এজেন্ট কমিশন বীমা গ্রাহককে প্রদান বীমা শিল্পের বিকাশে প্রধান অন্তরায়

খুলনা বীমা মেলা উপলক্ষ্যে “বাংলাদেশে বীমার সম্ভাবনা” নামে সুভেনিয়র প্রকাশ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খলিল আহমদ সেখানে “এজেন্ট কমিশন বীমা গ্রাহককে প্রদান বীমা শিল্পের বিকাশে প্রধান অন্তরায়” শীর্ষক গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটি তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশে বীমা শিল্পের বিকাশে কয়েকটি প্রধান অন্তরায়ের মধ্যে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের (বীমাকারী) অসুস্থ কমিশন ব্যবসা পরিচালনা, আস্থাহীনতা এবং লাভজনক বীমা পলিসির (পরিকল্প) অনুপস্থিতি অন্যতম। এই আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ হচ্ছে বীমা দাবি প্রাপ্তিতে বিলম্ব, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবির অর্থ পেলেও লভ্যাংশ প্রদানে বীমাকারীর সক্ষমতার অভাব এবং পরিকল্পসমূহকে আকর্ষণীয় করার ব্যর্থতা। জনসাধারণকে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত করার সুযোগ না থাকায় বীমা ব্যবসাকে এখনো জনপ্রিয় করা যায়নি। বীমা ব্যবসায় সাথে জড়িতদের মধ্যে করপোরেট কালচারের চর্চা নেই এবং অন্যদিকে স্বল্প শিক্ষিত-প্রশিক্ষণবিহীন-অদক্ষ লোকের দ্বারা অধিকাংশ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হওয়ায় শিল্পটির বিকাশ ঘটছে না। বীমা শিল্পের বিকাশের জন্য এ পেশার সাথে জড়িত বীমা কর্মীদের যেমন প্রয়োজন আন্তরিকতার তেমনি প্রয়োজন বীমা শিল্পের উপকারিতার ব্যাপক প্রচার। বীমা পলিসি গ্রহণে শিক্ষিত ও শ্রেণীর তরুণদের আকৃষ্ট করাতে বীমা প্রতিষ্ঠানের চরম ব্যর্থতা। বীমা দাবি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে সকল অভিযোগ পাওয়া যায় সে সকল অভিযোগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বার বার বীমাকারীর নিকট আবেদন করেও গ্রাহক প্রকৃত বীমা দাবি পায় না। লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা অভাব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতা।

বাংলাদেশ লাইফ (জীবন বীমা) এবং নন-লাইফ (সাধারণ বীমা বা সম্পদের বীমা) দু' খাতে ৭৯টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত এবং বড় দেশেই এত অধিক সংখ্যায় বীমা প্রতিষ্ঠান নেই। বাংলাদেশে আমেরিকার লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং লাইফ বীমার ব্যবসার এক-তৃতীয়াংশই ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। আমরা মালেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং জার্মানীতে শিক্ষা সফরে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাতে দেখছি উন্নত দেশে পৃথিবীর বৃহৎ বিদেশী বীমা কোম্পানিসমূহ এবং দেশীয় বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগে সফলভাবে ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ বীমাকারীর সম্পদের ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগের দক্ষতা এবং বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা জনসাধারণের মধ্যে তথা বীমা গ্রাহকের মধ্যে একটি বড় ধরণের আস্থা সৃষ্টি করে থাকে যার ফলে বৃহৎ বীমাকারীর গ্রাহক সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতেই থাকে। বাংলাদেশে অধিকাংশ বীমা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র আকারের এবং এই ক্ষুদ্র আকারের প্রতিষ্ঠানের চরম অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এ শিল্পের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে।

আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বীমা ব্যবসায়ীরা সংগৃহীত ব্যবসার সম্পূর্ণ অংশের অপব্যবহার করার যে সুযোগ গ্রহণ করে শিল্পটির সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে। অথচ বিভিন্ন দেশে বীমাকারীদের সমিতি আইন সংগতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে বীমার উন্নয়নে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। লাইফ এবং নন লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠান উভয়ই ব্যবসা সংগ্রহ করে এজেন্টের মাধ্যমে এবং সারা বিশ্বে বীমা সেক্টরে এজেন্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে যদিও অধিকাংশ দেশেই ব্যাংকএস্যুরেন্সের মাধ্যমে বীমার পলিসিসমূহ বিক্রয় হচ্ছে। এজেন্টকে ব্যবসা সংগ্রহের জন্য একটি কমিশন দেয়া সমগ্র বিশ্বে এটি আইনসিদ্ধ ব্যবস্থা। পৃথিবীর সব দেশেই এজেন্টকে তাদের প্রাপ্য কমিশন প্রদান করা হয়। যে দেশে বীমা ব্যবসা খুব সফলভাবে চলছে সে দেশে এজেন্ট মোটামুটিভাবে সচ্ছল এবং ধনী হয়ে যায়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের কোন কোন দেশে বা উন্নয়নশীল দেশে এজেন্টদেরকে ধরে রাখা বীমাকারীদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ স্বল্পশিক্ষিত এসকল এজেন্টের দ্বারা ক্ষুদ্রবীমা পলিসিসমূহ বিক্রয় করা হয় এবং বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কমিশন প্রদানে অস্বচ্ছতা, সুপারভাইজারগণকে কমিশন প্রদান, বৃহৎ পরিকল্প বিক্রয়ে নিকট আত্মীয়কে এজেন্ট হিসেবে দেখানো বা ছদ্দবেশী (অস্তিত্ববিহীন) এজেন্টের মাধ্যমে পরিকল্পগুলো বিক্রয় দেখিয়ে বীমা প্রতিষ্ঠান কমিশনের অর্থ আত্মসাত করে থাকে। আবার স্বল্পশিক্ষিত এজেন্টের দ্বারা বিক্রয়কৃত ক্ষুদ্রবীমা পলিসিসমূহ যথাযথভাবে অবলিখন (আন্ডাররাইটিরং) না করায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিসিসমূহ তামাদিতে পরিণত হয়। যার ফলে একদিকে যেমন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যদিকে এজেন্টের স্থায়িত্ব বজায় থাকে না অর্থাৎ পারসিসটেন্সির হার কমে গিয়ে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে লাইফ এবং নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় প্রিমিয়ামের ওপর কমিশনের হার নির্ধারিত রয়েছে। উন্নত দেশে প্রিমিয়াম বা কমিশনের হার সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা হয় না এবং এ হার নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারণ উন্নত দেশে প্রিমিয়ামের হার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ধার্য করা হয় অর্থাৎ টেন্ডারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামের বা কমিশনের হার নির্ধারণ হয়ে থাকে। নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক প্রিমিয়ামের হার নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে নন-টেরিফ মার্কেট ব্যবস্থা বলা হয়ে। নন-টেরিফ মার্কেটের বড় সুবিধা হচ্ছে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের সামর্থ অনুসারে স্বনির্ধারণী প্রিমিয়াম হারে ব্যবসা সংগ্রহ করে। কোম্পানি সলভেন্ট থাকলে এবং ক্লেইম রেশিও কম হলে অধিক ব্যবসা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রিমিয়ামের হার কমিয়ে দেয়। দেশে দেশে সলভেন্সি মার্জিন বিধির মাধ্যমে কোম্পানির দায় পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করা হয়। সলভেন্সি মার্জিন রেশিও কাংখিত মাত্রায় না থাকলে কোন কোম্পানির বীমা দায় পরিশোধের অক্ষমতা প্রকাশ করে ফলে উক্ত কোম্পানি ব্যবসা চালু রাখতে পারে না এবং অন্য একটি কোম্পানির সাথে একীভূত হয়ে যেতে হয়। আমাদের দূর্ভাগ্য এখনো আমরা সলভেন্সি মার্জিন বিধি প্রণয়ন করতে পারিনি।

বাংলাদেশে সলভেন্সি মার্জিন বিধিমালা না থাকায় বীমাকারীসমূহ কমিশনের নামে অবৈধ ব্যবসা করায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও বীমা শিল্পের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। উন্নত দেশে এবং উপমহাদেশের অনেক দেশে যেখানে ২০% হারে প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অথচ বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২০১৮ সালের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৭% এবং যদি আমরা মুদ্রাস্ফীতিকে বিবেচনায় করলে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক পর্যায়ে হবে।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বীমা খাতের দ্রুত উন্নতির অন্যতম বাধা হচ্ছে অস্বচ্ছ কমিশন ব্যবস্থা। প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় বীমা এজেন্টকে কমিশন প্রদান করার বিধান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ লাইফ এবং নন-লাইফ বীমা ব্যবসা উভয় ক্ষেত্রেই বীমা গ্রাহককে কমিশন প্রদানের একটি অস্বচ্ছ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে নন-লাইফ বীমা ব্যবসায় গ্রাহককে কমিশন প্রদান এবং কমিশনের কিছু অংশ বীমাকারীর কর্তৃক আত্মসাতের প্রক্রিয়া বীমা দাবি পরিশোধের বীমাকারীর সক্ষমতাকে দারুণভাবে কমিয়ে দেয়। নন-লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি ছদ্দবেশী (অস্তিত্ববিহীন) এজেন্ট নিয়োগ করে বা নিয়োগ দেখিয়ে কমিশনের আর্থিক অনিয়ম করে থাকে এবং অনিয়মকৃত অর্থের কিছু অংশ গ্রাহককে প্রদান করে থাকে। এ কারণেই একই ধরণের পরিকল্প বিভিন্ন কোম্পানিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রিমিয়াম হারে বিক্রয় হতে দেখা যায়। মোটর পলিসির গ্রাহকগণ প্রায়শঃই একটি প্রশ্ন করেন যে, বিভিন্ন কোম্পানিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রিমিয়াম হার হয় কেন? প্রকৃতপক্ষে বিমাকারী গ্রাহককে কমিশন সুবিধা দিয়ে গিয়ে প্রিমিয়াম হার কমিয়ে গ্রাহককে কোম্পানির প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে।

অনেক ক্ষেত্রেই প্রিমিয়ামের হার ভিন্ন হয় বীমা পলিসি (পরিকল্প) গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধার ওপরে অর্থাৎ বীমা গ্রাহকের ঝুঁকি আবরণের মাত্রার ওপর প্রিমিয়ামের হার নির্ধারণ হয়ে থাকে। গ্রাহক বীমা পলিসিতে ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড, চুরি এবং দাঙ্গাসহ আরো বেশ কিছু ঝুঁকির আবরণের সুবিধা চাইলে প্রিমিয়ামের হার বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া গাড়ির মূল্য, গাড়ির সিসি এবং আরো কিছু ফ্যাক্টরের ওপরে প্রিমিয়াম হার কম বেশি হতে পারে। তবে একই রকম সুবিধা নিয়ে একই ধরণের গাড়ির জন্য কোম্পানিভেদে প্রিমিয়ামের ভিন্নতার অন্যতম কারণ হচ্ছে অস্বচ্ছ কমিশন ব্যবসা। নন-লাইফ কোম্পানিসমূহ কমিশন গ্রাহককে আকৃষ্ট করার জন্য অনৈতিক প্রতিযোগিতা করে থাকে যা সম্পূর্ণ বীমা আইন বহির্ভূত।

বীমা গ্রাহককে কমিশন প্রদানকারী বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ বীমা দাবি পরিশোধকালে অনেক ধরণের হয়রানি করে থাকে। নন-লাইফ বীমা ব্যবসায় সার্ভেয়ার দ্বারা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। সার্ভেয়ারের সাথে অনেক বীমাকারী একটি অনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে এবং এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অধিক হারে গ্রাহককে কমিশন প্রদান। কমিশনের আশ্রয়ে আর্থিক অনিয়ম বীমাকারীর বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা থাকে না। বীমা গ্রাহক অজ্ঞতার কারণে নির্ধারিত প্রিমিয়ামের একটি অংশ কমিশন হিসেবে গ্রহণ করায় নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে প্রিমিয়ামের প্রদান করে যার ফলে টেরিফ রেট ভঙ্গ করা হয়। বীমা দাবি উত্থাপনকালে এই কম হারে প্রিমিয়াম প্রদানের (টেরিফ রেট ভঙ্গ) কারণে বীমাকারী গ্রাহককে নানাভাবে হয়রানির স্বীকার করে থাকে। এই টেরিফ রেট অবগত হওয়ার জন্য প্রতিটি বীমাকারীর নিজেস্ব ওয়েবসাইটে প্রিমিয়াম হার গণনার জন্য প্রিমিয়াম ক্যালকুলেটারের লিংক প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন করা গেলে বীমাকারী প্রকৃত প্রিমিয়াম হিসেব প্রদান করতে বাধ্য হবে ফলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।

লাইফ বীমা ব্যবসায় আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে কোম্পানিসমূহের বীমা আইনে নির্দেশিত সর্বোচ্চ সীমায় কমিশনের প্রদানের প্রবণতা রয়েছে। বড় আকারের পলিসির বিপুল পরিমাণ অর্থ কমিশন খাতে ব্যয় হচ্ছে এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বীমাকারীর বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে ফলে এই সেক্টরের উন্নতি যে সম্ভাবনা ছিল তা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই কোম্পানিসমূহ সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে নিম্ন হারে এজেন্ট কমিশন প্রদান করে বা অনলাইনে সরাসরি বীমা পলিসি বিক্রয় করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে কোম্পানির সক্ষমতা বাড়ালে উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানির সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পলিসির মোট বীমা অংকের (সামএস্যুরড) ওপর ভিত্তি করে কমিশনের সিলিইং বা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের বিধিমালা প্রণয়ন জরুরি।

দেশের বৃহৎ বীমাকারীসমূহকে দ্রুত গতিতে বীমা ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা নতুন পলিসি বিক্রয়ের হার বৃদ্ধি করতে আগ্রহী না হওয়ার অন্যতম যুক্তি হচ্ছে নতুন নতুন পলিসি গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে বিমাকারীর বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাবে। কারণ মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব থাকায় অধিকাংশ বীমা গ্রাহক নিয়মিত প্রদান না করায় বীমা পলিসি তামাদি হয়ে যায়। এই তামাদির হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি এবং নতুন নতুন বিক্রয়ে বা সংগ্রহে (প্রকিউরমেন্ট) ব্যয়ও অধিক এবং প্রতি একশত টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে একশত টাকার অধিক ব্যবস্থাপনা ব্যয় হয়ে থাকে। অত্যধিক ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে বীমাকারী নুতন বীমা গ্রাহক সংগ্রহে আগ্রহী হয় না। অধিক সংখ্যায় পলিসি বিক্রয় হলে কোম্পানির দায় বৃদ্ধি পেয়ে কোন এক সময়ে কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

অন-লাইনে সরাসরি বীমা পলিসি বিক্রয়ে পলিসি গ্রাহকের ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি (আন্ডাররাইটিং বা অবলিখন) ঠিকভাবে না হলে অনেক রকম সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় এক্ষেত্রে বীমা গ্রাহকের প্রিমিয়াম প্রদানের সক্ষমতা এবং গ্রাহকের মানি লন্ডারিং এর কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা যাচাই বাছাই করা দুরূহ হতে পারে। কিন্তু একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে সরাসরি বীমা পলিসি বিক্রয় করে বীমাকারী ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে হয়ত কমিশনবিহীন এই বিক্রয় পদ্ধতিতে অনেক রকম ঝুঁকি নিতে হবে এবং অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে তবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু করলে সফলতা আসতে পারে।

ব্যাংকএস্যুরেন্স পদ্ধতিতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে বীমা সেক্টরের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। দেশে অদক্ষ-অশিক্ষিত এজেন্ট দ্বারা সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দূরকরণার্থে ব্যাংককে এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে এবং ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাকে পুঁজি করে বিমাকারী ব্যাপক হারে বীমা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারে। এতে ব্যাংক ও বীমাকারী উভয়ই লাভবান হবে এবং অবৈধ কমিশন ব্যবসার প্রবণতা কমে যাবে। ব্যাংকএস্যুরেন্স পদ্ধতিতে একদিকে ব্যাংকের যেমন আয় বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে বীমাকারীকে অশিক্ষিত-প্রশিক্ষণবিহীন এজেন্টের মাধ্যমে গুণগত বীমা পরিকল্প বিক্রয় করতে হবে না।

 

অতিসম্প্রতি বীমা শিল্পের উন্নয়নে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া হয়ঃ

 বীমাকারীর ত্রৈমাসিক তথ্যের ভিত্তিতে সমন্বয় সভা করে ব্যবসায়িক দক্ষতা যাচাই করা হয়;

 প্রথমবারের মত কর্তৃপক্ষের গবেষণাধর্মী বার্ষিক প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়;

 চারটি বীমা মেলা বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে;

 বীমা প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্মেলন করা হয়;

 বীমাকারীর অফিসে অন-সাইট পরিদর্শনের জন্য একটি পরিদর্শন ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা হয়েছে;

 কর্তৃপক্ষের সিটিজেন চার্টার প্রণয়ন করা হয়েছে;

 বীমা শিক্ষা বিষয়ক ভিডিও ক্লিপ আপলোড করতে সকল বীমাকারীকে নির্দেশ দেয় হয় এবং প্রতিটি বীমাকারী তা বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া বীমাকারী তাদের পরিকল্প নিয়ে ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেছে;

 বীমাকারীর ওয়েবসাইট আধুনিক করা হয়েছে;

 বীমকারীর ওয়েবসাইটসমূহ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের সাথে লিংক করা হয়েছে;

 এনআইডিসহ বীমাকারীর ওয়েবসাইটে এজেন্টের তালিকা প্রদর্শনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে;

 বীমা মেলা উপলক্ষে তথ্যবহুল এবং গবেষণাধর্মী স্যুভেনির প্রকাশিত করা হয়েছে;

 স্বাস্থ্য বীমা, কৃষি বীমা, পশু বীমা, দুর্যোগ বীমা, শিক্ষা বীমা, ব্যাংকএস্যুরেন্স পদ্ধতি, প্রবাসীকর্মী বীমা, ডিজিটাইজেশন, মানিলন্ডারিং এবং বীমা সংক্রান্ত অসংখ্য বিধি-বিধান নিয়ে সভা, সেমিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে;

 প্রতিটি বীমাকারীর হটলাইন চালু করা হয়েছে;

 কর্তৃপক্ষের ই-ফাইলিং চালু করা হয়েছে;

 কর্তৃপক্ষের ডাইনামিক ওয়েবসাইট তৈরী করা হয়েছে;

 কর্তৃপক্ষের ই-জিপি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে;

 প্রতি অর্থ বছরে সকল বীমাকারীর ব্যবসার তথ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা হয়েছে;

 কর্তৃপক্ষের লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে; এবং

 কর্তৃপক্ষের কলসেন্টারের জন্য একটি হটলাইনের নম্বর প্রাপ্তির আবেদন করা হয়েছে;

 

বাংলাদেশ বীমা খাতের উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি:

 অবিলম্বে অটোমেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে;

 অবিলম্বে সলভেন্সি মার্জিন বিধিমালা জারি করা এবং অনলাইনে তথ্যে সলভেন্সি মার্জিন রেশিও নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা;

 ভারতের বীমা শিল্পের আদলে বাংলাদেশের লাইফ এবং নন-লাইফ বীমা ব্যবসার জন্য কমিশনের বিধি প্রণয়ন করা;

 কমিশন প্রদানের বিষয়টি অনলাইনে মনিটর করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা;

 এজেন্টের কমিশন ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে প্রদান করা;

 বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সকল সার্কুলার বা অনুশাসন বাস্তবায়ন করা;

 তামাদি পলিসির বন্ধের জন্য এজেন্ট কমিশন বীমা গ্রাহককে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা;

 তামাদি পলিসি বন্ধ করার প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা;

 বীমাকারির ব্যবসার দক্ষতার মূল্যায়নে কেপিআই ব্যবস্থা চালুকরণ;

 প্রত্যেক বীমা প্রতিষ্ঠানে কোম্পানির কর্পোরেট গভর্নেন্স চালুকরণ;

 বীমা আইন ২০১০ সংশোধন করে জরিমানার হার বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা;

 ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রতিটি বীমা গ্রাহকের ঝুঁকি বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করা;

 আরবিএস বা রিক্সবেইজড সুপারভিশন পদ্ধতি চালু করা;

 বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে দক্ষ ও স্থায়ী জনবল নিয়োগ দেয়া;

 বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে আইটি বিশেষজ্ঞ এবং একচ্যুয়ারি নিয়োগ দেয়া;

 ভর্তুকির প্রদানের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক শিক্ষা বীমা চালু করে কোটি কোটি মানুষকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা যা বীমা শিক্ষায় পরোক্ষভাবে অবদান রাখবে;

 সরকারি কর্মচারিদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার প্রচলন এবং জনসাধারণের সার্বজনিন স্বাস্থ্য বীমার চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা;

 নতুন নতুন উদ্বাবনী পরিকল্প প্রণয়ন করা;

 সর্বস্তরের মানুষের জন্য টার্ম ইন্স্যুরেন্সকে জনপ্রিয় করা;

 ট্রেন ও লঞ্চ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মাত্র এক লক্ষ অথবা দু’ লক্ষ টাকা অনুদানের পরিবর্তে এক টাকা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কমপক্ষে দশ লক্ষ টাকা পরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

 ভর্তুকির প্রদানের মাধ্যমে কৃষি বীমা চালু করে কোটি কোটি কৃষকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা;

 প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দুর্যোগ বীমা (ক্যাটেস্ট্রফি বন্ড) প্রচলন করা;

 দারিদ্র দূরীকরণে উদ্বাবনী ক্ষুদ্র বীমা পরিকল্প প্রণয়ন এবং এর ব্যাপক প্রচার করা;

 দেশীয় অথবা বিদেশী পুনঃবীমাকারী ব্যবসার প্রসার ঘটানো;

 হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর ভূমিকম্প এবং অগ্নিবীমা বাধ্যতামূলক করা;

 মালেশিয়ার আদলে তাকাফুল বীমা (ইসলামি বীমা) চালু করা; এবং

 বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বীমাকারীর জন্য ক্রেডিট রেটিং বিধিমালা প্রণয়ন করা;

বাংলাদেশে বীমা শিল্পকে উন্নত করতে হলে কমিশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বীমা সমিতিগুলোকে আন্তরিকতার সাথে বীমা উন্নয়নের স্বার্থে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত বিধিবিধান পরিপালনের অঙ্গীকার করতে হবে।