হাওরে শস্য বীমা চালু করছে সরকার

আবদুর রহমান আবির: হাওর এলাকায় শস্য বীমা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশন, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী শস্য বীমার এ প্রকল্প চালু করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক ড. শেখ মহ. রেজাউল ইসলাম বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে শস্য বীমা খুবই জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে শস্য বীমা চালুর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আকস্মিক বন্যাপ্রবণ হাওর অঞ্চলে শস্য বীমা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে এ কাজে বেশ অগ্রগতিও হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাওর অঞ্চলে শস্য বীমা চালুর বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) ও গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এসময় এসবিসি’কে এ বিষয়ে মতামত দিতে বলা হয় এবং গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সকে একটি ধারণাপত্র তৈরির নির্দেশনাও দেয়া হয়। পরবর্তীতে কৃষি মন্ত্রণালয়, আইডিআরএ ও এসবিসি’সহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বৈঠকে হাওর অঞ্চলে শস্য বীমার চালুর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে প্রায় সব স্টেকহোল্ডার হাওরে দ্রুত শস্য বীমা চালুর ব্যাপারে মত দিলেও কৃষি মন্ত্রলণালয় নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, কৃষি সংগঠনগুলো শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত শস্য বীমা থেকে কৃষকরা খুব একটা সুবিধা নিতে পারবে না। তাই এখনই শস্য বীমা চালু করতে আগ্রহী নয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ৭টি জেলা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। এসব জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। হাওর এলাকায় মোট জমির পরিমাণ ১৯.৯ লাখ হেক্টর। যেখানে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। হাওর এলাকায় চাষযোগ্য বোরো জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর। যা থেকে প্রায় ৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হয়।

জীববৈচিত্রপূর্ণ হাওর অঞ্চলে ২৬০ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি আছে। সারাদেশে মৎস উৎপাদনের ২০ ভাগই এখান থেকে আসে। ধান ও মাছ উৎপাদন হাওর অঞ্চলের জনগণের প্রধান জীবিকা। এ এলাকা প্রায় প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়। যার ফলে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাওর এলাকায় প্রধান দুর্যোগগুলো হলো আকস্মিক বন্যা, বজ্রপাত, ঝড়, উচ্চমাত্রার ঢেউ ও নদীতীর ভাঙ্গন।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)’র কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন পরকাশ এসবিসি’র এক অনুষ্ঠানে বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতার কারণে বাংলাদেশের কৃষিখাত হুমকির মধ্যে রয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর কৃষিজমি বন্যা ও খরা প্রবণ এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর কৃষিক্ষেত ঘূর্ণিঝড় ও লবণ পানির শিকার। ফলে এসব অঞ্চলে চরম দারিদ্রতা ও খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু দুর্যোগের আগেই কৃষকদের প্রস্তুত করতে পারলে এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারলে ক্ষতি পরবর্তী খরচ কমে আসবে। এক্ষেত্রে কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে শস্য বীমা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তাই শস্য বীমার ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন।

তথ্য অনুসারে, ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রচলিত শস্য বীমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। তবে খরচ বেশি হওয়ায় ১৯৯৬ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৩ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্য বীমা চালু করে সরকারি প্রতিষ্ঠান। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হ্রাসে এ বীমা চালু করা হয়।

খরাপ্রবণ রাজশাহী, বন্যাপ্রবণ সিরাজগঞ্জ ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ নোয়াখালী অঞ্চলকে প্রকল্প এলাকা নির্বাচন করা হয়। ৬টি পাইলট প্রকল্পের আওতায় ওই তিন জেলার ৯ হাজারের বেশি কৃষককে শস্য বীমা সুবিধা দেয়া হয়। এ ছাড়াও ২০টি আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন, ১৫শ' কৃষককে শস্য বীমা সম্পর্কে সচেতন করা এবং ৯শ' কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে।

২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়া আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা প্রকল্পের পরিচালক ওয়াসিফুল হক জানান, দেশের তিনটি জেলায় পরীক্ষামূলক শস্য বীমা চালুর পর কৃষকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে কৃষকরা আগ্রহী না হলেও বীমা দাবি পাওয়ার পর তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, কৃষকদের সহায়তায় বীমার বিকল্প নেই। সরকার পদক্ষেপ নিলে ভারতের মতো ব্যাপকভাবে শস্য বীমা সুবিধা দেয়া সম্ভব। প্রয়োজনে এগ্রিকালচার ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন গঠন করতে পারে সরকার। হাওড়ে শস্য বীমা চালুর গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারি মহলে বীমা নিয়ে আরো ভাবনার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ওয়াসিফুল হক।

ড. শেখ মহ. রেজাউল ইসলাম আরো বলেন, হাওরে শস্য বীমা চালু বেশ টেকনিক্যাল বিষয়। এর সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত। তাই চমৎকারভাবে যাচাই-বাছাই করেই আমাদের এগুতে হবে। আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্য বীমার সঙ্গে এর পার্থক্য রয়েছে। এখানে ঢালাওভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ নেই। কৃষকের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বীমা প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতার বিষয়টিও দেখতে হবে।

আইডিআরএ’র এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষকের সুরক্ষায় বীমার গুরুত্ব অনুধাবন করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী শস্য বীমা চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। সবাই মিলেই এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চাই। এক্ষেত্রে আমরা পিপিপি’র ধারণাও কাজে লাগাতে পারি। তবে শস্য বীমা প্রকল্প টিকিয়ে রাখার জন্য টেকনিক্যাল বিষয়গুলো এবং তথ্যের সঠিকতা আরো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আগামী বৈঠকে শস্য বীমার প্রোডাক্ট তৈরির সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানান ড. শেখ মহ. রেজাউল ইসলাম।