3373

04/25/2024

সব কোম্পানির অভিযোগ- কমিশন দিয়ে ব্যবসা নিচ্ছে অন্য কোম্পানি

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২১

আবদুর রহমান আবির: নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধ করতে কমিশনই বন্ধ করে দিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। প্রায় ৩ মাস ধরে কমিশন দেয়া বেআইনি হলেও ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র কাছে কোম্পানিগুলোর ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও মুখ্য নির্বাহীরা বলছেন, অন্য কোম্পানি কমিশন দিয়ে ব্যবসা নিয়ে যাচ্ছে। কমিশন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন মূখ্য নির্বাহীদের কেউ। কমিশন দিয়ে ব্যবসা নিয়ে যাওয়ার এমন অভিযোগ প্রায় সব কোম্পানির।

তথ্য অনুসারে, দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে এজেন্ট কমিশন প্রদানে অনিয়ম দূর করতে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার নং-নন-লাইফ ৮৪/২০২১ জারি করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । ওই সার্কুলারে বলা হয়, নন-লাইফ বীমা খাতে ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের বিপরীতে বীমা এজেন্ট কমিশন ১৫ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই নির্দেশ মানছে না অনেক বীমা কোম্পানি।

এ বিষয়ে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিলেট ব্রাঞ্চের ইনচার্জ জে জে ভট্টাচারি চন্দন ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, কমিশন বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের মতো কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমে গেছে। কারণ, আগে কমিশনের জন্য ব্যাংকগুলো আমাদের ব্যবসা দিত। এখন কমিশন বন্ধ হওয়ায় তারা আমাদের ব্যবসা দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু কোম্পানি ১০/১৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে ব্যবসা নিয়ে যাচ্ছে।

সিলেটে নন-লাইফ বীমা ব্যবসা মূলত ব্যাংক ভিত্তিক। তাই সেখান থেকে ব্যবসা না পেলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ব্যবসা কমে যাবে। তাছাড়া গ্রাহকরা এখন একান্তই যেটার বীমা না করলে নয়, শুধু সেটারই বীমা করছে। অর্থাৎ ঝুঁকি কমিয়ে দিচ্ছে। এসব কারণেও এবার আমাদের ব্যবসা কম হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে বীমা কোম্পানি আমাদের আগের মতোই বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে।

সিটি ইন্স্যুরেন্সের এফএভিপি ও গুলশান ব্রাঞ্চের ইনচার্জ মশিউর রহমান বলেন, কমিশন বন্ধ করে দেয়ায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ব্যবসায়। তারপরও আমরা কোন কমিশন দিচ্ছি না। তবে গ্রাহকদের কাছে গেলে শুনতে পাই- কোন কোন কোম্পানি এখনো কমিশন দিচ্ছে। যাদের কারণে তারা আমাদের ব্যবসা দিতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে আগের বছরের তুলনায় এবার এক তৃতীয়াংশ ব্যবসা কমে যাবে।

ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের বরিশাল ব্রাঞ্চের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আবদুল মালেক মৃধা বলেন, কমিশন বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে, পুরনো ব্যবসাও হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ইন্স্যুরেন্স কমিশন না দেয়ায় পার্টিগুলো আমাদের ব্যবসা দিচ্ছে না। যেখানেই যাই, পার্টিরা বলছে- অন্য কোম্পানি দিতেছে, আপনি কেন দিবেন না। সবার একই সুর।

এরইমধ্যে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কমিশন দিয়ে আমার রিনিউয়াল ব্যবসা নিয়ে গেছে। অগ্রণী ব্যাংক পাড়েরহাট থেকে তারা ৩০ শতাংশ কমিশন দিয়ে আমার ব্যবসা নিয়ে গেছে। এ ছাড়াও অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের মৌলভীবাজার শাখা কমিশন দিয়ে আমার ব্যবসা নিয়েছে। আমার ব্রাঞ্চে বছরে এক কোটি টাকার বেশি ব্যবসা আসত। সেখানে এ বছর এখন পর্যন্ত ব্যবসা হয়েছে ১৮/১৯ লাখ টাকা।

আবদুল মালেক বলেন, ২০১০ সালের জুন থেকে আমি ঢাকা ইন্স্যুরেন্সে কাজ করছি। সুনামের সাথেই আমি এতোদিন ব্যবসা করেছি। কিন্তু এখন আমাকে চাকরি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমি কোম্পানির সাথে কথাও বলেছি। কারণ, কমিশন বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে আমার তেমন কোন ব্যবসা হচ্ছে না। গত মাসে আমার ব্রাঞ্চে একেবারেই কাজ হয়নি। তাই আমার স্যালারি কেটে রেখেছিল। তবে পরে আবার সেটা দিয়ে দিছে।  

চট্টগ্রামে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেখ মুজিব রোড ব্রাঞ্চের এএমডি মুসা রেজা সিদ্দিকী বলেন, আমরা সরাসরি গ্রাহকদের সাথে কাজ করি। তাই কমিশন বন্ধ হওয়ার আমাদের ব্রাঞ্চে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। এখনো আমাদের ব্যবসায় প্রায় আগের মতোই আছে। তবে মার্কেটে গেলে পার্টিরা বলছে, তারা কিছু কিছু কমিশন পাচ্ছে।

মুসা রেজা সিদ্দিকী বলেন, কোন কোম্পানি কমিশন না দিলে এসব কথা আসছে কোথা থেকে! তার মানে কিছু কিছু কোম্পানি এখনো নিয়ম মানছে না। তবে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সে তাদের বেতন-ভাতা নিয়েও কোন সমস্যা নেই বলেও জানান তিনি।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের রংপুর ব্রাঞ্চ ইনচার্জ আবু আলম সেলিম রেজা তালুকদার বলেন, জিরো কমিশনে আমাদের ব্যবসাও এখন জিরো পজিশনে চলে গেছে। আমরা কমিশন দিচ্ছি না, কিন্তু অন্যান্য কোম্পানি তো কমিশন দিচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে এখনো ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাচ্ছেন ব্যাংক ম্যানেজাররা। তাই তারা আমাদের কোন ব্যবসা দিচ্ছে না। তারা বলছে, অন্য কোম্পানি যেখানে কমিশন দিচ্ছে সেখানে জিরো কমিশনে কেন আপনাদের ব্যবসা দেবো।

তিনি বলেন, অন্য কোম্পানি যদি কমিশন না-ই দিত তাহলে সেই সব ব্যবসা আমরাই পেতাম। কারণ, এসব ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক যথষ্টে ভালো। এ দিকে আবার ব্যবসা করতে না পারলে ডেভেলপমেন্টে স্যালারি বন্ধ করার আভাস দেয়া হচ্ছে কোম্পানি থেকে। কোম্পানি আইন মানবে ঠিকই, আবার এ কারণে ব্যবসা কমলে আমাদের বেতন-ভাতাও বন্ধ হবে। এখন আমরা যাবো কোন দিকে।

এ বিষয়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন বলেন, ব্যবসা চলছে, তবে পেন্ডামিকের কারণে কিছুটা স্থবির আছে। আশাকরি আমরা এটা কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। কমিশন যেহেতু নেই, সেটার ইম্প্যাক্ট থাকবে; বছর শেষে আমরা এটা বুঝতে পারবো। তবে সার্বিকভাবে এখন পর্যন্ত ভালোই চলছে। কর্মীদের বেতন-ভাতাও আমরা ঠিক মতোই দিয়ে যাচ্ছি। এমনকি পেন্ডামিকেও পারফর্মেন্স বোনাস দেয়া হয়েছে।

ব্যবসা কমার বিষয়ে তিনি বলেন, কমিশন না পাওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় এমনটা ঘটছে। তবে এরপরও বলবো কোম্পানিগুলো ভালোই করছে। ঝুঁকি কমানোর বিষয়টিও অনেকাংশেই সত্য বলে মনে করেন এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্র্যাকটিস অনুসারে অনেকেই হয়তো খরচ কমানোর জন্য ভ্যালুয়েশন কমিয়ে দিচ্ছে। আগে যেখানে কমিশন থাকায় এটা করতে হতো না।

ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মিয়া ফজলে করিম বলেন, আগের বছরের তুলনায় এবার ব্যবসা কম হচ্ছে। তবে কমিশন বন্ধ হওয়ায় ছোট-বড় সব কোম্পানিই এর সুবিধা পাচ্ছে। আগে যেখানে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিয়ে আন্ডার রেইটে ব্যবসা করতে হতো। এখন সেখানে কমিশন দিতে হচ্ছে না। তাই ব্যবসা কম হলেও আন্ডাররাইটিংয়ে কোম্পানি লাভবান হচ্ছে। এক কোম্পানির ব্যবসা কমলেও অন্য কোম্পানির ব্যবসা ভালো হচ্ছে।

এ বিষয়ে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামিম বলেন, করোনার কারনে কমিশন বন্ধের প্রভাবটা বোঝা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর ফলাফল বোঝা যাবে। তবে এখনো কমিশন দেয়া বন্ধ হয়নি। কারণ, আমাদের ৪/৫ বছরের নিয়মিত গ্রাহক এবার অন্য কোম্পানিতে বীমা করেছে। আমার সন্দেহ অন্য কোন কোম্পানি থেকে কমিশন পেয়েছে। বিষয়টি আমি বিআইএ’কে লিখিতভাবেও জানিয়েছি।