সাড়ে ২১ কোটি টাকার লোকসান গোপন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের

বিশেষ প্রতিবেদক: লোকসান গোপন করেছে নন-লাইফ বীমা কোম্পানি প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। আর্থিক প্রতিবেদনে গোঁজামিল দিয়ে আয় ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্যয় বেশি হলেও তা আড়াল করে দেখানো হয়েছে মুনাফা। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যয়ের অন্যতম খাত নেট ক্লেইম। কোম্পানির নিজস্ব খাত থেকে যে দাবি পরিশোধ করা হয় তাকে নেট ক্লেইম বলা হয়। আর গ্রাহককে যে পরিমাণ টাকা বীমা দাবি বাবদ পরিশোধ করা হয় তা থেকে রি-ইন্স্যুরেন্সের আদায়কৃত টাকা বাদ দিয়েই নেট ক্লেইমের হিসাবটি করা হয়।

আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,  ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল এই ৩ বছরে বীমা ব্যবসা থেকে ২১ কোটি ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৫ টাকা লোকসান করেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। অথচ তা গোপন করে নেট মুনাফা দেখানো হয়েছে ১৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

বীমা বিধিমালা- ১৯৫৮ এর ৬৬ (ক) অনুযায়ী নেট ক্লেইম হিসাব করা হয়- মোট পরিশোধিত দাবি (-) চলতি বছরে রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ আদায়কৃত টাকা (-) চলতি বছরে রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ আদায়যোগ্য টাকা (+) রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ বকেয়া দাবি (-) চলতি বছরের সরকারি বীমা দাবির বিপরীতে রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ আদায়কৃত টাকা (+) চলতি বছরে বকেয়া দাবি (-) গত বছরের বকেয়া দাবি ।

প্রাইম ইন্স্যুরেন্স এই সূত্র অনুযায়ী নেট ক্লেইমের হিসাব করেনি। ফলে কমে গেছে নেট ক্লেইম। এতে আয়ের তুলনায় ব্যয় কম দেখিয়ে মুনাফা হিসাব করেছে কোম্পানিটি। অন্যদিকে আর্থিক প্রতিবেদনে নেট ক্লেইমের এই হিসাব উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোম্পানিটি তা করেনি।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে গ্রস ক্লেইম ৫ কোটি ৬২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫৭ টাকা। এ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে চলতি বছরের রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভারী (আদায়কৃত) বাবদ ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৩১ হাজার ৮৯১ টাকা। যোগ করা হয়েছে চলতি বছরের বকেয়া দাবি বাবদ ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৩৭১ টাকা। বাদ দেয়া হয়েছে রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভার্ড পিএসবি বাবদ ৩ লাখ ৮ হাজার ৪৮৮ টাকা। বাদ দেয়া হয়েছে গত বছরের বকেয়া দাবি বাবদ ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ৯৫৮ টাকা। এই হিসেবে কোম্পানিটি নেট ক্লেইম দেখিয়েছে ৪৫ লাখ ২০ হাজার ৮৯৭ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের ব্যালান্স শীটের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ বকেয়া ৯৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৪০ টাকা মোট বীমা দাবি থেকে বাদ দেয়া হয়নি। একইভাবে গত বছরের রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ ১৭ কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৮ টাকা বকেয়া দেখানো হলে তা মোট বীমা দাবির সাথে যোগ করা হয়নি। এটা করা হলে নেট ক্লেইমের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯৯ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের মোট আয় ৩৫ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মোট ব্যয় হয়েছে ২৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে নেট ক্লেইম বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৫ লাখ ২০ হাজার ৮৯৭ টাকা। ফলে প্রফিট হয়েছে ৫ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ নিয়ম অনুসারে নেট ক্লেইম ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯৯ টাকা। এতে কোম্পানিটি লোকসান হয় ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯৯ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে গ্রস ক্লেইম ৯ কোটি ৬০ লাখ ২৩ হাজার ৮৪০ টাকা। এ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে রিইন্স্যুরেন্স ক্লেইম লস  রিকভার্ড  (আদায়কৃত) বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ ৫২ হাজার ৬০৪ টাকা। ৬ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৭০ টাকা বাদ দেয়া হয়েছে রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভারেবল (আদায় যোগ্য) বাবদ।

যোগ করা হয়েছে চলতি বছরের বকেয়া ক্লেইম ৬ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৬ টাকা। বাদ দেয়া হয়েছে, রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভার্ড পিএসবি ৪১ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৮ টাকা। বাদ দেয়া হয়েছে গত বছরের বকেয়া ক্লেইম ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৩৭১ টাকা। এই হিসেবে  কোম্পানিটি নেট ক্লেইম দেখিয়েছে ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৯১ হাজার ৮২১ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের ব্যালান্স শীটের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরে (২০১৭) রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ বকেয়া ৭ কোটি ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৯ টাকা যোগ করা হয়নি। একইভাবে যোগ করা হয়নি গত বছরের (২০১৬) রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ বকেয়া ১৮ কোটি ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৮ টাকা। এটা করা হলে কোম্পানিটির নেট ক্লেইমের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ কোটি ২২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯২ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালের মোট আয় ৪৪ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মোট ব্যয় হয়েছে ৩৮ কোটি ১০ লাখ ৬১ হাজার ৮৯২ টাকা। এর মধ্যে নেট ক্লেইম বাবদ ব্যয় ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকা। ফলে প্রফিট হয়েছে ৬ কোটি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ নিয়ম অনুসারে নেট ক্লেইম ১৫ কোটি ২২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯২ টাকা ধরা হলে আলোচ্য বছরে কোম্পানিটির লোকসান হয় ৫ কোটি ৩২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯২ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে গ্রস ক্লেইম ১৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৮ টাকা। এই টাকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম লস রিকভার্ড (আদায়কৃত) বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০ টাকা। ১৩ কোটি ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার ২৯৩ টাকা বাদ দেয়া হয়েছে রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভারেবল (আদায় যোগ্য) বাবদ। যোগ করা হয়েছে চলতি বছরের বকেয়া ক্লেইম বাবদ ৬ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ২ কোটি ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৮ টাকা বাদ দেয়া হয়েছে রি-ইন্স্যুরেন্স রিকভার্ড পিএসবি বাবদ। বাদ দেয়া হয়েছে গত বছরের বকেয়া ক্লেইম ৬ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৬ টাকা।

এই হিসেবে কোম্পানিটি নেট ক্লেইম দেখিয়েছে ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫৭ টাকা।

অথচ গত বছরের (২০১৭) রিইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বকেয়া ২৫ কোটি ৩৭ লাখ ৫ হাজার ৭৭ টাকা গ্রোস ক্লেইমের সাথে যোগ করা হয় নাই। বাদও দেয়া হয় নাই। এছাড়া চলতি বছরের (২০১৮) রিইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ বকেয়া ১১ কোটি ৯৭ লাখ ১৫৪ টাকা। গ্রস ক্লেইমের সাথে রি-ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম বাবদ চলতি বছরের বকেয়া বাদ দিয়ে ও গত বছরের বকেয়া যোগ করে হিসাব করা হলে কোম্পানিটির নেট ক্লেইমের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৮ লাখ ২১ হাজার ৫০৪ টাকা।

এই হিসেবে কোম্পানিটি নেট ক্লেইম কম দেখিয়েছে ১২ কোটি ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৭ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে মোট আয় করেছে ৪০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মোট ব্যয় ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার।  এর মধ্যে ৬১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নেট ক্লেইম ঋণাত্মক দেখানো হয়েছে। সে হিসেবে প্রফিট দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ নিয়ম অনুসারে নেট ক্লেইম ১২ কোটি ৭৮ লাখ ২১ হাজার ৫০৪ টাকা ধরা হলে কোম্পানিটির লোকসান হয় ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৯১ হাজার ৫০৪ টাকা।

এসব বিষয়ে লিখিতভাবে জানতে চাইলে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের পক্ষ লোকসান গোপন করার বিষয়ে কোনো জবাব দেয়নি। তবে কোম্পানিটি থেকে জানানো হয়, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সকল দাবি পরিশোধ করা হয়েছে কোম্পানির এফডিআর ভেঙ্গে। এই টাকা সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে রি-ইন্স্যুরেন্স ট্রিটি, ফ্যাকালটেটিভ, সিডেড ও বিদেশী রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছে পাওনা। ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বিদেশী রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছে পাওনা টাকা রিসিবেবল হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই টাকা আদায় হলে রিসিবেবলের পরিমাণ কমবে। একইসাথে এফডিআর বাড়বে।

কোম্পানিটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, বীমা আইন, বিএসইসি আইন ও কোম্পানি আইনের ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানির অভ্যন্তরীন নিরীক্ষকও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ এজিএমের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদনের অনুমোদন করেছেন। তাই গোঁজামিল দিয়ে হিসাব তৈরীর সুযোগ নেই।

 ।