বীমা কর্মীদের সুরক্ষায় প্রণোদনা তহবিল গঠনের দাবি

আবদুর রহমান আবির: করোনা মহামারীতে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় সম্পূর্ণভাবে উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির কমিশন ভিত্তিক বীমা কর্মীরা। এ অবস্থায় বীমা শিল্পের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে খ্যাত এসব এজেন্টের সুরক্ষায় প্রণোদনা তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছেন বীমা সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের এই মহামারীতে বীমা পলিসি বিক্রি ও নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে। এর ফলে বীমা শিল্পের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী মাস শেষে বেতন-ভাতা পেলেও কোন কমিশন পাবেন না এসব এজেন্ট। কারণ, নিয়ম অনুসারে বীমা পলিসি বিক্রির নির্ধারিত কমিশনের বাইরে তাদের কোন বেতন-ভাতা নেই।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি ৭৮টি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। নতুন আরেকটি লাইফ বীমা কোম্পানি সম্প্রতি অনুমোদন লাভ করেছে। এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্টসহ এসব বীমা কোম্পানির বিভিন্ন পদে কাজ করছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ নারী-পুরুষ।

২০১৮ সালের হিসাব অনুসারে দেশের ৩২টি লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট সংখ্যা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৫১। আর এমপ্লয়ার অব এজেন্ট রয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ১৭৮। অন্যদিকে ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট সংখ্যা ২ হাজার ৬০৭। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বর্তমানে এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্ট সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়েছে।

বিপুল সংখ্যক এই বীমা কর্মীর জন্য প্রণোদনা ঘোষণার দাবি জানিয়ে জেনিথ ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম আয়ের অন্যতম মাধ্যম বীমা শ্রমিক অর্থাৎ কমিশন ভিত্তিক এজেন্ট। এসব বীমা কর্মীর বেশিরভাগই নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের। বীমা গ্রাহক তৈরি এবং তাদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে বীমা কোম্পানি থেকে যে কমিশন পান তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। কিন্তু উপার্জনের এই মাধ্যম দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে থমকে যাবে তাদের জীবন-সংসার।

এস এম নুরুজ্জামান বলেন, করোনা আতঙ্কে গত মার্চে বীমা কর্মীদের নতুন গ্রাহক তৈরি এবং প্রিমিয়াম সংগ্রহ ভালো হয়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সাধারণ ছুটি। দীর্ঘ এই ছুটিতে কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। ফলে বন্ধ রয়েছে প্রিমিয়াম সংগ্রহ। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মারাত্মক আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়বে কমিশন ভিত্তিক বীমা কর্মীরা। এই প্রেক্ষিতে সরকারের কাছে বীমা শিল্পের প্রাণশক্তি এজেন্টদের সুরক্ষায় প্রণোদনা তহবিল ঘোষণার অনুরোধ জানাচ্ছি।

গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম মনিরুল আলম বলেন, গার্ডিয়ান লাইফ মনে করে প্রতিষ্ঠানের সবাইকে মনে রাখা উচিত। তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাই সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগেই আমরা এজেন্টদেরকে তাদের এক মাসের গড় আয়ের সমান অর্থ দিয়েছি। এটা কোন অনুদান নয়, একটা সহযোগিতা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে তারা ব্যবসা সংগ্রহের মাধ্যমে এই অর্থ সমন্বয় করতে পারবে। কর্মকর্তাদের এক মাসের বেতনও আমরা ছুটির আগেই দিয়েছি।

তিনি বলেন, এখন যদি তাদের পাশে আমরা না দাঁড়াই, তাহলে কেন তারা পরবর্তীতে আবার আমাদের কাজে এগিয়ে আসবে। সুতরাং এই মুহুর্তে বীমা কোম্পানিগুলোকে কেয়ারিং এটিচিউড নেয়া উচিত। যাতে করে বিপদের এই সময়ে এজেন্টরা অন্তত খেয়ে-পড়ে, চলা-ফেরা করতে পারে সেজন্য অগ্রিমভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন। পরবর্তীতে তারা ব্যবসা সংগ্রহের মাধ্যমে এই সহযোগিতার অর্থ সমন্বয় করতে পারবে।

ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বীমা পরিবারের সদস্য হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চই জানেন বীমা শিল্পে যারা কাজ করেন তারা ব্যবসা আনলে বেতন পান। কিন্তু করোনা ভাইরাসের এই মহামারীতে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মিল কারখানা, অফিস আলাদত বন্ধ থাকায় বীমা কর্মীদের ব্যবসা নেই। তাই তাদের বেতন পাওয়ারও সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে কমিশন ভিত্তিক বীমা কর্মীরা। বীমা খাতের স্বার্থে এই মুহুর্তে আমাদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে জনবল সংকটে পড়তে পারে বীমাখাত। এ অবস্থায় বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ২ শতাংশ সুদে ১৮ মাসের জন্য কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা মূলত এজেন্ট নির্ভর। সারাদেশে এজেন্ট সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। তাদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ৩০-৩২ লাখ। কিন্তু করোনায় এখন সকল এজেন্ট ঘরবন্দি। কোন কাজ করতে পারছে না। তাই তাদের কোন আয় রোজগারও নেই। এ অবস্থায় বীমা খাতের স্বার্থেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারা বাঁচলে বীমাখাত বাচঁবে। তা না হলে তারা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। যা হবে বীমা শিল্পের জন্য বিপদজনক।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের সহায়তার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। বীমা শিল্পকে ওই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ এই হতদরিদ্র মাঠকর্মীদের বাঁচানো মানে দেশের বীমা শিল্পকে বাঁচানো। মাঠ কর্মীরা যদি পেশা বদল করে তাহলে এর প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। এমতাবস্থায় বীমা শিল্পের মাঠ কর্মীদের বিশেষ সহায়তার আওতায় নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিআইপিডি'র ডিরেক্টর জেনারেল কাজী মোরতুজা আলী বলেন, বীমা শিল্পের প্রধান বিক্রয় শক্তি বীমা কর্মী। তাদের সংগৃহীত প্রিমিয়াম নিয়েই এগিয়ে যায় বীমা কোম্পানি। বিপদের সময় আর্থিক সুরক্ষা পান বীমা গ্রাহক। এই বীমা কর্মীরা যদি ভালো না থাকে, তাহলে ভালো থাকবে না বীমা শিল্প। তাই বর্তমান পরিস্থিতে বীমা কর্মীদের সুরক্ষায় প্রণোদনা দেয়া জরুরি।

এ ছাড়াও করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব উত্তরণে বেকার বীমা চালু করা যেতে পারে। যাতে করে পরবর্তীতে যখনই নতুন কোন সংকট সৃষ্টি হবে তখন এই বীমা তাদের আর্থিক সুরক্ষা দিতে পারে। বীমা খাতের স্বার্থেই বীমা কর্মীদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে বেকার বীমা চালু রয়েছে। দেশের অন্যান্য খাতের কর্মীরাও বেকার বীমায় সুরক্ষা পাবেন বলে উল্লেখ করেন কাজী মোরতুজা আলী।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমাদেরকে সব বিষয় নিয়েই ভাবতে হয়। বীমা কর্মীরাও আমাদের ভাবনার বাইরে নয়। তবে সব অফিস বন্ধ থাকায় এই মুহুর্তে আমরা বীমা কর্মীদের নিয়ে ভাবতে পারছি না। করোনা মহামারী সব কিছুতেই প্রভাব ফেলছে। বীমা খাতের মতো সব খাতের পরিস্থিতিই এখন নাজুক। তারপরও আমরা সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। বাংলাদেশও একটা কঠিন সময় পার করছে। দেশের সব খাতের পরিস্থিতিই এখন খারাপ। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। আমাদের অভিভাবক হিসেবে বীমাখাত দেখভালের দায়িত্বও সরকারের। বীমা কর্মীদের প্রয়োজনে আমরাও সরকারের কাছে প্রণোদনা চাইব। সময় হলে এটা চাইতে হবে।