4159

03/28/2024

সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড: বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে বীমা কোম্পানিগুলোকে

প্রকাশ: ৬ জুন ২০২২

আবদুর রহমান আবির: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় বীমা কোম্পানিগুলোকে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তবে এখন পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক বীমা দাবি উত্থাপন হয়েছে বলে জানিয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো।

শনিবার (৪ জুন) রাত নয়টায় অগ্নিকাণ্ডের পর বিস্ফোরণের এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। এতে আহত হয়েছে আরো দুই শতাধিক। এ ছাড়াও রপ্তানির জন্য প্রস্তুতকৃত এবং আমদানি করা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি নিরূপণের পর দ্রুত বীমা দাবি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো। অনলাইন মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ঘোষণার পাশাপাশি এরইমধ্যে যেসব গ্রাহকের ক্ষতির সংবাদ এসেছে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো।

প্রসঙ্গত, বীমা হলো নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কোন প্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তর করা এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের বীমা করা হয়- জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা।

সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বীমা ক্ষতির তথ্য জানার চেষ্টা করেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এ বিষয়ে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা এবং পুনর্বীমা কোম্পানিগুলোর স্থানীয় শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কথা হয়েছে কয়েকটি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা ও পুনর্বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার (৬ মে) দুপুর পর্যন্ত দু’টি এক্সপোর্ট ইন্স্যুরেন্স পলিসি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদ মামুন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পলিসি দু’টির মধ্যে একটির বীমা অঙ্ক ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই পলিসির আওতায় থাকা সম্পদ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত (টোটাল লস) হয়েছে।

আরেকটি পলিসির বীমা অঙ্কের পরিমাণ ৩২ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা (১ ডলার= ৮৯.২৪ টাকা) । এর মধ্যে ১৫ লাখ মার্কিন ডলারের সম্পদ অক্ষত থাকলেও বাকী ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের সম্পদের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে- বাকী সম্পদের বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

খালেদ মামুন আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত দু’টি পলিসির গ্রাহকের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা তাদেরকে জানিয়েছি- আপনাদের সম্পদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে ভাবতে হবে না, আমরা আপনাদের পাশে আছি। আইন অনুসারে প্রাপ্য সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স। আগে মানুষকে বাঁচান; আপনাদের কোন স্টাফ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের সেবা নিশ্চিত করুন।

সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দাবি ও পুনর্বীমা বিভাগের ম্যানেজার সৈয়দ কামরুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে মৌখিকভাবে দু’টি বীমা পলিসির আওতাধীন সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে সংবাদ এসেছে। তবে এসব পলিসির বীমা অঙ্ক বা ক্ষতির পরিমাণ সংক্রান্ত কোন তথ্য আসেনি। লিখিতভাবেও কোন দাবি উত্থাপন হয়নি।

সৈয়দ কামরুজ্জামান আরো বলেন, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যার কারণে সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রাহকরা তাদের সম্পদের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না। এর কারণে কোম্পানিগুলোর কাছেও তেমন কোন বীমা দাবি নিয়ে আসেনি ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে আমার ধারণা- দু’একদিনের মধ্যে বীমা দাবি উত্থাপন শুরু হবে।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের পুনর্বীমা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরাসরি তাদের অগ্নি বীমা পলিসি ইস্যু করা হয়নি। তবে ৪৫টি বেসরকারি বীমা কোম্পানির পুনর্বীমাকারী হিসেবে এ ঘটনায় তাদের কাছে পুনর্বীমা দাবি উত্থাপন হতে পারে। তবে লোকসানের সীমা যদি পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় তাহলে তাদের বিদেশী পুনর্বীমা কোম্পানির কাছ থেকে সেটা পূর্ণ করা হবে।

গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের এসইভিপি এন্ড হেড অব ডিজিটাল বিজনেস মো. মনিরুজ্জামান খান বলেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। তবে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর রাখতে বলা হয়েছে। যদি কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়, তাহলে দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

সীতাকুণ্ড দুর্ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে অনলাইনে বার্তা প্রকাশ করেছে মেটলাইফ বাংলাদেশ। এই দুর্ঘটনায় হতাহত গ্রাহকদের বীমা দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে বীমা দাবির জন্য অনলাইনে আবেদনের ঠিকানা প্রকাশসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দেয়ার জন্য নিকটস্থ কাস্টমার টাচ পয়েন্ট বা সেলস অফিসের তথ্য দিয়েছে মেটলাইফ।

মেটলাইফ বাংলাদেশ’র হেড অব কমিউনিকেশন্স সাইফুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে আমাদের সকল সেলস অফিসের কর্মকর্তাদের সেখানকার গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় যদি কোন গ্রহক ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে তার বীমা দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধ করা হবে। তবে এ ঘটনার ৪০ ঘণ্টা পার হলেও এখন পর্যন্ত কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)’র যুগ্ম সম্পাদক ও জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমাদের কোম্পানিতে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। তবে যদি কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়, তা দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জেনিথ ইসলামী লাইফ বীমা দাবি দেয়ার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)’র সিনিয়র সহসভাপতি ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন বলেন, সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে সাধারণত আমদানী করা ও রপ্তানির জন্য প্রস্তুতকৃত মালামাল রাখা হতো। যা এক্সপোর্ট ইন্স্যুরেন্সের আওতায় পড়ে এবং বড় বীমা কোম্পানিগুলো সাধারণ এসব পলিসি ইস্যু করে থাকে।

ইমাম শাহীন আরো বলেন, সাধারণত আমদানি-রপ্তানির সকল পণ্যই বীমার আওতায় থাকে। তাই এই অগ্নিকাণ্ডে বড় অঙ্কের বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলোকে। কারণ, এতে অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। তিনি বলেন, সম্পদের ক্ষতিপূরণ দেয় নন-লাইফ বীমা কোম্পানি। অন্যদিকে হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের জীবনের বীমা করা আছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে লাইফ বীমা কোম্পানি।

সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, বীমার নিয়ম অনুসারে সেখানে সার্ভে হবে। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির পাশাপাশি পুনর্বীমা কোম্পানিও সার্ভেয়র পাঠাতে পারে। যেহেতু এটা বড় দুর্ঘটনা, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও অন্যকোন সার্ভেয়র নিয়োগ করতে পারে।

তিনি বলেন, সার্ভে শেষে চূড়ান্তভাবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ হলে বীমা কোম্পানি গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করবে- এটাই নিয়ম। এক্ষেত্রে পুনর্বীমা করা থাকলে পুনর্বীমা কোম্পানি তার অংশ পরিশোধ করবে। আমরা আশা করছি- সঠিকভাবে তদন্ত হবে এবং চূড়ান্তভাবে ক্ষতি নিরূপনের পর সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলো যথাসময়ে তাদের দাবি পরিশোধ করবে।

বিআইএ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, যদি কোন বীমা কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের প্রাপ্য বীমা দাবি পরিশোধ করতে না চায় সেক্ষেত্রে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। তাতেও যদি সমাধান না আসে তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রাহক অভিযোগ করলে তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবে।