অপেশাদার কর্তাদের নিয়ন্ত্রণে বীমাখাত!

অনুপ সর্বজ্ঞ: হাজার কোটি টাকার দাবি নিরুপন ও পরিশোধ, কোম্পানির সম্পদ ও দায় মূল্যায়ন (একচ্যুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন), আন্ডাররাইটিং, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সলভেন্সি মার্জিন, প্রিমিয়াম রেট নির্ধারণ, অ্যাকাউন্টিংয়ের ভিন্নতা প্রভৃতি জটিল সব বিষয় নিয়েই বীমাখাত। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া খাতটির উন্নয়ন বা নিয়ন্ত্রণ কোনটিই সম্ভব নয়।

অথচ এমন কারিগরি ও কৌশলগত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র পরিচালনায় নেই কোন বীমাবিদ। যেখানে বিশ্বের সবদেশে বীমাবিদদের দ্বারা গঠন হয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। সেখানে বীমা বিষয়ে অপেশাদার কিছু কর্তাদের নিয়ে গঠন হয়েছে এ দেশের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারি। যিনি অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব। এছাড়া তিনি কাজ করেছেন এনবিআর ও কাস্টমসের বিভিন্ন উচ্চ পদে। বীমা বিষয়ে পেশাদারী জ্ঞান না থেকেও তিনি আজ নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।

নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের আরেক সদস্য গকুল চাঁদ দাসও ছিলেন অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের অতিরিক্ত সচিব। সংস্থাটির সদস্য বোরহান উদ্দীন আহমেদ ছিলেন সাবেক জজ। কর্তৃপক্ষের সদস্যদের মধ্যে শুধু মোশাররফ হোসেনই একমাত্র বীমা বিষয়ে কিছুটা অভিজ্ঞ। যিনি একসময় কর্মরত ছিলেন কিছু বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানির উচ্চ পদে।

এছাড়া আইডিআরএ’র বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম যারা পরিচালনা করছেন তাদের অধিকাংশই এসেছেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে, আর কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন  অ্যাডহক ভিত্তিতে। একই অবস্থা খাতটির কোম্পানিগুলোতেও। ব্যাংক ও বীমা দু’টিই গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাতে যেভাবে দক্ষ লোকবল গড়ে উঠেছে বীমাখাতে ঠিক তার বিপরীত। মূলত অপেশাদার ও অদক্ষ কর্তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বীমাখাত।

অবশ্য অপেশাদার কর্তৃপক্ষ গঠনের পেছনে সংশ্লিষ্ট আইনটিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০ এর ৭ ধারায় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, বীমা, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, মার্কেটিং, পরিসংখ্যান, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন বা আইনে অনূন্য ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান বা সদস্য হবার যোগ্য হবেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনে যদি বীমা বিষয়ে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক পড়ালেখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতো তাহলে একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা সহজ হতো। তখন নিজেদের প্রয়োজনেই অনেকে  বিদেশে গিয়ে বীমা বিষয়ে পড়ালেখায় উৎসাহিত হতেন। 

এ প্রসঙ্গে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা ও সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া যে দেশই বলেননা কেন সেখানকার বীমাখাতের রেগুলেটরি অথরিটিতে যারা থাকেন তাদের প্রত্যেকেই বীমাবিদ। এটা একটি কারিগরি বিষয়। তাই এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়া খাত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো কতগুলো অপেশাদার লোক দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে আমাদের বীমাখাত। এ খাতে দক্ষ লোকবল গড়ে তোলার উদ্যোগ কখনোই কোন সরকার নেয়নি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত নতুন কোন লোকবলই নিয়োগ হয়নি রাষ্ট্রায়ত্ব দুই বীমা করপোরেশনে। পাকিস্তান আমলে যারা ছিলেন তাদেরকে দ্বারাই চালিয়ে নেয়া হচ্ছিল করপোরেশন দুটি। ২০০০ সালের দিকে এদের প্রায় প্রত্যেকেই অবসরে চলে যান। এবং পরবর্তিতে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোরও নেতৃত্বে আসেন তারা। কিন্তু বয়সের ভারে তাদের অনেক এখন নেই। এদিকে আর কোন দক্ষ লোকবল তৈরী না হওয়ায় ক্রমেই অদক্ষ ও অপেশাদার লোকজন ঢুকে পরে খাতটিতে । যার ফলে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এদেশের বীমাখাত।

আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা বলেন, দক্ষ ও পেশাদার লোকবল তৈরীর উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ বীমা একাডেমির। এছাড়া বিভিন্ন বীমা কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নিম্নপদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। এরই মধ্যে আরও বেশ কিছু নতুন কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু ব্যবসার গুণগত প্রসার ঘটেনি।

তিনি আরও বলেন, বীমা ব্যবসার ২৫ শতাংশ শেয়ার মেটলাইফের দখলে। স্বাধীনতার আগে থেকেই বহুজাতিক এ কোম্পানিটি এখানে ব্যবসা করছে। কিন্তু এরপরও এদেশের বীমাখাতে দক্ষ লোকবল তৈরীর পেছনে তাদের কোন ভূমিকা নেই। তারা শুধু নিজেদের ব্যবসাই দেখছে।