2816

03/28/2024

বীমা কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক: ক্ষমতা এবং পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ  (পর্ব-২)

প্রকাশ: ২৭ আগষ্ট ২০২০

মো. নূর-উল-আলম, এসিএস: বাংলাদেশে তালিকাভূক্ত কোম্পানির সংখ্যা বেশি নয়। অথচ অসংখ্য লোককে ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোড’এ স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়াল যোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে। তালিকাটি যেকোন বিবেচনায়ই বেশ বড়;

১০ কোটি টাকার বেশি জমাকৃত মূলধন সম্পন্ন যে কোন কোম্পানির পরিচালক, তালিকাভুক্ত যে কোন কোম্পানির পরিচালক, জাতীয়-আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের যে কোন সদস্য, বণিক সমিতির যে কোন সদস্য, তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির শীর্ষ ৫ এক্সিকিউটিভস ছিলেন এমন কেউ, ১০ কোটি টাকার বেশি জমাকৃত মূলধন সম্পন্ন যে কোন কোম্পানির শীর্ষ ৫ এক্সিকিউটিভ ছিলেন এমন কেউ;

সরকারী বেতনকাঠামোয় ৫ম গ্রেডের উপর বেতন নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়, অর্থনীতি এবং আইন বিষয়ে স্নাতক যে কোন কর্মকর্তা, ব্যবসায়, অর্থনীতি এবং আইন বিষয়ের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের যে কোন আইনজিবী এবং বিশ্বের সকল সিএ, সিএমএ, সিএফএ, সিসিএ, সিপিএ, সিএমএ, সিএস  এবং সমমানের  যে  কোন ডিগ্রিধারীদের ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ হিসেবে যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়ছে।

হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন বিশ্বের সকল প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী। কারণ সিএ, সিএম এবং সিএস আমাদের দেশীয় পেশাদারী ডিগ্রি। অপরপক্ষে সিএফএ, সিসিএ এবং সিপিএ দেশের বাইরের ডিগ্রী। পৃথিবীসব দেশ দেশীয় ডিগ্রিকে প্রধান্য দেয় এবং প্রয়োজনে বাইরের ডিগ্রিগুলোর দেশীয় সংষ্করণ তৈরী করে দেশের টাকা দেশেই রাখার ব্যবস্থা করে।

অথচ আমাদের সেসব ভাবতে বয়েই গেছে! যদিও উপরোক্ত যে কোন যোগ্যতার পাশাপাশি ১০ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা শর্ত হিসেবে বেধে দেয়া হয়েছে তবুও যে কোন বিচারেই যোগানের সংখ্যাটা বিশাল যা স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের মূল লক্ষ্যকে নিশ্চিতভাবে ব্যহত করেছে।  

অধিকন্তু, একজন স্বতন্ত্র পরিচালকের সর্বোচ্চ ৫টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার বিধান এই কোডের আরেকটি বড় দুর্বলতা।  অপর একটি শর্তে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে উরোক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত শিথিল যোগ্য বলে বর্ননা করায় স্বতন্ত্র পরিচালকের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার শর্তগুলোও গৌণ হয়ে পড়েছে।

কোয়ালিটির সাথে কম্প্রমাইজ করে গুনগত মাণ সম্পন্ন সেবা আশা কারাটা কতটা বোকামি তা বাংলাদেশে বিদ্যমান বীমা কোম্পানিগুলোর তথ্যবাতায়ণে প্রদর্শিত স্বতন্ত্র পরিচালকদের পরিচিতি পড়লেই বুঝবেন।

স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানি শর্তপূরণ বা পরিপালন করে মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সকল বীমা কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালকরা কোন না কোনভাবে বিদ্যমান কন্ট্রোলিং শেয়ারহোল্ডিং ডিরেক্টরদের পরিচিত অথবা তাদের পছন্দের লোক।

তাই তারা সংখ্যাগুরুদেরই  স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। ফলে তাদের দ্বারা সংখ্যালগু তথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়া কখনোই সম্ভব হয় না। তাই বলা চলে বাংলাদেশের নিরিক্ষে স্বতন্ত্র পরিচালক একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালকদের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বতন্ত্র পরিচালকদের গড় বয়স ৬৪ বছর। ৫৮ শতাংশের স্নাতকত্তোর ডিগ্রি রয়েছে। বাকী ৪২ ভাগের কথা বলা নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, তারা স্নাতক অথবা আরো কম শিক্ষিত।

প্রতিবেদনটি থেকে আরো জানা যায়, কোম্পানি থেকে তাদের বার্ষিক গড় আয় মাত্র দেড় লক্ষ টাকা। মাসে ১২,৫০০ টাকা মাত্র! অথচ আমাদের প্রতিবেশি ভারতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বছরে গড়ে তার চাইতে ৭ গুন বেশি আয় করেন। এত নিম্ন আয় তাদের পেশাদারী দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা এবং অবদানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ  নয়।

উপরন্তু, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দিয়েছে কিন্তু কোন দায় দেয়নি। তাই হয়নি তাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়ণ। দেয়নি কোন পারিশ্রমিকও। অথচ ,অডিট কমিটির মত স্পর্শকাতর বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালককে।

অডিট কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাজ কোম্পানির সকল প্রকার আর্থিক অনিয়ম এবং অসঙ্গতি উদ্ঘাটন করা এবং তদানুযায়ী পর্যদ সভাকে অবহিত করা। পাশাপাশি বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল শেয়ার হোল্ডারকেও বিষয়টি অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

অধিকন্তু, পর্যদ সভা যদি বিষয়টি আমলে না নেয় তবে কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করার বিধানও রাখা হয়েছে। এর অর্থ হলো পরিচালনা পর্ষদে জ্ঞান এবং দক্ষতায় বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের অন্তর্ভুক্তির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যা করপোরেট সত্তাগুলোর সুশাসনের মূল উপাদান।

অথচ তাদের জন্য কোন প্রকার পারিশ্রমিককে বিবেচনায় নেয়াই হয়নি। স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন যেন এক প্রকার চ্যারিটি! ফলে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হলো ক্ষমতা এবং পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ মাত্র।

পরিশেষে বলা চলে বাংলাদেশের উচিত যতদ্রুত সম্ভব স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি পুল বা প্যানেল তৈরী করা। পৃথিবীর  সবদেশের মত বিএসইসি’র ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোডে’ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্বতন্ত্র পরিচালকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

কোম্পানিগুলো যেন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারে তার জন্য যোগ্যতার শর্তবেধে দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে  যোগ্যতার শর্তসমূহের ফাঁকগলে নিজেদের পছন্দের লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।  

অতএব যোগ্যতার শর্তসমূহের ফাঁকগলে দুর্বল চিত্তের কাউকে যাতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া না যায় সেজন্য ‘স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল’ তৈরীর কোন বিকল্প নেই। ‘স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল’ গঠিত হলে বিএসইসি’র ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোড’ আরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং কোম্পানিগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়বে।

কারণ যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালকরাই পুঁজিবাজারে করপোরেট সুশাসনের মূলশক্তি। পাশাপাশি বিএসইসি’র উচিত স্বতন্ত্র পরিচালকসহ অন্যান্য পরিচালকরা যেন কোম্পানিগুলোতে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেন সে লক্ষ্যে ‘ইন্সটিটিউট অব ডিরেক্টর্স’ প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবদান রাখতে সাহায্য করা।

লেখক: সহযোগী সদস্য, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)

ইমেইল: csnoor.bd@gmail.com

সেল নং: +৮৮০ ১৬১০ ১২৩২২৩