3113

03/28/2024

বীমা দাবি পরিশোধে ঘুষ চান সানলাইফের কর্মকর্তারা

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারী ২০২১

আবদুর রহমান আবির: বীমার মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে গেলে ঘুষ চান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তারা। গ্রাহক হয়রানির এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনাসহ আরো ৬টি অনিয়ম উঠে এসেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র তদন্তে। এসব অনিয়ম দূর করতে ৫টি সুপারিশও করেছে তদন্ত দল। গত ১৭ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষে দাখিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধে প্রতিটি চেক ইস্যুর জন্য ১ হাজার টাকা ঘুষ নিতেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের রংপুর জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সাথে কথা বলে এর সত্যতা পেয়েছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। জোনাল অফিসটির ইনচার্জ মালেক শাহী ও অবলিখন কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম এই ঘুষ দাবি করতেন।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৭ অনিয়ম:

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, তদন্তে উঠে আসা সানলাইফের অনিয়মগুলো হলো- দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোয় বীমা আইন ২০১০ এর বিধান মতে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা না করা। বীমা আইন ২০১০ এর ৬২ ধারা এবং লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা, ২০২০ লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়।

লাইফ ফান্ড বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০ এর ৪১ ধারা এবং লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ প্রবিধানমালা, ২০১৯ মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শাখা অফিসগুলো বন্ধ করার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’কে না জানানো এবং অনুমোদন গ্রহণ করার বিধান লঙ্ঘন।

বীমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারার বিধান সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত করা। বীমা গ্রাহকদের চেক প্রদান করে সে চেক পাস না করে নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট-১৮৮১ লঙ্ঘন। বীমা গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধে কোম্পানির জোনাল অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্বাহী রশিদ ও চেক পাশ করার নামে উৎকোচ বা ঘুষ গ্রহণ।

অনিয়ম দূর করতে তদন্ত কমিটির ৫ সুপারিশ:

সূত্রমতে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অনিয়মগুলো দূর করতে ৫টি সুপারিশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত কমিটি। সেগুলো হলো-

উত্থাপিত দাবির মধ্যে ২টি মৃত্যুদাবির টাকা ও ইতোপূর্বে ইস্যুকৃত ২২০টি চেকের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট পলিসি গ্রাহকদেরকে ২০ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখের মধ্যে এবং উত্থাপিত অবশিষ্ট ৫৫৮টি পলিসি গ্রাহকের সমস্ত দাবির টাকা বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারার বিধান অনুসারে সুদসহ আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করার নির্দেশনা প্রদান।

কোম্পানির শাখা অফিসগুলো বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে বন্ধ করার বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে নির্দেশনা প্রদান।

মাঠ পর্যায়ে কোম্পানির জোনাল অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্বাহী রশিদ ও চেক পাশ করার নামে উৎকোচ নেয়ার মৌখিক অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত পূর্বক সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সকে নির্দেশনা প্রদান।

ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে বীমা আইন ২০১০ এর ৬২ ধারা ও লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা ২০২০, লাইফ ফান্ড বিনিয়োগের বিষয়ে বীমা আইন, ২০১০ এর ৪১ ধারা ও লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ প্রবিধানমালা, ২০১৯ এবং বীমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারার বিধান যথাযথভাবে পালন না করায় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সকে সতর্ক করার পাশাপাশি কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ প্রদান।

ভবিষ্যতে যেন বীমা দাবি সংক্রান্ত কোন অভিযোগ উত্থাপিত না হয় সে দিকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি এ বিষয়ে পুনরাবৃত্তি ঘটলে বীমা আইন, ২০১০ এর বিধান মতে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সকে সতর্ক করা।

যে কারণে সানলাইফের তদন্তে আইডিআরএ:

সূত্রমতে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৭ বছরেও বীমা গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ না করায় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ অভিযোগ করেন কোম্পানিটির রংপুর বিভাগের ব্লক কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গেলো বছরের ১৪ জুলাই আইডিআরএ’কে বিষয়টি তদন্ত করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এরই প্রেক্ষিতে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় বীমা আইন ৪৮ ধারা অনুসারে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় আইডিআরএ। তদন্ত পরিচালনার জন্য গত ১২ অক্টোবর দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। কমিটির সদস্যরা হলেন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (লাইফ) মো. শাহ আলম ও জুনিয়র অফিসার মুহাম্মদ শামছুল আলম। অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামতসহ পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।

অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের জবানবন্দি গ্রহণসহ সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় ও রংপুর জোনাল শাখা পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি। প্রাথমিকভাবে তদন্তে বীমা কোম্পানিটির ৭টি অনিয়ম উঠে আসে।

সানলাইফের বিরুদ্ধে অভিযোগে যা রয়েছে:

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির গণমুখী বীমা প্রকল্পের ৭৮০টি বীমা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। নিয়ম অনুসারে মেয়াদ উত্তীর্ণের ৯০ দিনের মধ্যে বীমা টাকা পরিশোধ করার কথা। অথচ কোম্পানিটি দীর্ঘ ৭ বছরেও অনেক বীমা পলিসির টাকা পরিশোধ করেনি। এসব গ্রাহকের পাওনার পরিমাণ ৯৩ লাখ ২৮ হাজার ৮০৩ টাকা।

তবে গ্রাহকদের চাপের মুখে এবং কোম্পানিটির স্থানীয় কর্মকর্তাদের অনুরোধে দীর্ঘ দিন পর রংপুর ইসলামী ব্যাংক শাখায় ৫৬৩ বীমা গ্রাহকের নামে ৯৩ লাখ ২৮ হাজার ৮০৩ টাকার চেক ইস্যু করেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বীমা গ্রাহকরা বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খুলে বারবার যোগাযোগ করেও ব্যাংকটি থেকে কোন অর্থ উত্তোলন করতে পারেনি। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব গ্রাহক।

এ অবস্থায় ভুক্তভোগী এসব বীমা গ্রাহক সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের স্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হতে থাকেন। মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন ও অপমানের শিকার হন কোম্পানিটির রংপুর বিভাগের মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে এসব কর্মকর্তার অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। এতো কিছুর পরও অদ্যবধি বীমার টাকা পরিশোধ করেনি সানলাইফ ইন্সুরেন্স।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:

অভিযোগ ও তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান প্রফেসর রুবিনা হামিদের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনিও কল রিসিভ করেননি। কথা বলার বিষয় উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।