতের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ভালো রিটার্ণ পাওয়া যায় না, এমন আশঙ্কা থেকেই হয় তো বিদেশিরা বীমা খাতের কোম্পানিতে খুব একটা বিনিয়োগ করে না। তাছাড়া বীমা খাতে বেশ বিশৃঙ্খল। এ খাতের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও সেটি খুব একটা কার্যকর না। ফলে বীমা কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্রোকারেজ ও সিকিউরিটি হাউসে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সকলের বক্তব্য প্রায় একই। তারা বলেন, একসময়ে সরকারি শেয়ারের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি ছিল। এখন সেই প্রবণতা কমে গেছে। তারা এখন বহুজাতিক কোম্পানির দিকে বেশি ঝুঁকছেন। পাশাপাশি স্থানীয় কিছু ব্ল-চিপ কোম্পানি এবং ব্যাংক খাতের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। সাধারণত তারা যেখানে বেশি লভ্যাংশ পাবার সম্ভাবনা দেখেন সেখানেই বিনিয়োগ করেন।

ডিএসইর কয়েকজন নিয়মিত বিনিয়োগকারী জানান, বীমাখাতের অনেক কোম্পানিই ঠিকমতো লভ্যাংশ দেয় না। আর যে কোম্পানিগুলো দেয় তাদের লভ্যাংশের পরিমাণও খুব সামান্য। ইদানিং দেখা যাচ্ছে বীমাখাতের অনেক কোম্পানিই বোনাস শেয়ার নির্ভর হয়ে পড়েছে। আর যে কোম্পানিগুলো প্রতি বছর শুধু বোনাস শেয়ার দিতে থাকে, তাদের নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এ কারণে হয়তো বীমাখাতে বিদেশি বিনিয়োগের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে ।