ক্ষুদ্রবীমাকে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে আনতে হবে: জামাল এমএ নাসের

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে বিশেষ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বীমা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। বিশেষ আয়োজনের এ পর্বে থাকছে ক্ষুদ্রবীমার ওপর মূখ্য নির্বাহীদের অভিমত। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামাল এম এ নাসের’র এই অভিমত নিয়েছেন আবদুর রহমান। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য অভিমতটি তুলে ধরা হলো:

ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামাল এম এ নাসের বলেন, সুবিধা বঞ্চিত অল্প আয়ের মানুষদেরকে ঝুঁকির আওতায় এনে বীমা করানোর জন্যই ক্ষুদ্রবীমা। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ডেল্টা লাইফে গৃহ সঞ্চয় বীমা নামে ক্ষুদ্রবীমার জন্ম। তারও আগে স্মল সেভিংস ইন্স্যুরেন্স স্কীম নামে সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে প্রিমিয়াম ধার্য করে প্রথম বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার পরীক্ষা চালানো হয়। গৃহসঞ্চয় বীমার পরবর্তী নাম হয় গ্রামীণ বীমা। গণবীমা ১৯৯৩ সালে চালু হয়। বর্তমানে সেটাকে সমন্বয় করে ডেল্টা লাইফ গণ গ্রামীণ বীমা নামে চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্রবীমা লাভ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কারণ হাই ল্যাপসেশন দেখা যায়। তবে আইডিআরএ যে কমিশন স্ট্রাকচার দিয়েছে সেটা কম্পিউটারাইজড করে প্রতিটা পলিসির বিল কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রদান করতে পারলে ক্ষুদ্রবীমা টিকে থাকবে। অর্থাৎ কমিশনগুলো ম্যানুয়ালি না করে কম্পিউটার থেকে তাৎক্ষণিক বিলগুলো দেয়া হয় তাহলে একটা পলিসির অস্তিত্ব সাথে সাথে টের পাবে।  কম্পিউটার ডাটাবেজে পলিসিটা ঢুকে যাবে। অর্থাৎ গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দেয়ার সাথে সাথে ফিডব্যাক পাবে। গ্রাহকের সকল তথ্যের সঙ্গে যদি মোবাইল নম্বরটাও কম্পিউটারে নিয়ে নেয়া যায়। তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে ওই পলিসির তথ্য বিশ্লেষণ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে ডেফার্ড অথবা রিনিউয়াল সংগ্রহে সহজ হবে। মূলকথা হলো ক্ষুদ্রবীমাকে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে নিয়ে আসা।

ক্ষুদ্রবীমা আমার হাত দিয়েই বাংলাদেশে এসেছে এমন মন্তব্য করে জামাল এম এ নাসের বলেন, ডেল্টা লাইফ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আমি শাফায়াত আহমেদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছি। আমি তার অ্যাসোসিয়েট ছিলাম। বলতে পারেন, ক্ষুদ্রবীমাটা আমার হাত দিয়েই বাংলাদেশে এসেছে। তার সহযোগি হিসেবে আমাকে দিয়েই কাজ করিয়েছেন।

তিনি বলেন, ক্ষুদ্রবীমার কালেক্টরদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সঠিক তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।  চেইন অব কমান্ডের ভিত্তিতে এই তদারকি করতে হবে।  সত্যিকার অর্থে বর্তমানে প্রিমিয়াম সংগ্রহ ও কোম্পানিতে জমা দেয়ার মাঝে বড় ধরণের গ্যাপ পাওয়া যায়। এটা কমাতে হলে কম্পিউটারের মাধ্যেমে নিশ্চিত করতে হবে কত টাকা পিআর আসলো আর কতটাকা জমা হলো। বর্তমানে এটা খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার ভবিষ্যৎ উজ্বল। অর্থাৎ গ্রাহকের তথ্য সঠিকভাবে সংগৃহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে।

ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক বাড়ানোর ব্যাপারে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী বলেন, এসব সমস্যা দূর করার পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। শ্রদ্ধাভক্তি আনতে হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবাহে বীমার যে অতুলনীয় ভূমিকা আছে সেটা কর্মী ও গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরতে হবে। আর সাংগঠনিক কর্মী হিসেবে যারা কাজ করছে তাদের প্রাপ্তি অর্থাৎ কমিশন-ভাতা ইত্যাদি সঠিক সময়ে প্রদান করতে হবে। এগুলো করার জন্য উপযুক্ত কম্পিউটার সিস্টেম থাকা জরুরি। যা বর্তমানে আইডিআরএ’র মূখ্য চাহিদার মধ্যে একটি। এছাড়া কালেক্টরদের প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ পলিসি বিক্রি করতে হবে। যাতে তাদের মাসে অন্তত দশ হাজার টাকা কমিশন আসে। প্রথম বর্ষের পাশাপাশি রিনিউ বাড়াতে হবে। কোন পলিসি ল্যাপস হলে নতুন পলিসি বাড়াতে হবে। যাতে তাদের আয় নিশ্চিত হয়।

তিনি বলেন, গ্রাহককে মুনাফা দিতে না পারার কারণ হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি থাকলে। অর্থাৎ কত টাকার জন্য কত টাকা ব্যয় করতে হবে তার সঠিক নিয়ম-নীতি যদি না থাকে। সেক্ষেত্রে অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে বাস্তব ব্যয় বেশি হয়ে যায়। এটা বন্ধ করতে হলে প্রথম বর্ষের পলিসি বাড়াতে হবে। পাশপাশি রিনিউয়ালের জন্য আইটি’র মাধ্যমে এমনভাবে তথ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে যাতে ল্যাপস পলিসি এবং ইন ফোর্স পলিসির তথ্য যেন তাদের হাতে তুলে দেয়া যায়। অর্থাৎ কালেক্টর থেকে শুরু করে পুরো সাংগঠনিক কাঠামোকে পলিসিগুলোর প্রিমিয়াম তুলে আনার জন্য চাপ দেয়া।

এছাড়া ক্ষুদ্রবীমার সাংগঠনিক কাঠামো ও ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্টে যারা আছে প্রতিমাসে তাদের আয় ও ব্যয় বিশ্লেষণ করতে হবে। যদিও ক্ষুদ্রবীমার হিসাব মাসেরটা মাসে করা দূঢ়হ। তবু, প্রয়োজনে এক মাস পিছের খরচ বা আয়কে সামনে রেখে পরবর্তী বা বর্তমান মাসের পর্যালোচনা করে বেতন-বোনাস দিতে হবে। এই কাজগুলো করার জন্য উপযুক্ত মোটিভেশন ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ লাগবে। এজন্য কোম্পানিকে ওই সাংগঠনিক অফিসে সাপ্তাহিক এবং মাসিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ক্ষুদ্রবীমার ব্যবসা কমার কথা নয়।

জামাল এম এ নাসের বলেন, সামাজিক বীমার ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এটা কম নয়। বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমা বলতে বেসিক কোন পলিসি নেই। যেটা আছে সেটা এনডোমেন্ট পলিসি। মেয়াদি বীমা, মাসে মাসে প্রিমিয়াম নেয়া হয়। বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্রবীমার নমুনা আছে। এর সঙ্গে আরো অনেক ধরণের প্রোডাক্ট আছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশে যখন আইন আসবে তখন আমরা সেগুলো চালু করতে পারবো। আমরা আসলে সে রকম শিক্ষিত বা মন-মানসিকতা তৈরি করতে পারিনি এগুলো বাজারে চালু করার জন্য।

তিনি বলেন, ভারতের মতো ক্ষুদ্রবীমা আমাদের নেই। ভারতে ক্ষুদ্রবীমা কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বিক্রি করে না। এনজিও’গুলোকে তারা থার্ড পার্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নেয়। সেক্ষেত্রে তাদেরকে নিদিষ্টভাবে সুবিধা দেয়। আমাদের কোন মার্কেটিং চ্যানেল আলাদা নেই। বাংলাদেশে থার্ড পার্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের মাধ্যমে ক্ষুদ্রবীমা বিক্রি করতে পারলে ভালো ফল বয়ে আনবে। তবে সেরকম কাঠামোয় পরিচালিত হতে হবে এবং শক্তিশালী আইটি অবকাঠামো থাকতে হবে।

তিনি আরো বলেন, তথ্য প্রবাহ যে দেশের বা যে কোম্পানিতে যত বেশি থাকবে এবং সেই তথ্য প্রবাহ যদি অর্থবহ হয় তাহলে সেই দেশ ততো বেশি উন্নত হবে। বাংলাদশে এরকম কোন সিস্টেম নেই। আমরা নিজেরাই এখন প্রস্তুত নই। ভারতের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। আমাদেরকে সে অবস্থানে যেতে হলে ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে। ভুল ভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। নিজস্ব ধারণা থেকে বেরিয়ে সরকার ও আইডিআরএ’র নীতি মানতে হবে। কোম্পানির সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে।

ন্যাশনাল লাইফের সিইও জামাল এম এ নাসের বলেন, ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে বিশেষ কোন সেমিনার বা সম্মেলনে অংশ নেয়ার সুযোগ না হলেও আমি অনেক সম্মেলনে গেছি। সম্প্রতি দু’দিনের ইন্ডিয়া ইন্স্যুরেন্স সামিটে অংশ নিয়েছিলাম। সেটা অনেক উন্নতমানের একটা সেমিনার, সকল বিষয় উঠে এসেছে। সেখানে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়েই অনেক আলোচনা হয়েছে। এরকম সেমিনার খুব প্রয়োজন।

আমার একান্ত চিন্তা হলো- ক্ষুদ্রবীমাকে পুরোপুরি আইটি’র নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রতি মাসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নতুন ব্যবসা বাড়াতে হবে। তামাদি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে এসব পলিসির তথ্য সেন্ট্রাল আইটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে পারসিসটেনসি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সাপ্তাহিক বা মাসিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। যেটা ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কার্যপরিকল্পনায় অগ্রাধিকারে আছে।

প্রকাশের তারিখ- ২২ জুন, ২০১৬