বীমা চুক্তির প্রকারভেদ

কে এম জাহিদ উদ্দীন। পড়ালেখা করেছেন দেশের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ্যাসোসিয়েট কাস্টমার সার্ভিস (অনার্স)- এ ডিস্টিংশনসহ ডিগ্রি এবং এফএলএমআই ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বিভিন্ন দেশে তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন। এখন আছেন বীমা পেশায়। “বীমানীতি, গ্রাহক সেবা, বৈজ্ঞানিক বিক্রয় পদ্ধতি ও বিক্রয় পেশায় সাফল্য: থিওরী এন্ড প্র্যাকটিস” নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। ২০১৪ সালে বইটি প্রকাশ করা হয়। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে কে এম জাহিদ উদ্দীনের এই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো। আজ থাকছে- চুক্তির প্রকারভেদ (Types of Contract) ।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে প্রথাগতভাবে হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসিগুলো কন্ট্রাক্ট অব ইনডেমনিটি (Contracts of Indemnity) এবং জীবন বীমা পলিসিগুলো হলো ভ্যালুড কন্ট্রাক্টস (Valued Contracts) । জীবন বীমা চুক্তিগুলো মূলত ইনফরমাল কন্ট্রাক্টস এর (Informal Contracts) পর্যায়ভুক্ত। এছাড়া চুক্তিগুলোকে অন্যান্য দৃষ্টিকোন থেকেও বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। যেমন-

দ্বিপাক্ষিক এবং এক পাক্ষিক চুক্তি (Bilateral & Unilateral Contracts)

দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত কোন চুক্তি মূলত এক পাক্ষিকও হতে পারে আবার দ্বি-পাক্ষিকও হতে পারে। এ ধরণের চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলি মূলত তাদের প্রতিশ্রুতিগুলোকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করে। দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ উভয় পক্ষ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কতগুলো প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয় যা আবার আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য হয়ে থাকে। যেমন, মিসেস মাহমুদা হুদা অপর একটি কোম্পানি মৌরশী ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে তার বাসার একটি এয়ারকন্ডিশন সিস্টেম স্থাপনের জন্য পরস্পরের সম্মতিতে একটি দাম স্থির পূর্বক চুক্তিবদ্ধ হলেন। মৌরশী সুচারুরূপে কাজটি করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্য দিকে মাহমুদা হুদা ঐ কাজের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মৌরশী বা মাহমুদা হুদা দই পক্ষের যে কোন এক পক্ষ যদি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয় তা হলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। এ কারণে চুক্তিটি আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে কোন কোন চুক্তিতে একটি মাত্র পক্ষ আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য প্রতিশ্রুতিসমূহ প্রদান করে থাকে।

এক পক্ষীয় চুক্তি বলতে এমন একটি চুক্তিকে বুঝায় যেখানে চুক্তি সম্পাদনের সময় একটি মাত্র পক্ষ আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য প্রতিশ্রুতিসমূহ অন্য পক্ষকে প্রদান করে। বীমা কোম্পানিগুলো প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বীমা কভারেজ প্রদান করে। প্রিমিয়াম প্রদান যতদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বীমা কোম্পানি তার কন্ট্রাকচ্যুয়াল প্রতিশ্রুতি পালনে ততদিন পর্যন্ত আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। অন্যদিকে বীমা গ্রহীতা প্রিমিয়াম প্রদানের জন্য বীমা কোম্পানিকে কোন প্রতিশ্রুতি প্রদান করে না এবং সে প্রিমিয়াম প্রদানের জন্য আইনগতভাবেও বাধ্য নয়। প্রিমিয়াম প্রদান বন্ধ করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা একজন পলিসিওনারের রয়েছে এবং তিনি যে কোন সময় প্রিমিয়াম প্রদান বন্ধ করে পলিসিটি বাতিল করতে পারেন।

নিম্নের ছকটি প্রণিধানযোগ্য:

ক্যামুটেটিভ এবং এ্যলিয়েটরি চুক্তি (Commutative & Aleatory Contract)

চুক্তি সম্পাদনের পূর্বেই কি কি প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে সেগুল সুনির্দিষ্টভাবে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় উল্লেখ করে থাকে। ক্যামুটেটিভ চুক্তি বলতে এমন একটি চুক্তিকে বুঝায় যেখানে চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো পরস্পরের মধ্যে যে মূল্যগুলো (Values) বিনিময় করবেন তা পূর্ব থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে। তারা ঐ সকল দ্রব্য বা সেবাগুলোকে পরস্পর বিনিময় করবে যেগুলো তারা মনে করে সমমূল্য মানের। এখানে মাহমুদা হুদা এবং মৌরশী উভয় পক্ষই মনে করেন এসি স্থাপন এবং তার জন্য যে টাকা প্রদান এ দু'টোই সমমূল্যমানের। যে কোন সেবা বা দ্রব্য বিক্রয়ের চুক্তিগুলো সাধারণত ক্যামুটেটিভ চুক্তিভুক্ত হয়ে থাকে।

এ্যলিয়েটরি কন্ট্রাক্ট বলতে এমন একটি চুক্তিকে বুঝায় যেখানে এক পক্ষ অপর পক্ষের প্রদত্ত শর্তসাপেক্ষ প্রতিশ্রুতির (Conditional Propose) বিনিময়ে এমন সব প্রতিশ্রুতি প্রদান করে সেগুলোর যথেষ্ট মূল্য (Value) বা দাম রয়েছে। শর্তযুক্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি কোন সুনিদিষ্ট এবং অনিশ্চিত ঘটনা ঘটে যায় তা হলে কেবল বিশেষভাবে বর্ণিত প্রতিশ্রুতটি পূরণ করা হবে বলে ঐ পক্ষকে আশ্বস্ত করা হয়। যদি ঐ ঘটনা বা ঘটনাসমূহ সংগঠিত না হয় তা হলে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে না। এ ছাড়া এ্যলিয়েটরি কন্ট্রাক্টের মধ্যে এক পক্ষ অন্য পক্ষের চাইতে বেশি মূল্য মানের কিছু পেয়ে থাকেন। জীবন বীমা পলিসি মূলত এ্যলিয়েটরি কন্ট্রাক্ট। জীবন বীমা পলিসিতে বীমাকৃত ব্যক্তির পলিসি বেনিফিটগুলো পূর্ব থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত থাকে। এ ক্ষেত্রে পলিসি বলবৎ থাকাকালীন যদি বীমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তাহলেই কেবল তিনি পলিসিতে বর্ণিত মৃত্যু বেনিফিট পাবেন।

অন্যদিকে বীমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে যদি প্রিমিয়াম প্রদান না করার জন্য পলিসিটি বাতিল হয়ে যায় বীমাকৃত ব্যক্তি কোন বেনিফিটই পাবেন না। যদিও তিনি প্রাথমিক প্রিমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি নবায়ন প্রিমিয়াম কোম্পানিতে জমা দিয়েছেন। এখানে মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু কোনো ব্যক্তিই বলতে পারবে না ঠিক কোন সময়ে মৃত্যুটি সংঘটিত হবে। তাই মৃত্যুর সময়টা একটি অনশ্চিত ঘটনা। অন্যদিকে পলিসি বলবৎ হবার অব্যবহিত পরেও মৃত্যু হতে পারে।  সে ক্ষেত্রে বীমাকৃত ব্যক্তি সম্পূর্ণ মৃত্যু বেনিফিটই পাবেন। এ ক্ষেত্রে বীমাকৃত ব্যক্তির প্রদত্ত প্রিমিয়ামের তুলনায় নমিনি অনেক বেশি বেনিফিট বোগ করে থাকেন।

বার্গেইন কন্ট্রাক্ট এবং কন্ট্রাক্ট অব এডিসন (Bargain Contracts & Contracts of Adhesion)

এমন অনেক চুক্তিই রয়েছে সেগুলো মূলত চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর দর কষাকষিরই (Bargain) ফসল। এখানে চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো নিজ নিজ শর্তগুলো উপস্থাপন করে এবং দীর্ঘ আলাপ আলোচনা এবং দর কষাকষির পর সাধারণত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এখানে উভয় পক্ষই সাধারণত সম-মর্যাদার হয়ে থাকে। অধিকাংশ ব্যবসায়িক চুক্তিই বার্গেইন কন্ট্রাক্ট হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করতে অনেক সময় ব্যয় হয়। বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষিও হয়। বহু ধরণের শর্ত ও শর্তাবলী এ ধরণের চুক্তিতে সন্নিবেশিত হয়।

অন্যদিকে জীবন বীমা চুক্তিগুলো সাধারণত কন্ট্রাক্ট অব এডিশন হয়ে থাকে। কন্ট্রাক্ট অব এডিশন হলো এমন একটি চুক্তি যেটা এককভাবে একপক্ষই তৈরি করে এবং অপর পক্ষ হয় সম্পূর্ণ চুক্তিটি অখণ্ডভাবে গ্রহণ করবে অথবা বর্জন করবে। এখানে দর কষাকষির কোন সুযোগ নাই। জীবন বীমা পলিসির আবেদনকারীদের বীমা চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে কোন পছন্দ বা অপছন্দ বলে কিছু নাই। উদাহরণসরূপ বলা যায়, জীবন বীমা পলিসির জন্য আবেদনকারী বীমা পলিসির অভিহিত মূল্য (Face Value) ও বিভিন্ন অভিহিত মূল্যের বিভিন্ন প্রিমিয়াম রেট ইত্যাদি সম্পর্কে কোন ব্যক্তিগত বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে না। বীমা কোম্পানিগেুলো বীমা চুক্তি স্বয়ং নিজেরাই তৈরি করে এবং আবেদনকারী শুধু চুক্তিটি অখণ্ডভাবে গ্রহণ অথবা বর্জন করতে পারে। যেহেতু কন্ট্রাক্ট অব এডিসনে শুধুমাত্র একটি পক্ষই চুক্তিটি তৈরি করে এবং ঐ একটি পক্ষই বিভিন্ন শর্তাবলী সংযুক্ত করেন সেহেতু চুক্তির কোন ধারা যদি দুর্বোধ্য হয় তাহলে চুক্তিটির ব্যাখ্যা সব সময় অপর পক্ষের অনুকূলে হবে। বীমা পলিসি চুক্তি যেহেতু কন্টাক্ট অব এডিসন তাই এর কোন ধারা বা উপ-ধারা অস্পষ্ট হলে তার ব্যাখ্যা সব সময়ই পলিসিওনারের অনুকূলে হয়ে থাকে। নিম্নের ছকের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন কন্ট্রাক্ট তুলে ধরা হলো এবং বীমা চুক্তিটি কোন চুক্তির পর্যায়ে পড়ে তাও দেখানো হয়েছে।