ব্যাংকাস্যুরেন্স: ব্যাংক-বীমা খাতের সম্ভাব্য জিয়নকাঠি

মো. নূর-উল-আলম, এসিএস: বাংলায় বীমা ব্যবসার ইতিহাস দু’শত বছরেরও বেশি পুরনো। কেননা ভারত বর্ষের প্রথম বীমা কোম্পানি ওরিয়েন্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৮১৮ সালে। বৃটিশ ভারতে বীমা শিল্প বেশ সমৃদ্ধ ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বীমা ব্যবসাও বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইন্স্যুরেন্স বা বীমা শিল্প তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে খাতটি বেশ সমৃদ্ধ ছিল, ছিল বিশ্বমানের- বিশ্ববাজারের অংশ। সেই সময় বিদ্যমান ৪৯টি বীমা কোম্পানির মধ্যে ১০টির প্রধান কার্যালয় ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, ২৭টির প্রধান কার্যালয় ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাকী ১২টি বীমা কোম্পানির প্রধান অফিস ছিল পাকিস্তানের বাইরে বিশ্বের নানা দেশে। অন্যান্য দেশ যে খাতে এগিয়েছে সামনের দিকে, আমরা রয়ে গেছি সেই তিমিরেই; সত্তোরের দশকের যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে। উন্নত দেশগুলোর জিডিপিতে বীমার অবদান গড়ে দশ শতাংশের মতো। অথচ বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমা কোম্পানিগুলোর অবদান মাত্র দশমিক নয় শতাংশ। অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম!

শুধুমাত্র গ্রাহকদের আস্থাহীনতা, ব্যাংকের এক শ্রেণির শাখা ব্যবস্থাপক এবং বীমাগ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের লোভের কারণে সম্ভাবনার এ বাজার আজ দিকভ্রান্ত নাবিকের মত চলছে। এককথায় জীবন বীমা কোম্পানিগুলো ধুঁকছে গ্রাহকদের আস্থাহীনতা তথা আস্থার অভাবে এবং সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো এক শ্রেণির ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক এবং বীমাগ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের লোভে। অথচ কোন রকম নজরদারি এবং করের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে সেসব ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপকবৃন্দ এবং বীমাগ্রাহক কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। এদিকে সম্প্রতি ব্যাংক শিল্পও আশানুরূপ ফল দিচ্ছে না। সুতরাং ব্যাংকাস্যুরেন্সই হতে পারে এর অন্যতম সমাধান। কারণ ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বীমা পণ্য বিক্রি করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হতো সহজেই ।

বীমাখাতে বিদ্যমান পণ্য বা সেবার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জীবন বীমার অনেকগুলো পলিসি বা পণ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত মেয়াদী হিসাবের অনুরূপ। কিন্তু এর বাড়তি সুবিধা হলো পলিসিগুলো বীমা গ্রাহকের মৃত্যু ঝুঁকিসহ আরো অনেক ঝুঁকি বহন করে থাকে, যদিও মেয়াদান্তে পলিসি গ্রাহকের সম্ভাব্য মোট জমা ব্যাংকের তুলনায় কম হয়। গ্রাহকদের কাছে সে বিষয়টাও গৌণ। কেননা ঝুঁকি মানব অভিজ্ঞতার সবচাইতে অবিরত ঘটমান এবং চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ প্রদানের মাধমে একমাত্র বীমাই গ্রাহকদের স্বাস্থ্য, দ্রব্য-সামগ্রী এবং ব্যবসায়ের ঝুঁকির প্রভাব হ্রাস করে ।

জীবন বীমার ক্ষেত্রে , মূল সমস্যা হলো জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থার সংকট বা আস্থাহীনতা যার  শিকড় জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর সেবা বিক্রি প্রক্রিয়ায় নিহিত। জীবন বীমা কোম্পানিগুলো এজেন্ট চালিত। জীবন বীমা কোম্পানি গুলো সেবা বিক্রির জন্য অতিমাত্রায়  এজেন্টদের  উপর নির্ভরশীল । আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায় এসব এজেন্টরা কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে  বিবেচিত হন না । অথচ, গ্রাহকরা মূলত এজেন্টদের কাছেই প্রিমিয়ামের অর্থ জমা দেন ।   ফলে গ্রাহকদের  জমাকৃত অর্থ বীমা-অফিসে  সঠিকভাবে  এবং সময়মত জমাদান , গ্রাহকদের  তথ্য পূরণ  এবং প্রিমিয়ামের জমাকৃত অর্থ ফেরত পাবার প্রশ্নে একটা  সংকট তৈরী হয়েছে । বাংলাদেশে প্রচলিত বীমা আইন-২০১০ এর ধারা ৫৮(৩) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক জন এজেন্ট তার সংগৃহীত বীমা পলিসির প্রথম বৎসরের প্রিমিয়ামের শতকরা ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) ভাগ; দ্বিতীয় বৎসরের নবায়ন প্রিমিয়ামের শতকরা ১০ (দশ) ভাগ; এবং  পরবর্তী বৎসরসমূহে(পরবর্তী  আট বছর )  নবায়ন প্রিমিয়ামের শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ কমিশন হিসেবে পেয়ে থাকেন । ফলে নগদ অর্থের লোভে এজেন্টরা নতুন গ্রাহক খোঁজায় ব্যস্ত থাকেন । পুরোনো গ্রাহকদের ফলো-আপ করার অভাবে জীবন বীমা পলিসি তামাদি হয়ে পড়ে । পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ,  বাংলাদেশে  জীবন বীমা পলিসিগুলোর প্রায় আশি ভাগই মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত টিকে না । উপরন্তু, মেয়াদ শেষে তামাদি কিংবা  পূর্ণ-মেয়াদ পর্যন্ত জমাকৃত পলিসি অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রশ্নে বীমা কোম্পানিগুলোর উদাসীনতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা গ্রাহকদের আস্থার সংকটকে প্রকট  থেকে আরো  প্রকটতর করে  তুলেছে । গ্রাহকের অভাবে কিছু জীবন বীমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় নিজেদের শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং অন্যান্য কোম্পানির অধিকাংশ শাখাও প্রায় নিভু নিভু ।

অন্যদিকে নন-লাইফ বা সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো  শাখা চালিত । এদের  সংকটের প্রধানতম কারণ এজেন্ট কমিশনে গ্রাহকদের ভাগ বসানো বা ডিসকাউন্টিং । ব্যবসা সংগ্রহে নিজেদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারনে বীমা কোম্পানিগুলোর  এজেন্ট কমিশনের টাকা  হাতিয়ে নিচ্ছে বীমা গ্রাহক সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু চক্র । এক শ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বীমা গ্রাহক কোম্পানিগুলোর  কর্মাশিয়াল কর্মকর্তাদের লোভে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো  বাধ্য হয়ে তাদের হাতে তুলে  দিচ্ছে বীমাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ এ খাতে মজুরির পুরোটাই । ফলে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর  ব্যবসায় খরচ বাড়ছে , অপারেশনাল মূলধন বেশি লাগছে এবং বঞ্চিত হচ্ছে  লাভের বিশাল একটা অংশ  থেকে । অর্থনৈতিক  সক্ষমতা কমে যাওয়ায়  নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে । একই কারনে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের ক্লেইম পরিশোধের সক্ষমতাও। শতকরা হিসেবে  যদিও তা মোট বীমা ব্যবসার পনের শতাংশর মত কিন্তু অংকের হিসেবে সেটা বিশাল !  অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বীমা গ্রাহক কোম্পানিগুলোর কমার্শিয়াল কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক আয় হবার কারনে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে আয়কর রাজস্ব থেকে । উপরন্তু ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক আয় হওয়ায় এ সকল আয় জিডিপি গণনায়ও বাদ পড়ছে ।

ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে  গ্রাহক আস্থাহীনতা এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের দৌরাত্ম কাটিয়ে বীমা শিল্প হবে ব্যাংক শিল্পর প্রধানতম মূলধন ,তারল্য এবং মুনাফার যোগানদাতা। গ্রাহক পাবে  বিনিয়োগের নতুন খাত ; ব্যাংকের মাধ্যমে জমাদেয়া তার  পাওনা , প্রিমিয়ামের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থ  দ্রুততম সময়ে ফেরত পাবার নিশ্চয়তা। এটি এমন  একটি সমন্বিত ব্যবস্থা যেখানে  গ্রাহক,বীমা কোম্পানি এবং ব্যাংক সবাই লাভবান হবে ; লাভবান এবং সমৃদ্ধ হবে দেশ । এতে ন্যূনতম খরচে একই গ্রাহকের অর্থ একাধিক খাতে হাত বদল হবার কারনে অর্থনীতিতে  নতুন গতির  সঞ্চার হবে , স্ফীত হবে জাতীয় আয়  এবং  জিডিপি । 

জাতীয় আয় বৃদ্ধির কাজটি কীভাবে হয়  বিশ্লেষন করলে বিষয়টি  বুঝতে আরো সুবিধা হবে ।প্রথমেই দেখি আমরা আয় করে  আসলে কী করি । ব্যক্তি মাত্রই  আয় করে তার একটা অংশ ব্যয় বা ভোগ করেন এবং উদ্ধৃতাংশ সঞ্চয় করেন । ক্ষুদ্র  ক্ষুদ্র  সঞ্চয় তিনি বিনিয়োগ করেন । এরূপ ব্যষ্টিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  সঞ্চয় সমষ্টিকভাবে বিশাল মূলধনের যোগান দেয়। সমষ্টিকভাবে  সকল আয়, ব্যয় তথা ভোগ, সঞ্চয়,বিনিয়োগ কিংবা উৎপাদন বৃদ্ধি চক্রাকারে  জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে  প্রভাব  ফেলে । কেননা অর্থনীতিতে কোন একটি উপাদান বা চলকের  হ্রাস-বৃদ্ধি অপরাপর চলকগুলোর হ্রাস বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে ।

যদি সম্পূর্ণ বিষয়টিকে আয়ের দৃষ্টিতে দেখি,তাহলে আমরা দেখি  জনগণের আয় বাড়লে সঞ্চয় বাড়ে,সঞ্চিত অর্থ মূলধনের যোগান বাড়ায়,ফলে মূলধন বাড়ে।নতুন মূলধন বিনিয়োগ বাড়ায় এবং বর্ধিত বিনিয়োগ কর্মসংস্থান বাড়ায় এবং আবারও জনগনের আয় বাড়ে । এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে । অপরদিকে , যদি ব্যয়ের দৃষ্টিতে দেখি , আমরা দেখি ব্যয় বাড়লে  জনগনের দ্রব্য-সামগ্রী বা সেবা ক্রয়ের চাহিদা বাড়ে এবং ভোগ বাড়ে।এ বর্ধিত চাহিদার কারনে তৈরী হওয়া নতুন যোগান মেটাতে বিনিয়োগ বাড়ে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং দেশের মোট উৎপাদন বাড়ে । বর্ধিত কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনের কারনে জনগনের আয় বাড়ে । আয় বাড়ায়  জনগনের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আসে এবং বর্ধিত অর্থ ব্যয় তথা ভোগ বাড়ায়। এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকবে । বর্ণিত কার্যক্রম গুলোর কোন একটি অনুঘটকের  ইতিবাচক পরিবর্তন বাকীগুলোরও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায় । উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দেশের জাতীয় আয়ের মূল অনুঘটক গুলো  বলা যেতে  পারে। ভেনিজুয়েলা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জাতীয় আয় বৃদ্ধির অনুঘটক হলো  তেল উৎপাদন তথা তেল  রপ্তানির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি। এক সময়ের জেলে পাড়া সিংগাপুরের সমৃদ্ধির মূলে আছে  ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে স্থাপিত 

সমুদ্র বন্দরের সেবা প্রদান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি। চীনকে বলা হয় পৃথিবীর কারখানা; চীনের জাতীয় আয় বৃদ্ধির অনুঘটক হলো  ব্যাপক পণ্য উৎপাদন । এটা সকলেরই জানা আজকের সমৃদ্ধ মালয়েশিয়ার  মূলে রয়েছে সঞ্চয় বৃদ্ধির ইতিহাস। আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্ম চাঞ্চল্যের মূলে আছে ভোগ বৃদ্ধি।

শুধু মাত্র ভোগ বৃদ্ধি, যার প্রধান অর্থ যোগান দাতা প্রবাসী আয় এবং তৈরী পোষাকখাতের রপ্তানি আয় , দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তার ইপ্সিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব না। কেননা , পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। অথচ বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরী না হওয়ার  ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ বাড়ছে না ,বাড়ছে না কর্মসংস্থানও। ‘মড়ার উপর খড়ার ঘা ’ হিসেবে যোগ হয়েছে  শিক্ষাব্যবস্থায়  বিদ্যমান প্রায় শত ভাগ পাসের হার। ফলে বাড়ছে পুঞ্জিভূত ব্যাপক বেকারত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, বর্তমানে (২০১৯) বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ৪.৬ শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ১.৩৮ কোটি ! মনে রাখতে হবে এ পরিসংখ্যানে ছদ্ম বেকারত্বেকে বিচেনায় নেয়া হয়নি। তা বিবেচনায় নিলে হারটি আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ড.বিরুপাক্ষ পাল সম্প্রতি ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ এর সাথে এক সাক্ষৎকারে উচ্চ জিডিপি সত্তে¡ও বাংলাদেশে বেকারত্ব কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আয়ের অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালত্বকে এ জন্য দায়ী করেন। অনানুষ্ঠানিক আয় হলো মূলত সেসব আয় যা আয়কারী আয় হিসেবে কোথাও প্রকাশ করেন না ফলে প্রথমিকভাবে তা জিডিপি গণনায় বাদ পড়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান  ব্যুরোর ডাটার মাননিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্তকে পৃথিবীতে সবচাইতে মানহীন বলে দাবী করেন। তিনি বলেন প্রত্যেক দেশই তথ্য-উপাত্তর সত্যতা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট ফিল্টারিং করে, যা বাংলাদেশ অনুসরণ করে না। তাই শুনতে অস্বস্তি লাগলেও বলতে হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রদত্ত তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে সবচাইতে মানহীন। আরো অনেক গবেষকও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তর মান নিয়ে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন; বলছেন বেকারত্বর প্রকৃত সংখ্যাটি সন্দেহাতীতভাবে আরো অনেক বড় হবে ।

সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিতদের প্রায় অর্ধেকই বেকার ! আই.এল.ও’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তরুন বেকারের সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। ২০২০ সালে এসে সে সংখ্যা যে আরো বড় হয়েছে সেটা নিশ্চয় আর না বললেও চলে। অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়  বাংলাদেশ এখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার দিক দিয়ে স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্তিক বোনাসের সুবিধা জনক অবস্থায় রয়েছে । বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম। যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হিসেবে পরিচিত। কোন দেশে যদি ৬০ শতাংশের বেশী মানুষ কর্মক্ষম থাকে তাহলে সেদেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা অবস্থায় আছে বলে গণ্য হয় ।

জনসংখ্যার প্রায় সত্তর ভাগ কর্মক্ষম এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল ঘটনা। সঠিকভাবে কাজে না লাগালে এ সুবিধাজনক অবস্থা অচিরেই পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দেশের দায় হিসেবে আবির্ভূত হবে। দ্রুত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে অচিরেই বাংলাদেশের সকল অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই, জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য চলক বা অনুঘটক গুলোর এক বা একাধিক অনুঘটককে ধাক্কা দেয়া এখন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে ।

এক্ষেত্রে ব্যাংকাস্যুরেন্স হতে পারে অন্যতম প্রধান মোক্ষম হাতিয়ার। ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে একই সাথে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হবে সহজেই। শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বীমা খাতে। বীমা খাত ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুশ, হবে বিশ্বমানের  । বীমা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়বে, একই সাথে বীমা এবং ব্যাংক কোম্পানি গুলোর লাভের পরিমাণ বাড়বে। উভয় খাতে বিদ্যমান জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চত করা যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বীমা এবং ব্যাংক সেবা ছড়িয়ে পড়বে। ব্যাংক-বীমার সাথে সম্পর্কিত শিল্পগুলোর প্রসার বাড়বে। শেয়ার বাজারের প্রসার বাড়বে। ব্যাপক কর্মসংস্থান বাড়বে।

ভারতে ইতোমধ্যে ব্যাংকাস্যুরেন্স বীমা পলিসি বিক্রির একটি যুগান্তকারী নতুন ডিস্ট্রবিউশন চ্যানেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চালু হবার পর যা ভারতে বীমা পলিসি বিক্রি তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে ৪৯শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোটাই ব্যাংক নির্ভর। কারণ আমরা বিনিযোগের বিকল্প  খাত তৈরী করে একে বহুমাত্রিক রুপ দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। বিনিয়োগের স্বর্ণ সূত্র ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখ না’ ঝুঁকির এ বিষয়টা মাথায় রাখলে বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে কতটা ঝুঁকিতে আছে দেশের অর্থনীতি ! ব্যাংক খাত একা এত চাপ নিতে পারছে না। ফলে ধেয়ে আসছে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়।

এটি রোধ করতে, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশকে পুরো মাত্রায় ব্যাংক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিনিযোগের বিকল্প খাত তৈরী করতে হবে। বিনিয়োগের বিকল্প খাত হিসেবে বীমা বিশাল সম্ভাবনাময়। বীমা শিল্প সমৃদ্ধ হলে  ইকুটি,বন্ড এবং ডেরিভেটিভস বাজারের পরিসরও ব্যাপকভাবে বাড়বে। কেননা বীমা কোম্পানি গুলো তাদের আয়ের বড় একটা অংশ বিনিযোগ করতে হয়। বিদ্যমান জনবল এবং অবকাঠামো দিয়েই ব্যাংকগুলোর বীমা পণ্য বিক্রি করতে পারবে। ফলে তাদের আয়  বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখার তালিকার দিকে নজর দিলে দেখা যায় এখনও পর্যন্ত ৪৯২টি উপজেলার সব কটিতে  সব ব্যাংকের ন্যূনতম একটি করে শাখা নেই। সব ব্যাংকই শহর কেন্দ্রীক; একই অবস্থা ৭৮টি বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বীমা সেবা গ্রামমুখী করে ব্যাংকাস্যুরেন্স দেশকে বিকেন্দ্রীকরনে সহয়তা করবে। যুগৎপতভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে ব্যাংক এবং বীমা সেবা। সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশ সমৃদ্ধ হবে।

ব্যাংক এবং বীমা কোম্পনিগুলোর কাজকে পাশা-পাশি রেখে তুলনা করলে দেখা যায় এদের কাজের ধরনে কিছু মিল রয়েছে।উভয়খাতই সেবা বিক্রয় করে আয় করে উভয়ে সঞ্চিতি রাখে,অর্থ ব্যবস্থাপনা করে,ঝুঁকি বহন করে ,তারল্য রাখতে হয়, বিনিয়োগ করে এবং ‘ল অব লার্জ নাম্বার’ নীতির উপর ভিত্তি করে লাভ করে। ব্যাংক কম সুদের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদেরকে বেশী সুদে ধার দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে এবং আয় করে। অপরদিকে, বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের(প্রিমিয়ামের) বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত সাম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে। বীমা প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম বাবদ যে অর্থ লাভ করে তার একটা বড় অংশ পুনরায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্পে বিনিয়োগ করে। ক্ষতি হলে গ্রাহকে বীমা দাবি পরিশোধ করে। বীমা ব্যাংকের ঝুঁকি অনেকাংশে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। বীমা ব্যাংক ব্যবস্থার সম্পূরক সেবা বিক্রয় করে একে পরিপূর্নতা দেয়। ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মৃত্যু ঝুঁকি,তাদের পণ্য-দ্রব্যের সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রবিষয়ক সকল ঝুঁকি সহ অপরাপর ঝুঁকি সমূহ বহন করে বীমা কোম্পানিগুলো। তাই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ব্যক্তি কিংবা সম্পদের ‘বীমা’ কে আবশ্যিক করেছে। ফলে,তাদের উভয়ের কাজের  মাঝে এ ধরনের সমন্বয় সাধন করা গেলে উভয় খাতের অপারেশনাল খরচ কমিয়ে বিষয়টি যে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অর্থনীতিতে ‘স্কেল অব প্রোডাকশনের’ নীতি থেকে আমরা দেখি উৎপাদন বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমে যায়। ফলে আয় বাড়ে। ব্যাংকাস্যুরেন্সে বীমা কোম্পানিগুলো ন্যূনতম খরচে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান শাখা নেটওয়ার্ক এবং জনবল ব্যবহার করে ব্যাপক বীমা পণ্য বিক্রয় করতে সক্ষম হবে।এতে ব্যাংকগুলো যেমন সুদের বাইরে বিশাল অংকের ‘ফী’ আয় করে লাভবান হবে বীমা কোম্পানি গুলো তেমনি তাদের বিদ্যমান জনবলের সহায়ক শক্তি পেয়ে প্রচুর পণ্য বিক্রয় করে লাভবান হবে। ব্যাংকগুলোর ব্যয় সংকুচিত হওযার ফলে তাদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে যাবে। অন্যদিকে বীমা কোম্পানিগুলোর আয় স্ফীত হয়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে যাবে।

নতুন গ্রাহকদেরর সাথে পরিচিত হবার ফলে ব্যাংকের নিজস্ব সেবা বিক্রি বেড়ে যাবে। একই ভাবে ব্যাংক তার নিজস্ব গ্রাহকদের কাছে বীমা পণ্যের সুবিধা তুলে ধরার কারনে বীমা পলিসি বিক্রয় কয়েকগুন বেড়ে যাবে। বীমা বিশেষজ্ঞদের মতে এতে বীমা খাতের প্রিমিয়াম আয় দশগুন বৃদ্ধি পাবে। যুক্ত জনশক্তি এবং সমন্বিত সম্ভাবনা নতুন নতুন ব্যাংক এবং বীমা পণ্যের ধারনা তৈরীতে সহায়তা করবে। বীমা কোম্পানির সাবসিডিয়ারী ব্যাংক কোম্পানি কিংবা ব্যাংক কোম্পানির সাবসিডিয়ারী বীমা কোম্পানির জন্ম হয়ে অর্থনীতিতে নতুন ধারা তৈরী হবে। তৈরী হবে পুনঃবীমার বিশাল বাজার।

ব্যাংকাস্যুরেন্স  চালু হলে জিডিপিতে নাটকীয়ভাবে বীমা অবদান  অনেক বেড়ে যাবে। প্রাইস ওযাটারহাউস কুপার্স কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় মাত্র এক শতাংশ বীমা অবদান বৃদ্ধি দুই শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করে। এর কারণ এটি ২২শতাংশ অবীমাজনিত ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগোত্তর কর অবদান হ্রাস ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিতে সহায়তা করে। বীমা অবদানের গাণিতিক বৃদ্ধি  জিডিপি বৃদ্ধিকে জ্যামিতিক ভাবে বৃদ্ধি ঘটাবে।

পরিশেষে বলা চলে, বীমা শিল্প কেবল ব্যবসায় বাণিজ্যের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীতেই অবদান রাখে না বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের আর্থিক চাপ হ্রাস করতেও সহায়তা করে। দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে তাই বীমা প্রিমিয়ামে বিনিয়োগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: মো. নূর-উল-আলম, এসিএস, এমবিএ, এমএ (ইং), এলএলবি

ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড 

ইমেইল: csnoor.bd@gmail.com