3036

03/28/2024

ভূয়া সনদে ন্যাশনাল লাইফের মূখ্য নির্বাহী কাজিম উদ্দিন, তড়িঘড়ি করে আইডিআরএ'র অনুমোদন

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২০

আবদুর রহমান আবির: শিক্ষাগত যোগ্যতার ভূয়া সনদ দিয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মো. কাজিম উদ্দিন। আর এই নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাজিম উদ্দিনকে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করা হয় গত ৩০ নভেম্বর। এই আবেদন করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম এমপি। আর আবেদনের মাত্র ৯ দিনের মাথায় তার নিয়োগ অনুমোদন দেয় আইডিআরএ। ১ নভেম্বর, ২০২০ থেকে পরবর্তী ৩ বছরের জন্য এই নিয়োগ কার্যকর ধরা হয়। তার মাসিক বেতন-ভাতা অনুমোদন করা হয় সর্বসাকূল্যে ৬ লাখ টাকা।

আইডিআরএ’র কাছে আবেদনের সাথে কাজিম উদ্দিনের জীবন বৃত্তান্ত এবং চাহিদা মোতাবেক দাখিল করা অন্যান্য নথিপত্র ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র হাতে এসেছে। এসব নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জীবন বৃত্তান্তে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে কাজিম উদ্দিন বিবিএ ও এমবিএ পাস করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। একই সাথে তিনি এ ২টি শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে সনদ দাখিল করেছেন।

সনদ ২টি ইস্যুকারী বেসরকারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাজিম উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুসারে তিনি ২০১৮ সালে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা (ইউএনআইসি) থেকে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চার বছর মেয়াদী এই ডিগ্রিতে তার অর্জিত সিজিপিএ ৩.৩৫। পরে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালে এক বছর মেয়াদী এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

আবেদনপত্রের সাথে কাজিম উদ্দিনের দ্যা ইউনিভাসিটি অব কুমিল্লা’র সনদ দু’টি আইডিআরএ’তে দাখিলের বিষয়টি আইডিআরএ’র এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তবে ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, আবেদনপত্রের সাথে দাখিলকৃত কোন কাগজপত্র অসত্য প্রমাণিত হলে তার নিয়োগ বাতিল হবে বলে নিয়োগ অনুমোদনপত্রে শর্ত দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ‘দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামক এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি রয়েছে তালিকার ১০৬ নম্বরে। তবে দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার একাডেমিক প্রোগ্রামগুলো এখনও শুরু হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ক্যাম্পাসের বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে- ৯/বি, পলওয়েল কারনেশন, লেভেল- ৫, সেক্টর- ৮, উত্তরা, ঢাকা।  এমন তথ্য দেয়া আছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র ওয়েবসাইটে।

ইউজিসির ওয়েবসাইটে শিক্ষাকার্য পরিচালনার অনুমোদনবিহীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম-ঠিকানা ও প্রোগ্রামসমূহ প্রকাশের বিষয়ে একটি নোটে ইউজিসি জানিয়েছে, ‘মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ বলে উপরোক্ত ঠিকানা ও প্রোগ্রামসমূহ আপলোড করা হল।’

ওয়েবসাইটটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বে: বিশ্ব: আইনানুযায়ী পরবর্তী নির্দেশনা চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। কমিশন থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরুর অনুমতি অদ্যাবধি প্রদান করা হয়নি।’

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা (ইউএনআইসি) সরকারের অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৫ সালে। তবে নানা অনিয়মের কারণে ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।

দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা থেকে নেয়া কাজিম উদ্দিনের বিবিএ ও এমবিএ’র সনদটির  বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মো. মহিবুল আহসান বলেন, দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার একাডেমিক কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি তার সনদ কেমন হবে সেটাতো বোঝাই যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা ইন্স্যুরেন্সনিউজিবিডি’কে বলেন, বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী নিয়োগের অনুমোদন দেয় আইডিআরএ। একজন আবেদনকারির আবেদন ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। এমন অবস্থায় বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ যাচাই করা খুব কঠিন নয়। যাচাই বাছাই না করেই মাত্র ১০ দিনের মধ্যে তরিঘরি করে একজন মূখ্য নির্বাহীর অনুমোদন সন্দেহজনক। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা। এছাড়া সংস্থাটির কোন কর্মকর্তা বিশেষ সুবিধা লাভের আশায় এ ধরণের কর্মকাণ্ড করে থাকলে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

তাদের মতে, ন্যাশনাল লাইফ দেশের শীর্ষস্থানীয় লাইফ বীমা কোম্পানি। যেখানে দেশে লাখ লাখ মানুষের আমানত রক্ষিত। এ ধরণের একটি কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীর পদে ভূয়া সনদ দিয়ে মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ কোনভাবেই কাম্য নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে থাকলে সরকারের উচিত বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষিদের বিরুদ্দে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় তা হবে বীমাখাতে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের অন্তরায়।

বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, ভুয়া সনদ দিয়ে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ নেই। এ ধরণের সনদ দাখিল করে নিয়োগ অনুমোদন নেয়া বড় ধরণের অপরাধ। এটি একটি ক্রিমিনাল অফেন্স। এটা প্রমাণ হলে নিয়োগ অনুমোদন বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসব বিষয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজিম উদ্দিনের মতামত জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।