ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সে সাড়ে ৭ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন

নিজস্ব প্রতিবেদক: অবৈধ লেনদেন করেছে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। এই লেনদেন করা হয়েছে কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ের একটি ব্যাংক একাউন্টে। গেলো বছর ওই একাউন্ট থেকে নগদে তুলে নেয়া হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। অথচ আইন অনুসারে কোম্পানির একাউন্ট থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়া অবৈধ। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন অনুসারে পাঁচ হাজার টাকার ওপরে নগদ লেনদেন করার সুযোগ নেই। এ ধরণের লেনদেনে কোম্পানির আর্থিক কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অন্যদিকে টাকা আত্মসাৎ বা অর্থপাচারের আশঙ্কাও থেকে যায়। এর ফলে বীমা গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডার উভয়ের স্বার্থই ক্ষুন্ন হয়।

বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটিতে নগদ লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ বা অর্থপাচারের ঘটনা ঘটেছে কিনা সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বীমা দাবি পরিশোধ নিয়ে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, বীমা কোম্পানি কর্তৃক সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে ৫ হাজার বা তদুর্ধ্ব অর্থ ক্রসড চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির জন্য এই নির্দেশনা জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।  অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বীমাখাতে প্রো-অ্যাক্টিভ মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষিতে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।

সাড়ে কোটি টাকা নগদ উত্তোলন:

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের এনসিসি ব্যাংক পান্থপথ শাখার একাউন্টটি খোলা হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। একাউন্ট নং- ০০৮৭-০২১০০০৪৪১৯। এই একাউন্টে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট লেনদেন করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৫২ লাখ ১৪ হাজার ৪০৬ টাকা।

এর মধ্যে আলোচ্য সময়ে একাউন্টটিতে মোট জমা হয়েছে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ ৫৩ হাজার ১১১ টাকা । আর উত্তোলন করা হয়েছে ২১ কোটি ২ লাখ ৬১ হাজার ২৯৫ টাকা। উত্তোলন করা টাকার মধ্যে নগদে তোলা হয়েছে ৭ কোটি ৪৭ লাখ ২২ হাজার ৩৩২ টাকা। এসব টাকা তোলা হয়েছে বিভিন্ন নামে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগদে তুলে নেয়া টাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা তোলা হয়েছে সেলফ তথা নিজ নামে। আলোচ্য সময়ে নিজ নামে (সেলফ) তোলা হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬০ টাকা।

মো. সিরাজুল ইসলাম, সিরাজুল ও সিরাজ নামে নগদে টাকা তোলা হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬১ টাকা। একইভাবে মধু বাবুর নামে নগদ তোলা হয়েছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫৮ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন নামে তোলা হয়েছে ৭২ লাখ ৮০ হাজার ২৫৩ টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত বছর আগস্ট মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত নিজ নামে (সেলফ) নগদে তুলে নেয়া হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগস্ট মাসে ১২ লাখ, সেপ্টম্বর মাসে ৬ লাখ, বাকি ১২ লাখ টাকা তোলা হয়েছে অক্টোবর মাসে।

প্রিমিয়াম আয়ের হিসাবে ব্যাংকে জমাপ্রতিবেদনে সাড়ে কোটি টাকা গড়মিল:

ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করা টাকার হিসাবের সাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করা প্রিমিয়াম আয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেয়া প্রিমিয়াম আয়ের তথ্যে মিল নেই। গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে প্রিমিয়াম বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স জমা করেছে ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।

অথচ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র কাছে দাখিল করা ত্রৈমাসিক হিসাব বিবরণীতে মোট প্রিমিয়াম আয় দেখানো হয়েছে ১৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৫ টাকা। এই হিসেবে প্রিমিয়াম আয় কম দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৩ লাখ ১০ হাজার ৮০ টাকা।

সূত্র মতে, গত বছর জুলাই মাস থেকে ৩টি একাউন্টের প্রিমিয়াম জমা নেয়ার নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের এই ৩টি একাউন্টের মধ্যে রয়েছে- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, একাউন্ট নাম্বার-২০৫০২২২০৯০০০১১৯১২; প্রাইম ব্যাংক লিঃ, একাউন্ট নং-২১১৩৩১৪০১২৭৩১; এনসিসি ব্যাংক লিঃ, একাউন্ট নং ০০৮৭-০৩২৫০০০২৭৮।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম সংগ্রহের এই ৩টি একাউন্টে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মোট জমা হয়েছে ১৫ কোটি ৮৪ লাখ ৮৫ হাজার ৭৩০ টাকা। এর মধ্যে প্রাইম ব্যাংকে ৭ কোটি ৫২ লাখ ৪১ হাজার ৯০৫ টাকা, ইসলামী ব্যাংকে ১ কোটি ৬১ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৬ টাকা এবং এনসিসি ব্যাংকে ৬ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ৫৮৯ টাকা।

এছাড়া শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকে খাতুনগঞ্জ শাখায় (একাউন্ট নং-৩০০২১৩১০০০০০৪৫০) জুলাই মাসে প্রিমিয়াম বাবদ জমা নেয়া হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ১২ হাজার ১০৫ টাকা। এই হিসেবে জুলাই থেকে সেপ্টম্বর এই ৩ মাসে একাউন্টগুলোতে প্রিমিয়াম বাবদ মোট জমা করা হয় ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।  

অথচ আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের ত্রৈমাসিক হিসাব বিবরণীতে মোট প্রিমিয়াম আয় উল্লেখ করা হয়েছে ১৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৫ টাকা। এই হিসেবে প্রিমিয়াম আয় কম দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৩ লাখ ১০ হাজার ৮০ টাকা।

উল্লেখ্য, শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ ব্রাঞ্চের এই একাউন্টটি গত বছরের জুলাই মাসের পর বন্ধ করে দেয়া হয়।

ত্রৈমাসিক বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম আয়ের পার্থক্য কোটি টাকা:

আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুসারে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের মোট প্রিমিয়াম আয় ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ২২৯ টাকা। এর মধ্যে ১ম ত্রৈমাসিকে (কোয়ার্টার) ১০ কোটি ৩১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩ টাকা, ২য় ত্রৈমাসিকে ১২ কোটি ৬০ লাখ ৩৯ হাজার ২১১ টাকা এবং ৩য় ত্রৈমাসিকে ২৭ কোটি ১২ লাখ ৭৮ হাজার ২২০ টাকা।

অথচ কোম্পানিটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে মোট প্রিমিয়াম উল্লেখ করা হয়েছে ৬১ কোটি ৩৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এই হিসেবে ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন ও বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া মোট প্রিমিয়াম আয়ের হিসাবে পার্থক্য ২ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার ২২৯ টাকা।

এ বিষয়ে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ এম এম মহিউদ্দিনের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ২০২০ সালে আমাদের নগদ উত্তোলন দশ হাজার টাকা বেশি নেই, যেটা আইন অনুসারে বৈধ। তবে ২০১৯ সালের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনিও কল রিসিভ করেননি।