11/22/2024
আবদুর রহমান আবির: মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকীকে মূখ্য নির্বাহী করতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)'র কাছে আবেদন করেছিল চার্টার্ড লাইফ। তবে জাল অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল করায় সে আবেদন নাকোচ করে দেয় আইডিআরএ। এ ঘটনা ২০১৪ সালের। ওই সময় তিনি কোন বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী পদে চাকরি করবেন না বলেও আইডিআরএ’র কাছে মুচলেকা দেন।
সেই মুসা সিদ্দিকীকে এবার মূখ্য নির্বাহী করতে আবেদন করেছে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ। গত ১২ জুন আইডিআরএ’র কাছে এ আবেদন পাঠিয়েছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান জেসমিন আক্তার। তবে এবারের আবেদনটিতেও অভিজ্ঞতার বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন মুসা সিদ্দিকী। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি'র অনুসন্ধানে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
কোনো ব্যক্তির মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন পেতে আইডিআরএ’র চেক লিস্ট অনুসারে ১৫ ধরণের তথ্য দাখিল করতে হয়। চেক লিস্টের ১০ নস্বর তথ্যটি হলো মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ বিধিমালার প্রবিধি ৫ এ প্রদত্ত হলফনামা।
মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকী ওই হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) পদে কর্মরত ছিলেন।
অথচ মুসা সিদ্দিকীর বিভিন্ন কোম্পানিতে নিয়োগপত্র, কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রত্যয়নপত্র ও অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হলফনামায় দেয়া তার এ তথ্যটি সঠিক নয়।
মুসা সিদ্দিকীকে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ নিয়োগ দেয় দু'বার। প্রথমবার তিনি নিয়োগ পান ২০১৪ সালে। এরপর তিনি ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। পরে আবারো তিনি নিয়োগ পান ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। অর্থাৎ তিনি ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এনআরবি গ্লোবাল লাইফে কর্মরত ছিলেন না।
মুসা সিদ্দিকীর নামে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ প্রথম নিয়োগপত্র ইস্যু করে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে। এ নিয়োগপত্র অনুসারে তাকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতনে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। যা ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে কার্যকর হবে বলে নিয়োগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এনআরবি গ্লোবাল লাইফের চেয়ারম্যান এম এ আহাদ স্বাক্ষরিত অপর একটি প্রত্যায়নপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসা সিদ্দিকী ১২ নভেম্বর ২০১৪ সাল থেকে ৩০ অক্টোবর ২০১৫ সাল পর্যন্ত এনআরবি গ্লোবাল লাইফে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (চলতি দায়িত্ব) দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি মূখ্য নির্বাহীর অব্যাবহিত পরের পদ।
ওই হলফনামায় মুসা সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন, তিনি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে চার্টার্ড লাইফে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মূখ্য নির্বাহী চলতি দায়িত্ব পদে কর্মরত ছিলেন। এখানে সুনির্দিষ্ট করে দিন মাস উল্লেখ করা হয়নি। যাতে করে সহজেই মনে হয় ২০১৩ সালের পুরো সময় ও ২০১৪ সালের পুরো সময় তিনি চার্টার্ড লাইফে কর্মরত ছিলেন।
অথচ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে চার্টার্ড লাইফ মুসা সিদ্দিকীকে কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে। এ সময় তার বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নিয়োগপত্রটিতে স্বাক্ষর করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুস শহিদ। পরে ৮ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে তিনি এ কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ ছাড়াও ওই হলফনামায় মুসা সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন, তিনি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময় বায়রা লাইফে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অথচ গত ২৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মুসা সিদ্দিকীকে বায়রা লাইফ থেকে দেয়া ছাড়পত্র অনুসারে, তিনি ৬ জানুয়ারি থেকে ৯ নভেম্বর ২০১৩ এবং ২৯ মে ২০১৪ থেকে ৩০ অক্টোবর ২০১৪ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বায়রা লাইফ থেকে মুসা সিদ্দিকী পদত্যাগ করে ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে। ছাড়পত্রটিতে স্বাক্ষর করেছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আবুল বাশার।
বায়রা লাইফ মুসা সিদ্দিকীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়ার পত্রটি ইস্যু করেন ৬ জানুয়ারি ২০১৩ সালে। নিয়োগপত্র অনুযায়ী তারা নিয়োগ কার্যকর ধরা হয় ৮ ডিসেম্বর ২০১২ সাল থেকে। এ সময় তার সর্বসাকুল্ল্যে বেতন-ভাতা ধরা হয় দেড় লাখ টাকা।
তবে সিইও নিয়োগ পেতে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় এবারের দাখিল করা হলফনামায় প্রাইম ইসলামী লাইফে চাকরির অভিজ্ঞতার কোনো তথ্য দাখিল করেননি আবু মুসা সিদ্দিকী।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অভিজ্ঞতার জাল সনদ দেয়ায় অভিযোগে মুসা সিদ্দিকীকে মূখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার অনুমোদন চেয়ে চার্টার্ড লাইফের করা আবেদন নাকোচ করে দেয়া হয়। একই সাথে এ সংক্রান্ত চিঠি সকল লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে পাঠায় আইডিআরএ।
চ্যাটার্ড লাইফের চেয়ারম্যানকে লেখা আইডিআরএ’র ওই চিঠিতে বলা হয়, এমডি হিসেবে আবু মুসা সিদ্দিকীর নিয়োগ অনুমোদনের জন্য পাঠানো আবেদনের কাগজপত্রের মধ্যে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাজের অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত সনদটি জাল। বিষয়টি তিনি (আবু মুসা সিদ্দিকী) স্বীকার করেছেন।
এ জন্য আবু মুসা সিদ্দিকীকে চ্যাটার্ড লাইফে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ অনুমাদন দেয়া হলো না।
চিঠিতে আরও বলা হয়, আবু মুসা সিদ্দিকী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে এ পর্যন্ত যে বেতন ভাতাদি (নগদ) গ্রহণ করেছেন তা তার নিকট থেকে আদায় করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র তৎকালিন সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লা ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি'কে বলেন, মুসা সিদ্দিকী চার্টার্ড লাইফের সিইও হওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন যাচাই করে তার প্রাইম ইসলামী লাইফের কাজের অভিজ্ঞতার সনদটি জাল প্রমাণিত হয়েছিল। সনদ জালিয়াতির এ কথা সে সময় লিখিতভাবে স্বীকার করেছিলেন মুসা সিদ্দিকী।
সুলতান উল আবেদীন মোল্লা বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মিথ্যা তথ্য দেয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। যদিও আমরা সে সময় তার ফৌজদারি অপরাধের বিচার করিনি। কিন্তু তার সিইও নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হয়নি। এমনকি তার সনদ জালিয়াতির কথা আমরা চিঠির মাধ্যমে অন্য কোম্পানিগুলোকে জানিয়ে দিয়েছি। সেই তথ্য এখনো হয়তো আইডিআরএ'র কাছে আছে।
আইডিআরএ’র সাবেক এই সদস্য আরো বলেন, মুসা সিদ্দিকী সিইও হওয়ার কোন যোগ্যতা রাখে না। এটা তো একটা নৈতিক বিষয়। যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মিথ্যা তথ্য দিতে পারে সে কিভাবে সিইও হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তার এই জালিয়াতির ঘটনা সব কোম্পানির জানা থাকার পরও কিভাবে তাকে সিইও নিয়োগের অনুমোদন চেয়ে একটা কোম্পানি আবেদন করতে পারে তা আমার জানা নেই। মুসা সিদ্দিকীর বিষয়টি আইডিআরএ ভালোভাবে যাচাই করবেন বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকী এসব বিষয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি'কে বলেন, আমি আইডিআরএ'তে কোন ভুল তথ্য দেইনি। তবে আপনি যেসব তথ্যের কথা বলছেন তা আমার কাছে এখন নেই। তাই এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।
মুসা সিদ্দিকী আরো বলেন, আমি আইডিআরএ'তে ৪ বার সিইও হওয়ার আবেদন করেছি। সব তথ্য যে সব আবেদনে থাকবে তা ঠিক নয়। সর্বশেষ যে আবেদন করেছি তার তথ্য প্রথম আবেদনে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে আইডিআরএ আমি যেসব তথ্য দিয়েছি তা ভালোভাবে দেখেই দিয়েছি। কোন ভুল তথ্য দেইনি, দাবি করেন মুসা সিদ্দিকী।