কোভিড-১৯ মহামারী: বীমা শিল্পে প্রভাব ও আমাদের করণীয়

মোহাম্মদ হানিফ, এবিআইএ: আমরা আধুনিক সময়ের অন্যতম সেরা সামাজিক পরীক্ষার মধ্যে আছি। এটি অভূতপূর্ব সময় এবং সম্ভবত আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিগুলো এই মহামারীর ফলস্বরূপ স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হবে। ঝুঁকি পুলিং, ঝুঁকি ভাগাভাগি এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ এবং সঞ্চয়ীতে অ্যাক্সেসের মাধ্যমে ব্যক্তি ও ব্যবসায়কে আরও বেশি সুনিশ্চিতকরণে বীমা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার ফলস্বরূপ উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে পারে। এই ভূমিকাটি আগের তুলনায় আরও দৃশ্যমান ও গুরুত্বপূর্ণ এবং বীমা শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি হবে আরো দৃঢ়।

কোভিড-১৯ মহামারীটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছে এবং কোটি কোটি ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলেছে। সংকটটি মহামারী এবং অর্থনৈতিক আগাতের চেয়ে বীমা শিল্পকে সর্বজনীন ও দ্রুতগতিতে আঘাত করছে। ব্যয় হার ক্রমবর্ধমান সংকট পরিচালনার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ প্রিমিয়াম সংগ্রহে ভাটা পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হওয়ার কারণে আয় কমে গেছে, ফলে নতুন বীমা করতে অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহের হারও একেবারেই নিম্নমুখী। মোটর বীমাগুোতে নতুন ব্যবসা হ্রাস পাচ্ছে কারণ সামাজিক দূরত্বের কারণে লোকেরা গাড়ি চালাচ্ছেন না। আর্থিক বাজারে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগের রিটার্নও চাপে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ফলে বীমাকারীর ক্ষতি হচ্ছে পাশাপাশি বাজার মূলধনও হ্রাস পাচ্ছে।

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস মহামারী বিভিন্নভাবে বীমা সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করছে। গ্রাহক, জনগণ এবং অপারেশনাল বিবেচনার পাশাপাশি বিনিয়োগের র্পোটফোলিওগুলোকে প্রভাবিত করেছে। শেয়ার বাজারের মূল্য হ্রাস পেয়েছে এবং অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলিও নিম্নমুখী। এটি বীমাকারীদের ব্যালেন্স শিট এবং মূলধনের অনুপাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে- উদাহরণসরূপ- প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত সময়সীমা, মহামারীর সময় বীমা কভারেজ বাতিল না করা এবং বিভিন্ন ধরণের ফি মওকুফ করা। এই কার্যগুলো প্রিমিয়ামের নগদ প্রবাহ, দাবির ফ্রিকোয়েন্সি বা তীব্রতা সম্পর্কিত অনুমানগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রদেয় দাবিগুলো প্রদানের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কর্তৃক চাপ তৈরি হতে পারে। ফলস্বরূপ কিছু বাস্তব সমস্যা তৈরি হতে পারে।

এ সময়ে পলিসিধারীগণের প্রতি যত্মবান হতে হবে, কারণ অল্প প্রিমিয়াম প্রদানকারী গ্রাহকগণ এ সময়ে পলিসি সমর্পণ করতে পারে। তাই বাধ্যবাধকতাগুলি নির্ধারণ করে, বীমাগ্রহীতাদের কভারেজের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ এবং কভারেজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং সীমাবদ্ধতার প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে। এই জন্য নতুন নির্দেশিকা, আইন ও বিধিবিধানগুলোর মূল্যায়ন করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। বীমা চুক্তিতে বিদ্যমান শর্তাদি এবং শর্তাদি আবশ্যক ছাড়াও কোভিড-১৯ সম্পর্কিত ইভেন্টগুলোর জন্য কভারেজ সরবরাহ করার প্রয়োজন হতে পারে।

মহামারী সংক্রমণকে কমিয়ে দেয়ার জন্য সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া ব্যবস্থাগুলো বীমা বিক্রয় ক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করতে পারে এবং তা প্রিমিয়াম আয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ক্রেডিট বীমা, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বীমা, স্বাস্থ্য বীমা বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। জীবন বীমা প্রদানকারীরা উল্লেখযোগ্য প্রভাবের মুখোমুখি হতে পারে। সুদের হার হ্রাস, আর্থিক বাজারে মন্দা হতাশার কারণ হতে পারে। যে বীমা পণ্যগুলো বাজার অর্থনীতির সাথে পরিবর্তনশীল সেই বীমাপণ্যগুলো বিক্রয়ে অধিক যত্মবান হতে হবে। এ সময়ে বীমা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো সর্তক হতে হবে। কিছু বীমাকারীর জন্য, সম্ভাব্য চলমান উদ্বেগ সম্পর্কিত বিষয়ে আরও সর্তকতার প্রয়োজন হতে পারে।।

 

এখন কি করতে হবে:

- বীমাকারীরা পরবর্তী তিন থেকে ছয় মাস ধরে অগ্রগতি অব্যাহত রাখার প্রতি সচেষ্ট হবার সাথে সাথে তারা সামগ্রিক বিষয়টি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবে;

- ডিজিটাল কর্মচারী এবং গ্রাহক তৈরি করতে হবে;

- শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা সমর্থন করার জন্য অভ্যন্তরীণ এইচআর কোভিড-১৯ কোয়েরি প্রতিক্রিয়া সচল করতে হবে;

- মানুষ ও মেশিন এই মানসিকতার সাথে গ্রাহকের মান পরিচালনা, তৎপরতা এবং কর্মশক্তি অটোমেশন/অপ্টিমাইজেশন সম্পর্কিত কর্মশক্তি এবং এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো রিফোকাস করতে হবে;

- কর্মচারী এবং গ্রাহকদের সাথে বীমা কোম্পানির আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে;

- গ্রাহকদের সাথে ডিজিটাল যোগাযোগ জোরদার করতে হবে;

- দাবি প্রক্রিয়াজাতকরণে ডিজিটালাইজ করতে হবে;

- ডিজিটালভাবে সক্ষম থেকে বাজার মডেল চালু করতে হবে;

- নতুন কিছু করতে কিংবা পুনরুদ্ধার করতে ব্যয় হ্রাস ফোকাস করতে হবে;

- অভ্যন্তরীণ এবং তৃতীয় পক্ষের ব্যয় বিশ্লেষণ, অগ্রাধিকার এবং সামঞ্জস্য করতে হবে;

- ক্লাউড-ভিত্তিক কর্মশক্তি বিশ্লেষণ করতে হবে;

- নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে স্বল্প-ব্যয়, উচ্চ-ব্যয় বিশ্লেষণ ব্যবহার করতে হবে;

 

পরবর্তীতে কি করতে হবে:

বীমাকারীরা কোভিড-১৯ মহামারী তাৎক্ষণিক প্রভাবগুলো কাটিয়ে ও পোস্ট-ডিজিটাল বিশ্বে তাদের স্থান গ্রহণ করার কারণে তারা আরও সুযোগগুলো দেখতে পাবে:

- খরচের বক্ররেখায় পরিবর্তন আনতে হবে;

- চৌকস বিতরণ ফ্রেমওয়ার্কগুলির সাথে শুন্য-ভিত্তিক ডিজাইন পদ্ধতিগুলো একত্রিত করতে হবে;

- বিদ্যমান অপারেশগুলো সহজিকরণ এবং প্রযুক্তি আধুনিকীকরণ করতে হবে;

- ব্যবসায় এবং প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমানভাবে প্রান্তিকরণ আধুনিকায়ন করতে হবে;

- পরিস্থিতি ভিত্তিক প্রবৃদ্ধির প্রতি নজর দিতে হবে;

- পণ্যগুলো বিক্রির ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে;

- ঝুঁকি অবকাঠামো প্রসারিত করতে হবে;

- শেষ থেকে শেষ সুরক্ষা করতে সক্ষম হতে হবে;

- কর্মশক্তি অনুসন্ধান করতে হবে;

- কর্মীদের জন্য দ্রুত প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং মানুষ ও মেশিন পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ম উদ্দীপনা তৈরি করতে হবে;

- বিক্রয় এবং পরিষেবার জন্য ডিজিটাল ভ্রমণের সুযোগগুলি উম্মুক্ত করতে হবে;

- ডিজিটাল পণ্য গ্রহণ এবং অনলাইন পরিষেবাগুলি চালু করতে হবে;

- অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য সিস্টেম মনিটরিং প্রতিষ্ঠা করতে হবে;

- ব্যবসায়ের ধারাবাহিকতা পরিকল্পামাফিক বৃদ্ধি করতে হবে;

 

পাশাপাশি নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয়ে উপর গুরুত্ব দিয়ে বীমা কোম্পানিগুলো এ সংকটময় সময়কে অতিক্রম করবে:

১. বীমা কোম্পানি গ্রাহকদের উপস্থিতিতে কিংবা অনুপস্থিতিতে তার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ জুড়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোম্পানীগুলোর সম্ভাব্য ঘাটতি এবং অপারেশন দক্ষতা হ্রাস পাওয়া সত্তে¡ও তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে হবে। গ্রাহক পরিষেবা এবং বিশ্বাস বজায় রাখতে গ্রাহক পরিষেবা বিভাগ সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য গ্রাহক পরিষেবা বিভাগকে বর্তমান পরিস্থিতিতে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে তার অগ্রাধিকার একটি তালিকা প্রণয়ন করে সে মোতাবেক কাজ করতে হবে। এই জন্য প্রয়োজনে পরিষেবা কর্মীদের এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. মহামারীর এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি বীমা কোম্পানী তার আর্থিক ক্ষতির হিসাব করবে এবং মহামারীর গতি এবং প্রকৃতি বোঝে বিশেষত তাদের ব্যবসায়িক বাধাগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য ক্ষতির একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে। হয়ে যাওয়া ক্ষতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য ক্ষতি কিভাবে কাটিয়ে উঠা যাবে তার জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

৩. বীমা কোম্পানী সমূহ নিজেরাই এ বিষয়ে দ্রæত পদক্ষেপ না নিলে, কোম্পানীগুলো গভীর সংকটে পড়ার আশংকা রয়েছে। তাই বাজার অর্থনিতির সম্ভাব্য উঠা-নামা লক্ষ্য করে প্রতিটি কোম্পানীকে সামগ্রিকভাবে একটি কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।

৪. ঝুঁকির প্রবণতা, সলভেন্সি মার্জিন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বর্তমানে যে পদক্ষেপ গুলো চলমান তা কতটা উপযোগী, অতীতে এ ধরণের পরিস্থিতিতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, পদক্ষেপগুলো কোম্পানীর জন্য লাভজনক ছিল কিনা? বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে ও স্বল্প মেয়াদে কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

৫. মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসায়ের পরিকল্পনার সম্ভাব্য প্রভাবকে মডেল করে মন্দার পরিস্থিতিতে নিম্নে বর্ণিত প্রশ্নগুলোর উপযুক্ত উত্তরমালা তৈরি করতে হবে-

ক. প্রতিটি ব্যবসায়িক লাইনে অর্থনীতির প্রভাবগুলো কি কি?

খ. কোখায় আপনার ঝুঁকি/ অর্থনৈতিক মন্দার এক্সপোজার কি?

গ. ব্যয় হ্রাস বা ব্যয় বৃদ্ধি কতটা যুক্তি সংগত?

ঘ. আপনার কাজের পদ্ধতিগুলি পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে কিনা?

যদিও এই সঙ্কট পরিস্থিতি স্থায়ী নয়, আশা করা যায় বীমাকারীরা এই সংকট কাটিয়ে দক্ষতার সাথে উঠে দাঁড়াবে। আমরা ইতিমধ্যে একটি শক্ত শিল্পের প্রতিক্রিয়া দেখছি। বীমাকারীরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং তাদের কর্মচারী ও অংশীদারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কৌশলগত যোগাযোগের পরিকল্পনার সাহায্যে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরো সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।