লাইফ বীমায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই: একরামুল আমিন

লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা বাড়িয়ে প্রবিধান জারি করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত প্রবিধান জনমত যাচাইয়ের জন্য ওয়েবসাইটে তুলে দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর এ প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে বীমা অঙ্গনে। মতামত আসতে থাকে পক্ষে-বিপক্ষে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এ ধারাকে প্রবাহমান করতে বীমাখাতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মতামত নেয়ার উদ্যোগ নেয় ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। এ ধারাবাহিকতায় এ পর্যায়ে কথা বলেছেন বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল আমিন এফসিএ।

ভিত্তি হিসেবে জানতে চাওয়া হয়:

ক. বিভিন্নখাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে তা কতটা বাড়ানো যৌক্তিক?

খ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা না বাড়িয়ে কোম্পানি পরিচালনায় ব্যয় কমিয়ে এনে ব্যবসা পরিচালনা করলে সার্বিক দিক থেকেই মঙ্গলজনক- বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

গ. বিশেষজ্ঞদের অভিমত: ব্যয়সীমা বাড়ালে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে আরও বেশি টাকা খেয়ে ফেলার সুযোগ পাবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

ঘ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমার প্রস্তাবে ব্যয়ের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কি?

ঙ. বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ব্যবসা উন্নয়নে ব্যয়ের সীমা বাড়ানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

চ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা আরো বাড়ালে আর্থিকভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কার বিষয়ে আপনার মতামত কি?

***

আমাদেরকে একটা বিষয় ভাবতে হবে যে ব্যয় কেন বেশি হচ্ছে। ব্যয় বেশি হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে দক্ষ জনবলের অভাব। ডেল্টা লাইফ বা ন্যাশনাল লাইফ এখন অনেক বড় কোম্পানি। এসব কোম্পানির শুরুর দিকটা কেমন ছিল। তাদেরও কিন্তু ব্যয় অনেক বেশি ছিল। ধীরে ধীরে সেটা কমে এসেছে। তাই বলে আমি এমনটা বলছি না যে, প্রস্তাবিত খসড়া প্রবিধানে ব্যয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা যৌক্তিক। তা কোনভাবেই যৌক্তিক না।

তবে মূল সমস্যাটা হল পেশাদারিত্ব বা প্রফেশনালিজম। বীমাখাত অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু আমরা দক্ষ ও শিক্ষিত জনবল তৈরি করতে পারি নাই। যার ফলে চরম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যয় বাড়ার পিছনে এ ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনেকটা দায়ি। দেশব্যাপী শাখা অফিস খোলা হচ্ছে, নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, কিন্ত আমার প্রিমিয়াম বাড়ছে না। নতুন শিক্ষিত এজেন্ট বাড়ছে না। বীমা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা দূর করা যাচ্ছে না। মাঠ থেকে ব্যবসা সংগ্রহে হাজার হাজার লোক কাজ করছে। কমিশন নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত আমরা। এক্ষেত্রে আমরা সার্বিক খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নাই। আজকে যে ব্যয় নিয়ে কথা উঠেছে তার পিছনে এসব বিষয় সম্পৃক্ত। তাই ব্যয় কমিয়ে প্রবিধান করলেই শুধু হবে না। এর সাথে আনুষঙ্গিক সবগুলো বিষয় ভাবতে হবে।  উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাহক সেবা যাতে নিশ্চিত হয় সে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

***

সেই একই কথা। পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে আনার জন্যও দক্ষতা প্রয়োজন। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যেসব পলিসি বিক্রি করে তাতে দুই ধরণের সেবা। একটি হলো মারা গেলে বা অসুস্থ হলে বা অন্যকোনোভাবে ক্ষয়ক্ষতি মধ্যে পড়লে যে আর্থিক ক্ষতি- নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম নিয়ে তার ঝুঁকি নেয়া। আর না হয় মেয়াদ শেষে গ্রাহককে তার জমা করা টাকা লাভসহ বা লাভবিহীন বুঝিয়ে দেয়া। তাহলে ঝুঁকির বিপরীতে আমরা যে প্রিমিয়াম নিচ্ছি তা কিন্তু গ্রাহকের টাকা। গ্রাহকের আমানত। যা মেয়াদ শেষে ফেরত দিব অথবা ক্ষতিপূরণ দিব। গ্রাহকের এই টাকা যেহেতু আমাকে ফেরত দিতে হবে তাহলে আমাদের ভাবতে হবে এই প্রিমিয়াম থেকে আমরা কত টাকা খরচ করতে পারি।

দেশে এখন ৩২টি লাইফ বীমা কোম্পানি হয়েছে। কোনো কোম্পানি প্রিমিয়াম ৩ স্তরের জনবল দিয়ে, কারো আবার ৮ থেকে ১২টি স্তরের জনবল। একজন পলিসি করছে তারা উপর বাকিরা বসে খাচ্ছে। আগের জনবল কাঠামো ছিল পিরামিড আকারে। আর এখন তা উল্টে গেছে। উপরের দিকে জনবল বেশি নিচে কম। নিচের দিকে আর এজেন্ট নিয়োগ হচ্ছে না।

কোম্পানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। অর্থাৎ আমাদের পরিচালনা খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নাই। তাই পরিচালনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা গেলে খরচ কমানো যাবে এটাই স্বাভাবিক।

বাস্তবতা এমন ১০০ টাকার ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে ১৫০ টাকা খরচ করছে। এই টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে। এত টাকা খরচ করে প্রিমিয়াম থেকে কত টাকা বিনিয়োগ করতে পারব। বিনিয়োগ থেকে আমাদের আয় কত আসবে। আমরা মেয়াদ শেষে কিভাবে গ্রাহককে টাকা দিব। এই বিষয়গুলো আগে ভাবা হয়নি।

কোনো ভাবনা চিন্তা না করে আমরা খরচ করে ফেলেছি। এখন গ্রাহকের টাকা দেয়ার যখন সময় হয়েছে আমরা টাকা দিতে পারছি না। বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব গোটা বীমাখাতের উপর পড়ছে। এখন আমরা সবাই ক্ষতির মধ্যে পড়ছি।

দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বীমা পেশা আমাদের দেশে সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। বীমা এজেন্টকে দালাল মনে করা হয়। এ পেশার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন নেই। ফলে শিক্ষিত বা মেধাবীরা এ পেশায় আসে না।

বীমা শিক্ষার প্রসারও এ দেশে ঘটেনি। ইন্স্যুরেন্সে একাডেমি একটা থাকলেও তারা পরে আছে মান্ধাতার আমলেই। বছরের পর বছর ধরে এর একই অবস্থা। সরকার বীমাখাতে পেশাদারিত্ব সৃষ্টিতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। গত ৬ বছরে আইডিআরএ'কে শক্তিশালী করা যায়নি।

সম্প্রতি আইডিআরএ নতুন সদস্য নিয়োগ হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ডিরেক্টর, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ তাদের বীমা বিষয়ে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বীমা বিষয়ক অভিজ্ঞ লোক নিয়ন্ত্রক সংস্থায় না থাকলে তারা খাতটির উন্নয়ন কিভাবে করবে। এক্ষেত্রে আইডিআরএ বীমা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদে নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে পারে।

সরকার রাজনৈতিক কারণেই হয়ত বীমা কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের মত একটি দেশে ৩২টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়। এসব কোম্পানি অনুমোদনের ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বীমার সক্ষমতা তৈরি করা হয়নি।

বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। বীমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা নেই। যাতে বীমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াবে।

বীমার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টিতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে বীমা বাধ্যতামূলক করার সুযোগ থাকলেও সরকার সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সরকার চাইলে এসব ক্ষেত্রে বীমা বাধ্যতামূলক করতে পারে। যেমন- শ্রম আইনে বীমা বাধ্যতামূলক থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। একক বীমায় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এক্ষেত্রে সরকার গ্রুপ বীমা আইনকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে পারে। এটা করা হলে সব কোম্পানি ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। একই সাথে গ্রুপ বীমার উপযোগিতা সৃষ্টি করতে সরকারকে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।

ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষেত্রে যাদের বয়স ৫৫ বছর তাদের জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়া, প্রবাসী কল্যাণ বীমা চালু করা, ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু করা। সরকারের পক্ষ থেকে এসব উদ্যোগ নেয়া হলে বীমার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। 

***

এমন পরিস্থিতিকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। বেশি খরচের সুযোগ দিলে আরো বেশি খরচ হতে পারে। নতুন যেসব কোম্পানি ব্যবসা শুরু করেছে এসব কোম্পানির মধ্যে ১৪০% থেকে ১৫০% খরচ হয়েছে। কিন্তু পরের বছরগুলোতে নবায়ন আসেনি। এর মানে হচ্ছে কিছু বীমা কর্মী বেশি কমিশন পাওয়ার আশায় মানসম্মত পলিসি করেনি বা কখনো কখনো ভূয়া পলিসি করে টাকা নিয়েছে। এতে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল হয়েছে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি যদি চলতেই থাকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে কার ভাগ্যে কি আছে তা বলা মুসকিল। পুরনো কোম্পানির দিকে তাকালেই এর বাস্তবতা স্পষ্ট। যারা ব্যয় বেশি করেছে তাদের আর্থিক অবস্থাই এখন সঙ্কটজনক। অনেক কোম্পানি ক্লেইম দিচ্ছে না। ক্লেইম পরিশোধের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

***

ব্যয় যত কমানো যাবে তত বেশি বিনিয়োগ হবে। বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়াবে। এতে গ্রাহক শেয়ার হোল্ডার উভয়ই লাভবান হবে। কোম্পানির আর্থিক ভিত মজবুত হবে। আর অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় মানেই এর উল্টো পরিস্থিতি।

***

ব্যয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আগে ব্যয়ের যে হার নির্ধারণ করা আছে তাই যথেষ্ট।