নিয়োগ নবায়ন ছাড়া আড়াই মাস মূখ্য নির্বাহী দীপেন কুমার, নিয়েছেন বেতন-ভাতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: নিয়োগ নবায়ন ছাড়া আড়াই মাস ধরে প্রগ্রেসিভ লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন দীপেন কুমার সাহা রায়। এসময় তিনি পূর্ণ বেতন-ভাতা নিয়েছেন। নিয়ম অনুসারে আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কোন ব্যক্তির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থাকা অবৈধ। বেতন-ভাতা নিলে তা হবে মানি লন্ডারিং।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুসারে, দীপেন কুমারের সর্বশেষ ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ১৬ অক্টোবর। এরপরও তিনি ২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রগ্রেসিভ লাইফে মূখ্য নির্বাহী পদে ছিলেন। চুক্তি অনুসারে দীপেনের মাসিক বেতন-ভাতা ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এই হিসাবে আড়াই মাসে দীপেন কুমার বেতন-ভাতা নিয়েছেন প্রায় ১১ লাখ টাকা। এছাড়া পিএফ ও ইএল বাবদ ৩১ লাখ টাকার চেক নেন তিনি। তবে কোম্পানির নিয়ম বহির্ভূত হওয়ায় চাপের মুখে নগদায়নের অনুমোদন পাননি দীপেন।

তথ্য অনুসারে, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দীপেন কুমারের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর। এর আগে গত ১ অক্টোবর পরবর্তী বোর্ড সভা পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়মিত দায়িত্ব পালনের অনুমোদন চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন জানান কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান জাকারিয়া আহাদ। কিন্তু মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দিপেন কুমার সাহা রায়ের নিয়োগ নবায়ন বা ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ থেকে কোনো অনুমোদন দেয়নি।

তবে আইডিআরএ’র অনুমোদন না পেলেও তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। এসময়ে তিনি অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সই-স্বাক্ষর করেন। আইডিআরএ’র কাছেও পাঠানো চিঠিপত্রে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে স্বাক্ষর করেন দীপেন কুমার।

সূত্র মতে, দীপেন কুমার মূখ্য নির্বাহী পদ থেকে কবে অব্যাহতি নিয়েছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ৭ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রগ্রেসিভ লাইফ জানায়, কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান আজাদীকে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন কোম্পানি সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মো. জহির উদ্দিন। বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, গত ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কোম্পানির ১৫৮তম পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত এটি।

এসব বিষয়ে জানতে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মো. জহির উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আজাদী’র সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এদিকে প্রগ্রেসিভ লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আজাদী’র সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে তার মোবাইল ফোন এবং অফিসের পিএবিএক্স নম্বরে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে বিষয়টি নিয়ে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র সঙ্গে কথা বলেছেন প্রগ্রেসিভ লাইফের বোর্ড অব অ্যাফেয়ার্স সৈয়দ বেলাল হোসেন। তিনি জানান, দীপেন কুমার সাহা রায়’র নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৬ অক্টোবর, ২০১৯। এর আগেই একটি এজিএম ছিল। কিন্তু কয়েকজন ডাইরেক্টর দেশের বাইরে যাওয়ায় সেই মিটিং করা সম্ভব হয়নি।

এ অবস্থা গত ১ অক্টোবর বর্তমান চেয়ারম্যান পরবর্তী সভা পর্যন্ত সিইও’র দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন জানান। কিন্তু বেশ কিছু দিন পার হলেও আইডিআরএ থেকে কোন জবাব আসেনি। এ অবস্থায় সিইও’র দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখা হয়। তবে গত ৭ জানুয়ারি আইডিআরএ থেকে তার অনুমোদন না দেয়ার বিষয়টি জানিয়েছে।

এর আগে গত ২ জানুয়ারি কোম্পানির ১৫৮তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দীপেন কুমারকে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে নিয়োগ চুক্তি মোতাবেক সকল পাওনা পরিশোধের নির্দেশনা দেয়া হয়।

সে অনুযায়ী চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পিএফ ও ইএলসহ বেতন-ভাতা বাবদ ৩১ লাখ ৬শ’ টাকার চেক নিয়েছিলেন দীপেন কুমার সাহা রায়। কিন্তু কোম্পানি আইন অনুসারে তিনি পিএফ ও ইএল সুবিধা পান না। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তার পেমেন্ট আটকে যায়। বর্তমানে তার বিষয়গুলো নিয়ে অডিট চলছে। তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার নিয়োগ চুক্তি মোতাবেক সকল পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে।

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সিইও’র দায়িত্ব পালন এবং বেতন-ভাতা গ্রহণ বীমা আইনে অবৈধ এবং মানিলন্ডারিং আইন পরিপন্থী হওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ একটি চিঠি পাঠিয়েছে কোম্পানিকে। ভারপ্রাপ্ত সিইও এবং সিএফও বিষয়টির জবাব পাঠানোর কথা। তবে আমার জানামতে এখন পর্যন্ত চিঠির জবাব দেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে দীপেন কুমার সাহা রায়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৮০ এবং মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানের প্রবিধি-৪ এর উপ-প্রবিধি ৫ মোতাবেক পরিচালনা পর্ষদের কোন প্রস্তাবিত ব্যক্তির নিয়োগ প্রস্তাব বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিয়োগ নবায়ন প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে বেতন ভাতাদিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন না। এটা অবৈধ, আইনের লঙ্ঘন এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর বিধানপরিপন্থী।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং জিএডি ১৩/২০১৫ অনুসারে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া বা চুক্তি বাতিলপূর্বক পদত্যাগ করা বা কোম্পানি কর্তৃক অপসারণ হওয়ার কারণে পদ শূন্য হলে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে উক্ত শূন্য পদে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে নিয়োজিত যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাকে তার বর্তমান দায়িত্বের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারবেন, তবে এর মেয়াদ ৩ মাসের অধিক হবে না।

এ ছাড়াও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২-এর ধারা ৪ অনুসারে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের পূর্বে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত, সম্মানী প্যাকেজ এবং তাকে নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন সংক্রান্ত বোর্ড সভার কার্যবিবরণীসহ আবেদন করতে হবে। কিন্তু বোর্ড সভায় কোন ধরনের অনুমোদ না নিয়েই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দিপেন কুমারের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান জাকারিয়া আহাদ।

জানা গেছে, প্রগ্রেসিভ লাইফের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আহাদের ঘনিষ্টজন দীপেন কুমার সাহা রায়। এ কারণে কোম্পানির অবনতি সত্ত্বেও আইন লঙ্ঘন করেই বহাল তবিয়তে ছিলেন তিনি। এমনকি দীপেন কুমারের বিরুদ্ধে জীবন বৃত্তান্ত ও অভিজ্ঞতার সনদে মিথ্যা তথ্য দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও অদৃশ্য কারণে তার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর এক চিঠিতে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে জানায় আইডিআরএ।