3469

04/16/2024

আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে বীমা কোম্পানির ভূমিকা: প্রসঙ্গ নারায়ণগঞ্জ অগ্নিকাণ্ড

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২১

এ কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই: প্রায় এক দশক পূর্বে ঢাকার সাভারে অবস্থিত ‘রানা প্লাজা’ নামের রেডিমেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ধসে পরায় সহস্রাধিক শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে এবং অনেক শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবত বৃহত্তম ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত।

ঘটনাটি দেশে এবং বিদেশে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই দুর্ঘটনার ফলে দৃষ্টির অগোচরে থাকা নিরাপদ এবং নিরাপত্তাজনিত অনেক বিষয় সামনে চলে আসে। বিদেশি ক্রেতা, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও ও গণমাধ্যমের প্রবল চাপের মুখে মালিকপক্ষ অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রমিকের নিরাপদ ও নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন সুপারিশ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এর বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের লাভের টাকার একটি ভালো অংশ ব্যয় করতে হয়।

ফলস্বরূপ রেডিমেড গার্মেন্টস খাতে এ ব্যাপারে অতীতের নৈরাজ্যজনক অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা এই খাতের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

মালিকপক্ষের সীমাহীন লোভ, অসাধুতা এবং আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিডেন্টের জন্য বহুলাংশে দায়ী।

কর্মস্থলে এই সমস্ত নিরাপদ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অগ্নি নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এর মধ্যে অগ্নি নির্ণয় এবং নির্বাপন ব্যবস্থা (Fire Detection and Fire Protection) অন্যতম, দৃষ্টান্তস্বরূপ:

১। ফায়ার এলার্ম সিস্টেম।

২। স্মোক ডিটেকটর।

৩। স্প্রিংকলার সিষ্টেম।

৪। ফায়ার হাইড্রেন্ট অথবা ফায়ার হোজ রীল।

৫। ফায়ার ডোর।

৬। অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডার (কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ড্রাই পাউডার টাইপ, ফোম টাইপ ইত্যাদি।

৭। জরুরি অগ্নি নির্গমন পথ বা দরজা (Push Bar System) ইত্যাদি।

দুঃখজনকভাবে উপরোক্ত দুর্ঘটনায় প্রায় এক দশক পর গত সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত হাশেম ফুডস লি. খাবার তৈরীর ফ্যাক্টরী (যা অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রকৃত পক্ষে মানুষ মারার ফ্যাক্টরীতে রুপান্তরিত হয়) এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হয়।

এই সর্বনাশা অগ্নিকাণ্ডের ফলে কারখানায় কর্মরত কমপক্ষে ৫২ জন শ্রমিক জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। যার মধ্যে বেশকিছু শিশু শ্রমিক ও রয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদপত্র, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী উক্ত ফ্যাক্টরিতে নূন্যতম অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।

বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন, ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক সেফটি এবং সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দের বিবৃতি অনুযায়ী শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন মনোভাব পোষণ এবং ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই ব্যাপারে তাদের চরম অবহেলা এবং অসাবধানতাকে মূলত এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা যেতে পারে।

তথ্য মতে, মালিক এবং ফ্যাক্টরি পরিচালনা কর্তৃপক্ষ দেশে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রি সংক্রান্ত সকল নিয়ম-কানুন এবং আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে নিজেদের মর্জী অনুযায়ী দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, উক্ত ফ্যাক্টরিতে উপরে বর্ণিত বিভিন্ন অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বহু মূল্যবান জীবন রক্ষা করা সম্ভব হত।

এখন ফ্যাক্টরির অগ্নি বীমার কথায় আসা যাক। সংবাদপত্র, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রকাশিত তথ্য এবং হিসাব অনুযায়ী ফ্যাক্টরিটি সম্পূর্ণভাবে অগ্নি বীমার অনুপযুক্ত এবং অযোগ্য ছিল। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বীমাযোগ্য সম্পত্তির মূল্য ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হলে বীমা প্রস্তাব গ্রহণের পূর্বে পেশাগত সার্ভেয়ার নিয়োগের মাধ্যমে প্রি-ইন্সপেকশন বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।

তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে উক্ত ফ্যাক্টরির অগ্নি বীমা গ্রহণের পূর্বে বীমা কোম্পানি কি প্রি-ইন্সপেকশনের ব্যবস্থা করেছিল? যদি করে থাকে তবে সার্ভেয়ারের প্রতিবেদন কি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল?

বীমা কোম্পানির দায়িত্ব ছিল বিশেষ করে এই ফ্যাক্টরির বেলায় বীমা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। এখান থেকে  বুঝা যায়, অজানা রহস্যজনক কারণে কোন কিছুর পরোয়া বা তোয়াক্কা না করে বীমা কোম্পানি অজ্ঞভাবে বিশাল অংকের টাকার অগ্নি বীমা অবলিখনে সম্মতি প্রদান করে।

বীমা প্রস্তাব গ্রহণ এবং পলিসি ইস্যুর মাধ্যমে বীমা কোম্পানি তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং আইনের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মালিকপক্ষের পাশাপাশি বীমা কোম্পানিও সমানভাবে দায়ী এবং উভয় পক্ষই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাওয়া যোগ্য। নিরাপদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমুহকেও এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং গাফিলতির জন্য দায়ী করা যেতে পারে।

তথ্যমতে, উক্ত ফ্যাক্টরি ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন অর্থাৎ ‘ফায়ার সার্টিফিকেট’ ব্যতিরেকে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এটি একটি গুরুতর অপরাধ।

গণমাধ্যম প্রকাশিত সংবাদগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের এই প্রতিষ্ঠানটি মোটা অংকের ব্যাংক ঋণ নিয়েছে। যা প্রায় হাজার কোটি টাকা। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে ব্যাংক কোনরকম অগ্নি নিরাপত্তা না থাকার পরও ঋণের অর্থ ছাড় করেছে। এখন অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কে কারখানাটির যে চিত্র উঠে আসেছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তাদের বীমা দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? আইনগতভাবে তারা যদি বীমা দাবি না পায়, তাহলে ব্যাংক ঋণ খেলাপি হবে। যার প্রভাব গোটা অর্থনীতিতেই পরে।

আমরা যে দিকটি খেয়াল করছি তা হলো বীমা কোম্পানি যদি যথাযথভাবে প্রি-ইন্সপেকশন করতো তাহলে হয়তো অগ্নি বীমাটি প্রত্যাখান হতো। এতে ব্যাংক তাদের ঋণ ছাড় করতো না। এর কারণ বীমা পলিসি ছাড়া কোনভাবেই ঋণের অর্থ ছাড় করার বিধান নেই। হয়তো ঋণের অর্থ পেতে কারখানার মালিকরা অগ্নি নিরাপত্তার সকল শর্ত পূরণেই সচেতন থাকতো।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ ধরণের দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক প্রাণহানি কমাতে বীমা কোম্পানিরও যথাযথ ভূমিকা রয়েছে। যা গোটা শিল্পখাতে শৃংখলা ফেরাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

তাই ব্যবসা নয়; দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ভবিষ্যতে এই ধরনের ভয়াবহ এবং সর্বনাশা দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সকল বীমা কোম্পানি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। এমনটাই সকলের প্রত্যাশা এবং দাবি।