বীমা গ্রাহকের সুরক্ষা জোরদারের উপায়

কাজী মো. মোরতুজা আলী:

বিশেষ কিছু ঘটনা সাপেক্ষে অর্থ পরিশোধের একটি ভবিষ্যত অঙ্গীকার ক্রয় করে একজন বীমা গ্রাহক। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছু উপায় অবলম্বন করে থাকে। যেমন- মূলধন ও সলভেন্সি নির্ধারণ বহুমুখী বিনিয়োগ বিধি, প্রণয়ন, কার্যকরি তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বাজার স্বচ্ছতার উন্নয়ন এবং বীমা গ্রাহকদের যথাযথ অভিযোগ আমলে নেয়া এবং ত্বরিৎ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা।

বিধি-বিধান তৈরি ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার উপায় জোরদারে উপযুক্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন নিয়ন্ত্রক সংস্থার। সকল বীমা প্রতিষ্ঠানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণমান হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতা। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং পুনঃপ্রশিক্ষণও প্রয়োজন। যথাযথভাবে পরিচালিত বীমাখাত শুধু গ্রাহকদের জন্য নয়, বরং সম্পূর্ণ অর্থনীতির জন্যই উপকারী।

বীমা কোম্পানিগুলোতে ব্যবসা পরিচালনার মূলনীতি ও নৈতিকতা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হয় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। বর্তমানে বীমা ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। বীমা কোম্পানির নির্বাহীদের পেশাদারী ভিত্তি, বীমা সংক্রান্ত শিক্ষা ও মার্কেটিংয়ে প্রশিক্ষণ খুব কম কোম্পানিতে যথাযথ প্রয়োগ করা হয়। একারণে বীমা ব্যবসায় অনৈতিক ছাড়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে।

বীমা গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোকে সর্ব প্রথম স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন এবং বীমা গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তিতে সকল শর্তবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে । বীমা কোম্পানিগুলো এজন্য বিক্রয় কাজে উপযুক্ত, সামর্থবান ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া ডেস্কেও দক্ষ ও নিবেদিত ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক ছাঁটাই ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রিমিয়াম হতে হবে পর্যাপ্ত কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নয়। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলো যতটুক আইনগতভাবে কমিশন দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে ততটুকুই প্রদান করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের গ্রাহকদের সময়মতো যথাযথ সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

আস্থা তৈরির উপায়:

বীমা গ্রাহক ও বীমাকারীর মধ্যে সর্বোচ্চ বিশ্বাসের ভিত্তিতে ব্যবসা হচ্ছে বীমা। উভয়ের মধ্যে বিশ্বাসের উন্নয়ন ঘটতে পারে না, যদি লাইফ বীমার ক্ষেত্রে ব্যবসা উন্নয়নের জন্য কমিশন কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর এবং নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে অনৈতিক প্রচ্ছন্ন ছাড়ের ওপর নির্ভর করা রোধ না করা যায়। কেবলমাত্র গ্রাহক কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে বীমা কোম্পানিগুলো বিশ্বাস ও আস্থার উন্নয়ন করতে পারে।

গ্রাহক কেন্দ্রীকতার (Customer centricity) মাধ্যমে গ্রাহকসেবা হচ্ছে একটি মনোভাব, একটি সংস্কৃতি ও সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের সমষ্টিগত উপায়| দ্রুততার সাথে গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তিও এরমধ্যে পড়ে। বীমা বিক্রয় কর্মীকে অবশ্যই তার সম্ভাব্য বা বর্তমান গ্রাহককে পণ্যের বৈশিষ্ট্য ও সুবিধাদী এবং এর শর্তাবলী ও বাধা-নিষেধ পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে হবে। বীমা গ্রাহকের অনুভূতিকে বুঝতে হবে এবং তাদেরকে সব সময়ই সন্তুষ্ট রাখতে হবে। একজন অসন্তুষ্ট গ্রাহকের নিকট হতে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বীমা কোম্পানি অনেক উপকৃত হতে পারে।

গ্রাহকের প্রত্যাশা পূরণের উপায়:

বীমা শিল্প মূলত একটি সেবাখাত, যেখানে পণ্যের গুণমান বৃদ্ধি ও বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য প্রাপ্তি গ্রাহকদের প্রত্যাশা। এছাড়া গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনের প্রত্যেকটা ধাপের সময়-সীমা বিধিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার গ্রাহককে সময়মতো সেবাদান নিশ্চিত করবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। সময়মতো উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করা বীমাখাতের মূল প্রতিপাদ্য। যা একটি কোম্পানির জন্য টেকসই প্রতিযোগিতার সুবিধা সৃষ্টি করে। এটি একটি প্রগাঢ় দক্ষতা, যার জন্য কোম্পানির বিভাগ ও শাখাগুলোর মধ্যে সার্বিক সমন্বয় প্রয়োজন। সময়মতো গ্রাহককে সেবাদানের জন্য কোম্পানির সবগুলো বিভাগ ও শাখা প্রধানদের জানা প্রয়োজন যে, নিজেদের একক যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে কিভাবে গ্রাহকের মূল্য (Value) সৃষ্টি হয়।

বাজারে অনেক বীমা কোম্পানি রয়েছে, যারা জানে না কোনগুলো তাদের মূল উপযুক্ততা ও দক্ষতা। সবসময় যথাসময়ে সেবাদান একটি বীমা কোম্পানির জন্য অত্যান্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতা। কোন কোম্পানি যদি এটা অর্জন করতে পারে তাহলে ওই কোম্পানি যেকোন ঝুঁকি ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। এটা অর্জনের মাধ্যমে বীমা কোম্পানি গ্রাহকের মন জয় করতে পারে, আরো বেশি গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে পারে, কোম্পানির মার্কেট শেয়ার বাড়াতে পারে এবং পরিণতিতে সকল অংশীদারদের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়।

গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জনের উপায়:

"ক্রেতা হচ্ছে রাজা"- যেকোন বিপণনে এটি বহুল পরিচিত একটি বিষয়। বীমা কোম্পানিগুলোকেও তাদের গ্রাহকদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। গ্রাহকরা যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে কোম্পানির প্রতি তারা বিশ্বাসী ও অনুগত হবে। টেকশইয়ের দৃষ্টিতে, গ্রাহক ধারণ বা বজায় রাখা লাভজনকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাহকের আস্থা অর্জন সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে যখন প্রতিযোগী কোম্পানিসমূহ আরো বেশি ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে "ব্র্যান্ড ইমেজ" গ্রাহক ধরে রাখতে সহযোগিতা করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এটা কার্যকরভাবে কাজ করে না। তা সত্ত্বেও বাজারে খ্যাতি ও গ্রাহকের আস্থা জোরদারে শক্তিশালী "ব্র্যান্ড ইমেজ" তৈরি করতে হবে।

মানসম্মত সেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহক ধরে রাখা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী নন-লাইফ বীমাখাতে গ্রাহকদের মানসম্মত সেবা প্রদানকারি হচ্ছে ব্রোকার্স বা বাণিজ্যিক প্রতিনিধিগুলো। বেশিরভাগ উন্নত দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ নন-লাইফ বীমা বিক্রি হয় পেশাদার বীমা প্রতিনিধি বা ব্রোকার্স'র মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের বীমাখাতে এখন পর্যন্ত পেশাদার ব্রোকার্স বিকশিত হয়নি। যদিও বীমা গ্রাহকদের মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার জন্য এটা অপরিহার্য।

সময়মত- সবসময়:

বীমা গ্রাহকদের কখন এবং কেন সময়মতো সেবা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে বীমা কোম্পানিগুলোকে বাজার নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। যেসব সেবা অন্যান্য সেবার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো বাছাইয়ে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। বাজার পর্যালোচনা বীমা কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন বাজারের তাদের গ্রাহকদের প্রত্যাশা চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। গ্রাহকদের প্রত্যাশা চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হলে কোম্পানির প্রত্যেক প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ডেস্ক কর্মকর্তাদের অবশ্যই জানতে হবে যে, কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়। 'সময়মত, সবসময়' সেবা প্রদান করা যায় কিভাবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ডেস্ক কর্মকর্তাদের মধ্যে চিন্তা ও ধারণা বিনিয়ম করতে হবে। পরিবর্তন যতটুকু প্রয়োজন এবং যখন প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে বীমা পলিসির শর্তাবলী ও মেন্যুয়েলগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে। এই পর্যালোচনা ত্রৈমাসিক বা ষান্মাসিক ভিত্তিতে করা যেতে পারে।

মানসম্মত সেবার উন্নয়নে করণীয়: 

বীমা হচ্ছে পরম সরল বিশ্বাসের চুক্তি| বীমা কোম্পানির দায়িত্ব হচ্ছে পলিসিতে দ্ব্যর্থহীন বা স্পষ্ট শর্ত আরোপ করা। অতএব ওয়ারেন্টিস বা নিশ্চয়তাগুলো এবং শর্তগুলো যাতে খুব ভালোভাবে বোঝা যায় সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পলিসির পাতায় যখন প্রিন্ট করে শর্তাবলী প্রকাশ (সাধারণত ইংরেজিতে) করা হয় তখন এসব শর্ত স্পষ্ট না করার বিষয়ে আইনগত দিক থেকে বীমা কোম্পানিকে দায়ী করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা কোম্পানিগুলোকে পলিসির গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী, নিশ্চয়তা ইত্যাদি সম্বলিত ছোট লিফলেট বা বুকলেট 'বাংলা'য় প্রকাশের পরামর্শ দিতে পারে। কিছু কিছু দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই বীমা গ্রাহকদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে এই প্রকৃতির লিফলেট ও বুকলেট প্রকাশ করে।

প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিতে বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের গ্রাহকদের আরো অনেক বেশি দক্ষ  ও উপযুক্ত সেবা প্রদানের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। বিক্রয়োত্তর পলিসির সেবা প্রদান করা বীমা কোম্পানিগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গ্রাহকদের দক্ষ সেবা প্রদানের জন্য বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকর্তা ও নির্বাহীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোতে পাঠাতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বীমাখাতে আরো দক্ষ ও কার্যকরভাবে সেবা প্রদানের জন্য বেসরকারিখাতে একটি নিবেদিত আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন।

বিভিন্ন ধরণের বীমা পলিসির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সাধারণ গ্রাহকরা বিচার করতে পারে না। একারণে সকল পেশাদার বীমা প্রতিনিধি, তথা সফল ফিনান্সিয়াল অ্যাসোসিয়েট তৈরি করতে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। যাতে তারা নিজেদের পেশাদার "আচরণ বিধি" প্রণয়ন ও উন্নয়ন করতে পারে এবং গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারে। কর্মকর্তা, নির্বাহী, প্রতিনিধি, জরিপকারি, ক্ষতি সমন্বয়কারি ইত্যাদিতে প্রবেশের জন্য সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা উন্নত করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রশিক্ষণ/ ডিপ্লোমা/ উচ্চতর পেশাদার ডিগ্রি অর্জন বাধ্যতামূলক করা দরকার। সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ শুধুমাত্র বীমা প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে। সকল স্তরের এজেন্ট নিয়োগকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বীমাখাতের উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য দক্ষ ও প্রযুক্তিগত তত্ত্বাবধান একটি অপরিহার্য শর্ত। সুতরাং স্বচ্ছ ও দক্ষ তত্ত্বাবধানের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিগত জনবল এবং সরঞ্জামাদি থাকা প্রয়োজন। 'ইন্স্যুরেন্স ইয়ার বুক' প্রকাশ একটি আলোচিত বিষয়। যদি এটা প্রকাশ করা হয় তাহলে শুধুমাত্র বীমাখাতকে উজ্জ্বল করবে না, বরং এ খাত সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করবে এবং তাদের আস্থাকে জোরদার করবে।