প্রস্তাবিত ব্যয়সীমা অযৌক্তিক, ক্ষুণ্ণ হবে গ্রাহক স্বার্থ: নিজাম উদ্দিন আহমেদ

লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমা বাড়িয়ে প্রবিধান জারি করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত প্রবিধান জনমত যাচাইয়ের জন্য ওয়েবসাইটে তুলে দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর এ প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন  উঠে বীমা অঙ্গনে। মতামত আসতে থাকে পক্ষে-বিপক্ষে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এ ধারাকে প্রবাহমান করতে বীমাখাতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মতামত নেয়ার উদ্যোগ নেয় ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি।

ভিত্তি হিসেবে জানতে চাওয়া হয়:

ক. বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে তা কতটা বাড়ানো যৌক্তিক?

খ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা না বাড়িয়ে কোম্পানি পরিচালনায় ব্যয় কমিয়ে এনে ব্যবসা পরিচালনা করলে সার্বিক দিক থেকেই মঙ্গলজনক- বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

গ. বিশেষজ্ঞদের অভিমত: ব্যয়সীমা বাড়ালে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে আরও বেশি টাকা খেয়ে ফেলার সুযোগ পাবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

ঘ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমার প্রস্তাবে ব্যয়ের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কি?

ঙ. বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ব্যবসা উন্নয়নে ব্যয়ের সীমা বাড়ানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

চ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা আরো বাড়ালে আর্থিকভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কার বিষয়ে আপনার মতামত কি?

এ বিষয়ে প্রথমে কথা বললেন মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর চেয়ারম্যান জনাব নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

** ১৯৫৮ সালের বিধিমালায় ব্যয়ের যে হার নির্ধারণ করা আছে তা থেকে বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। এর কোনো যৌক্তিকতাও নেই।

যখন এ প্রবিধানমালা করা হয় তখন বীমা কোম্পানি কম ছিল। বীমা সম্পর্কে  মানুষের সচেতনতা কম ছিল।  সব  মিলিয়ে লাইফ খাতে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যবসা হত। সে কারণে তখন  ব্যয়ের হার  বেশি ছিল।  এখন প্রিমিয়াম সংগ্রহ অনেক বেড়েছে। বছরে ৮০০  থেকে হাজার কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। ব্যয়ের বিষয়টি আসবে আনুপাতিক হারে। প্রিমিয়াম সংগ্রহ যত বেশি আসবে ব্যয় তত কমে যাবে । কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়নি। এর কারণ- একচ্যুরিয়াল প্রিন্সিপলের ভিত্তিতে কোম্পানিটি স্টার্ট হবে, কোম্পানিটি চলবে। বাংলাদেশে দু’একটা কোম্পানি ছাড়া এই প্রিন্সিপল মেনে কোম্পানির ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি, চলেওনি, এখনো তা চলছে না।  

পরিস্থিতিটা এমন যে, আমরা বিপুল লোকসংখ্যা নিয়োগ দিয়েছি। আমরা দেশব্যাপী অফিস করেছি, গাড়ি দিয়েছি, জ্বালানী খরচ দিয়েছি, আমরা এভাবেই চালায়েছি। প্রিমিয়ামের টাকা ইচ্ছে মতো খরচ করেছি।

আমরা ভেবেছি গ্রাহকের টাকা তো দিতে হবে ১০ বছর ১২ বছর বা ১৫ বছর পর। আমার রিনুয়্যাল প্রিমিময়াম তো আসছে। তাহলে আর সমস্যা কি? কিন্তু সমস্যা হয়েছে। যখন গ্রাহকের পলিসির মেয়াদ শেষ তখন আর টাকা দিতে পারছি না। ফলে এখন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । এখন হিসাব শুরু হয়েছে। আলোচনা শুরু হয়েছে যা গত ৫/ ৬ বছর আগেও ছিল না। 

এখন মেজরিটি কোম্পানির পলিসিহোল্ডাররা টাকা পাচ্ছে না। ক্লেইম হলে টাকা পাচ্ছে না। ম্যাচুউরিটির টাকার লাভও পাচ্ছে না। আজ দেখলাম যে, এমডিরা বেতন পায় না। মূলত খরচ যা করা হয়েছে তা বেহিসাবি। কোম্পানিগুলো চলছে নিয়মের বাইরে।

**প্রথমেই বলছি, লাইফ ইন্স্যুরেন্স অ্যাকচ্যুরিয়াল প্রিন্সিপল ছাড়া আমি কিছু্ই করতে পারব না। হয়তো ৫% আমি ব্যবসার স্বার্থে এদিক-ওদিক করতে পারব, অন্য কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য । কিন্তু আমি কোথায় কত বাড়ি ভাড়া দিতে পারব, কোথায় সেলারিতে খরচা করতে পারব, কমিশন কত করতে পারব, পলিসিহোল্ডারের ভবিষ্যতের জন্য কত রাখব- এইটার একটা নিয়ম আছে। কিন্তু আমি তো সেই নিয়ম মানি নাই। না মেনে আমি খরচ বেশি করে গেছি। যেহেতু আমার রিনুয়্যাল প্রিমিয়াম এসেছে, তা দিয়ে খরচ করতে করতে আমরা বেহিসাবি চলেছি।

এখানে যারা ম্যানেজমেন্টে ছিল, এমডি থেকে নিচের লেভেল- তাদেরই ব্যয় নিয়ন্ত্রণের এ দায়িত্ব ছিল । তারা যতই কোম্পানির পরিচালক, মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের দোষ দিক না,  তা দেখার বিষয় নয়।

কোম্পানির মালিকরা তাদের আরো ১০টা বিজনেস আছে, ১০টা কোম্পানি আছে। মালিকরা কোম্পানি করেছে লাভের আশায়। তারা লাভ  করবে। এখানে সৎ কি না অসৎ এ প্রশ্নটা এ ক্ষেত্রে অবান্তর। কারণ কোম্পানির ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব ম্যানেজেমেন্টের । এমডি থেকে শুরু করে যারা নিচের লেভেলে কাজ করেছে তাদের। ব্যয় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটা তাদেরই ছিল। তারা সততার সাথে কাজ না করে  বোর্ডকে দোষারোপ করলে তো হবে না। এমডি সাহেব তো বেতন নিয়েছেন ৬ লাখ ৭ লাখ টাকা।  গাড়ি ও অন্যান্য সুবিধাও নিয়েছেন। কোম্পানি পরিচালনার যোগ্যতা আছে বলেই তো তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাই কোম্পানি কিভাবে  চলবে সে দায়িত্ব তার।

তাই  আপনি যে ব্যয় বাড়ানোর কথা বলছেন তা বাড়ানো উচিত হবে না। বৃটিশ আমলে যে ব্যয়ের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল তা  ঠিক আছে। কারণ তখন ব্যবসা কম ছিল। এখন ব্যবসা ৮০০ থেকে হাজার কোটি  টাকা। তাই আনুপাতিক হারে এখন ব্যয় কমে আসবে। ৫ হাজার টাকা অফিস ভাড়া দিয়ে ১০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করলে যে ব্যয় হবে একই ভাড়ায় ২০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করলে ব্যয়ের হার কমে আসবে। তাই যে বিষয়টি করা যায় তা হলো আমার কোম্পানির নিবন্ধন ফি বাড়ানো হয়েছে,  তা কমানো যায়। এজেন্টদের উপর ৫% ইনকামট্যাক্স, তা কমানো উচিত। গ্রাহকের মুনাফার উপর ট্যাক্স ধার্য্য করা হয়েছে।

আমার মেঘনা লাইফ, এক লাখ টাকায় দেড় থেকে পৌনে ২ লাখ টাকা গ্রাহককে দিচ্ছে। গ্রাহকের এই মুনাফার উপর সরকার ট্যাক্স কাটছে। এটা উচিত না। লাইফ ইন্স্যুরেন্স জনগণের কোম্পানি, গ্রাহকের কোম্পানি। তারাই এখানে টাকা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তাই সরকার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গ্রাহকরা যেভাবে সুবিধা পাচ্ছে সে ধরণের সুবিধা চালু করলে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে লাইফ বীমা খাত ভূমিকা রাখতে পারবে।

**এখানে একটা বিষয়- লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাথে গ্রাহক স্বার্থ জড়িত। তাই পরিচালকদের গ্রাহক স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে। খরচ নিযন্ত্রণ পরিচালকদের হাতে, ম্যানেজমেন্টের হাতে। এখানে গ্রাহকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। এই সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলো ইচ্ছে মতো খরচ করবে তা হতে পারে না। তারা শুধু শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ দেখবে গ্রাহকের স্বার্থ দেখবে না, তা হতে পারে না।

ঢালাওভাবে ব্যয় বাড়ানো হলে তার মারাত্বক প্রভাব পড়বে বীমা খাতে। যে কোম্পানির এখন কম খরচ করছে তারা বেশি ব্যয় করবে। এর মিস ইউজ করবে । যারা ভালোর দিকে আসছে তারা আর ভালো হতে চাইবে না।

**লাইফ বীমা খাতে ব্যয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অযৌক্তিক। ব্যয় বাড়ানো নয় বরং ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আইডিআরএ কঠোর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। লাইফ বীমা খাতে মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের যে লেয়ার আছে তা কমিয়ে আনলে ব্যয় কমে যাবে। আমাদের দেশেই তার উদাহরণ রয়েছে। তিনটি লেয়ারেও কোম্পানির ব্যবসা করেছে। আইডিআরএ এ জায়গায় শক্ত ভূমিকা নিতে পারে। তারা লেয়ার কমিয়ে দিতে পারে। কোম্পানির ফান্ডে যে টাকা রয়েছে তা ইচ্ছেমতো ব্যয় করা হচ্ছে।

অনেক কোম্পানি জায়গা-জমি কিনতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে। যা থেকে তেমন কোনো লাভই গ্রাহক পাচ্ছে না। এতে অপচয় হচ্ছে, অনিয়ম হচ্ছে। অথচ এসব টাকা তো পলিসি হোল্ডারের। তাই এসব বিষয়ে আইডিআরএ’র কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। এতে ব্যয় কমে যাবে।

এছাড়া কোম্পানির নিবন্ধন ফি বেড়েছে, কমিশনের উপর ট্যাক্স দিতে হচ্ছে, ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এসব ব্যয় আগে ছিল না। সরকার বা আইডিআরএ এসব খাতে ব্যয় কমাতে পারে। এতে ব্যয় কমে যাবে। তাতে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করা যাবে।

বরং মনে করি ৫৮’র বিধিমালায় যে ৯০ শতাংশ রয়েছে তাই ঠিক না। আমি যদি ৭০ বা ৮০ শতাংশ করতে পারি তাহলে গ্রাহকদের বেশি মুনাফা দিতে পারব। শেয়ার হোল্ডারদের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারব। তাই  ব্যয় বাড়নো নয়, ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত।

**আমি মনে করি এতে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।

**বাজার পরিস্থিতিতে ব্যয় বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমি যত বেশি ব্যয় কমাতে পারব আমি তত বেশি গ্রাহকদের মুনাফা দিতে পারব। গ্রাহক তখন আমার কোম্পানির প্রতি আকৃষ্ট হবে। তারা আমার এখানেই পলিসি করবে। আমাদের দেশেই এর উদাহরণ আছে। মেটলাইফ সীমার চেয়ে কম ব্যয় করেছে। তারা গ্রাহকদের বেশি মুনাফা দিতে পারছে। তাই ব্যবসা করতে ব্যয় বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

তাই আমার প্রস্তাব যে ৯০ শতাংশ ব্যয়ের অনুমোদন আছে তার ভিতরে থেকেই একটা শৃংখলার মধ্যে আসা।

** গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে খরচ করে ফেললে যেসব কোম্পানির মজবুত আর্থিক ভিত্তি নেই তারা লাইফ ফান্ড গঠন করতে পারবে না, ক্লেইম পরিশোধ করতে পারবে না। ম্যাচুউরিটির টাকার লাভও দিতে পারবে না। গ্রাহকও পাবে না। ব্যবসা করবে কিভাবে?

তবে এর মধ্যে  নতুন কোম্পানি যাতে সার্ভাইব করতে পারে তার জন্য আইডিআরএ পৃথক  ব্যবস্থা নিতে পারে। নতুন কোম্পানির প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার প্রয়োজনে যদি বেশি ব্যয় করতে হয়, তা সঠিকভাবে মনিটর করতে পারে আইডিআরএ। এছাড়া ১০ বছরের নিচে যেসব কোম্পাানি আছে তাদের জন্য আইনে বেশি ব্যয়র অপশন আছেই। কোম্পানিগুলো কেন বেশি ব্যয় করল, তার যোক্তিকতা আছে  কি না, বা কি করলে নতুন একটি কোম্পানি ব্যয় কম করেও ভাল করতে পারবে, তা সার্বক্ষণিক মনিটর করে তাদের গাইড লাইন দিতে পারে। তাই ঢালাওভাবে ব্যয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।