জালিয়াতির ২৪ কোটি টাকা নয়, ১২ কোটি টাকাই পেল জুট টেক্সটাইল মিল

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভাউচার জালিয়াতি করে তৈরি করা ২য় সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে ২৪ কোটি টাকা নয়, ১ম সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে বীমা দাবির ১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকাই নিতে হলো জুট টেক্সটাইল মিলকে। আজ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জুট টেক্সটাইল মিলের প্রতিনিধির হাতে বীমা দাবির এ চেক তুলে দেয় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স।

জুট টেক্সটাইল মিলের বীমা দাবি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, ২৪ কোটি টাকার জালিয়াতির ২য় সার্ভে প্রতিবেদন নয়, ১২ কোটি টাকার প্রথম প্রতিবেদনই সঠিক। ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডির এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমলে নেন মহামান্য আদালাত।

অন্যদিকে জুট টেক্সটাইল মিল আদালতে সারেন্ডার করে ২য় সার্ভে রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে ১ম সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে বীমা দাবির টাকা পরিশোধের নির্দেশদানের আবেদন করে।

এর প্রেক্ষিতে আদালত ১ম সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে ১২ কোটি টাকা ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেন। অন্যদিকে ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধ না হলে বিলম্বিত সময়ের জন্য ১০ শতাংশ সুদসহ পরিশোধের নির্দেশ দেন। আদালতের ওই নির্দেশনা অনুসারে এ দাবি পরিশোধ করা হয়।

জানা যায়, খুলনার দিঘলিয়ায় অবস্থিত রফতানিমুখী জুট টেক্সটাইল মিলের ১ নং শেড আগুনে পুড়ে যায় ২০১৬ সালের ৪ মে সকালে। যার সম্পদ বীমা করে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, পলিসি নং সিআইএল/কেএইচএল/আইএআর/পি০০০১/০৩/২০১৬। অগ্নিকাণ্ডের পর ৯ ও ১৫ মে ২০১৬ তারিখে বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনকে প্রথম জরিপকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

কাগজপত্র ও কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রথম যৌথ বীমা জরিপকারী কর্তৃক নিরুপতি ক্ষতির অংক ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬১৪ টাকা। কিন্তু প্রথম জরিপকারীরা সরোজমিনে পরিদর্শন করেনি উল্লেখ করে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের আবেদন জানায় বীমা গ্রহীতা জুট টেক্সাটাইল মিলস। অগ্নিকাণ্ডের ১৯ মাস পর দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী হিসেবে নিয়োগ পায় ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশন।

দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী কর্তৃক নিরুপতি ক্ষতির অংক ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা উল্লেখ করে। এতে প্রথম যৌথ জরিপকারীর চেয়ে টাকার অংক বেড়ে যায় ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জুট মিল কর্তৃপক্ষের দেয়া কারখানা সংস্কারের ৯৬টি বিল ভাউচারের ভিত্তিতে টাকার অংক প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানায় দ্বিতীয় জরিপকারীরা।

ভূয়া ভাউচারের ভিত্তিতে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছে বলে আপত্তি তোলে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানির অভিযোগ আমলে না নিয়ে উভয় পক্ষের শুনানী করে ২য় সার্ভেয়ারের রিপোর্টের ভিত্তিতে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে দাবি বাবদ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

একইসাথে দাবি পরিশোধ না করায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের অগ্নি বীমার লাইসেন্স ৩ মাসের জন্য স্থগিত করে দেয়। অপর দিকে সার্ভে রিপোর্টে ক্ষয়-ক্ষতির অবমূল্যায়ন করার অভিযোগে ১ম সার্ভে প্রতিষ্ঠান মেসার্স বাল্টিক কন্ট্রোল (বিডি) লিমিটেড এবং দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশন এর লাইসেন্সও বাতিল করে আইডিআরএ।

জুট টেক্সটাইল মিলসের ২য় সার্ভে রিপোর্টে ৯৬টি ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে ১২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার দাবি ২৪ কোটি টাকা করার তথ্য প্রমাণসহ “১২ কোটি টাকা রাতারাতি হলো ২৪ কোটি টাকা: এবার বীমা গ্রাহক জুট টেক্সটাইল মিলের ভয়াবহ জালিয়াতি”  শীর্ষক সরেজমিন ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি।

১ম পর্ব:

১২ কোটি টাকা রাতারাতি হলো ২৪ কোটি টাকা এবার বীমা গ্রাহক জুট টেক্সটাইল মিলের ভয়াবহ জালিয়াতি

তিন পর্বের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল কীভাবে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার বিল-ভাউচার জালিয়াতি, করে,  দোকানীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে বীমা দাবি। বীমা গ্রহীতা জুট টেক্সটাইল মিল ও ২য় জরিপকারীদের যোগসাজসে জালিয়াতি করে রাতারাতি ১২ কোটি টাকার বীমা দাবি হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।

প্রথম ও দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনের বীমা দাবির অংক দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। অথচ বিল-ভাউচার যাচাই-বাছাই না করে রহস্যজনকভাবে ২৪ কোটি টাকা বীমা দাবি ৭ দিনের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । এমনকি এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমলে না নিয়েই একতরফা রায় দিয়েছে আইডিআরএ।

২য় যৌথ জরিপকারী কর্তৃক নিরুপতি ক্ষতির অংক ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা উল্লেখ করে। এতে প্রথম যৌথ জরিপকারীর চেয়ে টাকার অংক বেড়ে যায় ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জুট মিল কর্তৃপক্ষের দেয়া কারখানা সংস্কারের ৯৬টি বিল ভাউচারের ভিত্তিতে টাকার অংক প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানায় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। পরে দেয়া সমুদয় বিল ভাউচার সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করে দেখার ‘সত্যতা নিশ্চিত’ করার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

রহস্যজনক সেই ৯৬টি বিল ভাউচার নিয়ে ঢাকা ও খুলনায় অনুসন্ধানে নামে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। জুট টেক্সটাইল মিলস কর্তৃপক্ষের দেয়া এবং দ্বিতীয় জরিপকারীদের প্রত্যায়ন করা ৯৬টির মধ্যে দু’টি বিল দেখানো হয়েছে চিন্ময় এন্টারপ্রাইজ নামে; ঠিকানা ৩৯২ নিউ ইস্কাটন রোড, মগবাজার, ঢাকা-১০০০। চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের নামে ১৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে ৮২ লাখ ৬৬ হাজার ৪’শ টাকার এবং ২৭ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে ১ কোটি ৮১ লাখ ৩২ হাজার টাকার বিল দেখানো হয়েছে।

২য় পর্ব:

জুট টেক্সটাইল মিলের বীমা দাবি জালিয়াতি: ২য় পর্ব ৯৬ ভাউচারের ৩৫টিই তৈরি জরিপ প্রতিবেদনের পরে

চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের বিলে ব্যবহৃত ৩৯২ নিউ ইস্কাটন রোডের ঠিকানায় গিয়ে জানা গেল সেটি একটি ঔষধ কোম্পানির মালিকের অফিস ও বাসা। দু’ এক বছর নয়, গেল ৪০ বছর ধরে এখানে ঔষধ কোম্পানির রয়েছে বলে জানান গেটের বৃয়োবৃদ্ধ দারোয়ান।  অস্তিত্বহীন সেই প্রতিষ্ঠানের নামে দুই কোটি ৬৪ লাখ টাকার বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে। বীমা গ্রহীতার ভূয়া এসব বিল সঠিক এবং সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা যাচাই করা হয়েছে বলে লিখিতভাবে জানায় দ্বিতীয় জরিপকারী আতিকউল্লাহ।

এখানেই শেষ নয়, জালিয়াতির চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের কথিত মালিকের পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও স্বাক্ষরকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সুনির্দিষ্টভাবে জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপনের পরও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা রহস্যজনকভাবে আতিকউল্লাহ’র কথার ভিত্তিতে ২৪ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

ভূয়া ভাউচারের ভিত্তিতে সাজানো সার্ভে রিপোর্টের রহস্যজনক ৯৬টি বিলের বেশ কিছু দেখানো হয়েছে খুলনার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এরমধ্যে খুলনার দিপু ইঞ্জিনিয়ারিং নামে লেদ কারখানার নামে ১৫ লাখ টাকার বিল দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী। অবিশ্বাস্যভাবে জুট টেক্সটাইল মিলস বিল পরিশোধ দেখিয়েছে ৭ দিন আগে অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি। একইভাবে খুলনার এ আর ফাংশন ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিল ইস্যু করে ২২ ডিসেম্বর ২০১৬। এখানেও মিল কর্তৃপক্ষের টাকা পরিশোধ সীল ও স্বাক্ষর রয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬।

শুধু বীমাখাত নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিল দেয়ার আগে টাকা পরিশোধের নজিরবিহীন বলে মনে করে বীমাখাত বিশ্লেষকরা। ২য় জরিপ প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বিল উত্থাপনের আগে টাকা পরিশোধের প্রমাণ থাকার পরও আইডিআরএ’র শুনানী সভার সদস্যরা তা এড়িয়ে যান।

৩য় পর্ব:

বীমার টাকা পেতে জুট টেক্সটাইল মিলের জালিয়াতি: পর্ব-৩ চিঠি গোপন করে নিরাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে আইডিআরএ

অথচ কোনো ধরনের পর্যালোচনা-অনুসন্ধান-প্রমাণ ছাড়াই ১ম সার্ভেয়ারের জরিপ প্রতিবেদন মিথ্যা বলে তাদের লাইসেন্স স্থাগিত করেছিল আইডিআরএ।  অথচ সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থায় জালিয়াতি করে বীমা দাবি দ্বিগুণ করে কোটি কোটি হাতিয়ে নিতে আতিকুল্লাহর সার্ভে কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বীমা আইন ২০১০ অনুযায়ী জালিয়াতি করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বীমা দাবি কমানো বা বাড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শেষ পর্ব