করোনা ভাইরাসেও ক্ষতিপূরণ পাবেন বীমা গ্রাহকরা

আবদুর রহমান আবির: করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত কোভিড-১৯ এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। চীন থেকে শুরু হয়ে এশিয়ার বিভিন্ন অংশ এবং এর বাইরেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। এরইমধ্যে করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইউরোপকে ঘোষণা করা হয়েছে এর কেন্দ্রস্থল। সম্প্রতি বাংলাদেশেও সনাক্ত করা হয়েছে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী। আতঙ্কে রয়েছেন অন্যরাও।

এমন পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা খরচ এবং মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ দিতে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের বীমাখাত! কতটুকু বীমা কাভারেজ দেবে দেশের হেলথ ইন্স্যুরেন্স ও লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি! এসব বিষয় নিয়ে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নিবাহী কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছে ইন্স্যুরেন্সনিউজিবিডি। কথা হয়েছে দেশের বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ)’র সঙ্গেও।

জানা গেছে, করোনা ভাইরাস নতুন হওয়ায় প্রচলিত বীমা পলিসিগুলোতে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। তবে স্বাস্থ্য বীমার যেসব পলিসি দেশে চালু রয়েছে তার বেশিরভাগের মাধ্যমেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বীমা গ্রাহকের চিকিৎসা খরচ বহনের সুযোগ রয়েছে। মৃত্যুদাবিও পরিশোধ করবে বীমা কোম্পানি। অর্থাৎ বীমা পলিসি গ্রহণের পর কোন গ্রাহক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তিনি ওই পলিসিতে নির্ধারিত সকল সুবিধা পাবেন। তবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর কোন ব্যক্তিকে বীমা সুবিধা দেয়ার মতো বীমা পলিসি এখন দেশে নেই।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোই বীমার কাজ। করোনা ভাইরাস হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের বিপদ। তাই বীমা এই সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। তবে করোনা ভাইরাস নতুন হওয়ায় বীমা পলিসিতে এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশেষ কোন বীমা পলিসি চালু করা হবে কিনা সে বিষয়টি এখনো আলোচনা হয়নি। আসলে সেই পরিস্থিতিও এখন আসেনি।

ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, এই মুহুর্তে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করাই আমাদের করণীয়। তবে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় সেক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তাছাড়া এখানে অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল বিষয়ও রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বড় ধরণের দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক ও বীমাখাত সম্মিলিতভাবে কাজ করে। পরিস্থিতি এমন হলে আমরাও সেটাই করার চেষ্টা করবো।

গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরী বলেন, করোনা ভাইরাস আগে ছিল না। নতুন রোগ হওয়ায় বীমা পলিসিতে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু নেই। তাই বীমার স্বাভাবিক বিধান অনুসারে অন্যান্য রোগের মতো এটাতেও ক্ষতিপূরণ পাবেন গ্রাহক। তবে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হওয়ার পর কোন রোগীকে বীমা পলিসি ইস্যু করা হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেই। বিষয়টি নিয়ে আমরা পুনর্বীমাকারীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছি। যেহেতু আগে কখনো আমরা এর মুখোমুখি হইনি, তাই এ বিষয়ে নতুন কিছু করতে পর্যবেক্ষণ ও সময়ের প্রয়োজন।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমান বলেন, বীমা মূলত সুস্থ মানুষের জন্য। তবে কোন বীমা গ্রাহক করোনা ভাইরাস বা অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে বীমার সুবিধা পাবেন। এক্ষেত্রে বীমা পলিসিতে হসপিটালাইজেশন সুবিধা নেয়া থাকলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার নির্ধারিত খরচ পাবেন। আবার আউটপ্যাশেন্ট সুবিধা নেয়া থাকলে তিনি সেই সুবিধা পাবেন। তাছাড়া কোন বীমা গ্রাহক করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবার মৃত্যুদাবির অর্থ পাবেন।

সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মো. শফিক শামিম বলেন, ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স নামে বাংলাদেশে যেসব পলিসি প্রচলিত আছে সেগুলো আসলে ওভারসিস মেডিক্লেইম পলিসি। ভ্রমনজনিত অসুস্থতার কারণে গৃহীত চিকিৎসার খরচ এবং ভ্রমন করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তার লাশ দেশে আনার খরচ বহন করে এ ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স। তবে ভ্রমনে গিয়ে কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার কাভারেজ দেবে না এই বীমা পলিসি।

জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য বীমার যেসব পলিসি বর্তমানে দেশে চালু রয়েছে তার বেশিরভাগই করোনা ভাইরাসকে কাভারেজ দেয়। কারণ, করোনা ভাইরাস অন্যান্য রোগের মতোই একটি রোগ। তাই বীমা পলিসি গ্রহণের পর কোন গ্রাহক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তিনি ওই পলিসিতে নির্ধারিত সকল সুবিধা পাবেন। তবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর কোন ব্যক্তিকে বীমা সুবিধা দেয়ার মতো বীমা পলিসি এখন দেশে নেই।

তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য বীমা পলিসিতে যদি নির্দিষ্ট কোন রোগের সুবিধা নেয়া হয় তাহলেও গ্রাহক করোনা ভাইরাসে বীমার ক্ষতিপূরণ পাবেন না। কারণ নির্দিষ্ট রোগের জন্য বীমা করা হলে শুধু সেই সব রোগের ক্ষেত্রে বীমা কাভারেজ পাওয়া যায়। তবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে কোন বীমা গ্রাহক মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবার মৃত্যুদাবি পাবেন। সরকার যদি করোনা ভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করে, সেক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বীমা কোম্পানিগুলো কাজ করবে বলে জানান এস এম নুরুজ্জামান।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ৷ আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৪৯টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) । আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ২১৫ জন মানুষ। এরমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ৬০২ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৭৩ হাজার ৭১৩ জন। এই প্রেক্ষাপটে গত ১১ মার্চ বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ।

এদিকে গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) দেশে ৩ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। এরমধ্যে দু’জন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। আক্রান্ত একজনের মাধ্যমে পরবর্তীতে একই পরিবারের আরও এক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে আরো দু’জন পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। তিনি বলেন, প্রত্যেকে যদি এ ব্যাপারে একটু সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেন এবং সেভাবে মেনে চলতে পারেন তাহলে আমরা এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবো। কাজেই এখানে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে সবাইকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।