577

01/11/2025

ইসলামী বীমার উৎস সমূহ

প্রকাশ: ৩০ আগষ্ট ২০১৭

"ইসলামী বীমার মৌলিক ধারণা ও কর্মকৌশল" একটি পাঠক সমাদৃত বই। ২০১৫ সালে প্রকাশিত বইটি লিখেছেন ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন। তিনি প্রাথমিক মাধ্যমিক মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষা সমাপ্ত করে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরআগে মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় তিনি দু'টি বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং ২০০২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ড. নেছার উদ্দিন ছাত্রজীবন থেকেই লেখা-লেখি ও সাহিত্য চর্চার প্রতি ঝুকে পড়েন। তার লেখা বেশ কিছু বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আল্লাহর শাশ্বত আহবান, সিয়াম সাধনা ও ত্যাগের মহিমা, ইসলামের পারিবারিক জীবন, ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা, ইসলামের মতানৈক্য পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। সীরাতে রাহমাতুল্লিল আলামীন নামে একটি গ্রন্থের তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার আরও বেশ কিছু প্রকাশনা ও গবেষণা কর্ম রয়েছে।

বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মাসিক ম্যাগাজিন পত্রিকা চিন্তাভবনা'র সম্পাদক ও প্রকাশক। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকীতে তার বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন'র এই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে হুবহু তুলে ধরা হলো। আজ থাকছে “ইসলামী বীমার উৎস সমূহ”।

একটি বীমা পলিসি বৈধ থাকবে তার কোন অংশই শরীয়তের নীতিমালা লংঘন না করে। তাই ইসলামী বীমা পলিসির প্রতিটি উৎসই পুরোপুরি শরীয়া'র বিধানের ভিত্তিতে হতে হবে। এই অংশে ইসলামী বীমার উৎস সমূহ আলোকপাত করা হবে।

১. সাধারণ উৎস

ইসলামী আইনের সাধারণ উৎস সমূহ কোরআন ও হাদীস বা মহানবীর (স.) সুন্নাহ'র মাধ্যমে সূচিত হয়েছে। এ দু'টি ইসলামী আইনের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। ইসলামী আইনের অন্যান্য গৌণ উৎস বস্তুত এ দু'টি মৌল উৎসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

ইসলামী আইনের আওতায় বীমার মৌলিক উৎস সমূহ পবিত্র কোরআন এবং হাদীস বা মহানবীর (স.) সুন্নাহ'র উপর বহাল থাকবে এবং সেই সাথে অন্যান্য গৌণ উৎস উপরোক্ত দু'টি প্রাথমিক উৎসের সাথে অবশ্যই সামঞ্জস্যশীল হবে। অধ্যাপক আব্দুর রহমান আদ-দোহ বলেন, কোরআনের আদেশসমূহ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত আচরণ বিধি। সুন্নাহ হচ্ছে পবিত্র কোরআনের পরিপূরক ও ব্যাখ্যামূলক উৎস। সাধারণভাবে, বীমা চুক্তির উৎস সমূহকে নিম্নলিখিতভঅবে ভাগ করা যায়-

ওহী ভিত্তিক বিধান

পবিত্র কোরআনে বৈধতার বিধান সংক্রান্ত ৫ শত আয়াত রয়েছে, অনেক আয়াত আছে, যা বীমা চুক্তির বৈধতা প্রতিপন্ন করে। মানব জাহির সাফল্যের জন্য পরিস্কার বর্ণনা এবং দিক নির্দেশনা থাকায় বলা যায়, বীমা চুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনই প্রধান দিক-নির্দেশনার ভূমিকা পালন করছে।

উপরোক্ত নির্দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লংঘন না করা পর্যন্ত বীমা ব্যবস্থা অনুশীলনের জন্য মানবজাতিকে সুযোগ করে দেয়।

সুন্নাহ বা আল হাদীস

পবিত্র কোরআনের পরপরই হাদীস বা মহানবী (সা.) এর সুন্নাহ দ্বিতীয় উৎস হিসে বিবেচিত। বীমা ব্যবসা সম্পাদন ও অনুশীলনের যৌক্তিকতা প্রশ্নে বাস্তবিকই এমন অনেক হাদীস বা সুন্নাহ আছে, যা এই ধারণা ও অনুশীলনের বৈধতা ও অনুমোদন করে।

আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) এক বেদুঈন যে তার উট না বেঁধে আল্লাহ'র উপর বরসা করেছিল, তাকে বলেন: প্রথমে উট বাঁধো তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। একটি বীমা পলিসি কোন নির্দিষ্ট ভবিষ্যতে ঝুঁকির সময়ে বস্তুগত সাহায্য দেয়ার লক্ষ্যে প্রণীত।

বীমা ব্যবস্থার অন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোও সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত হয় যেমন, "আল-আকিলা" নামক প্রাচীন আরব ঐতিহ্য থেকে বীমা ব্যবস্থার সূত্রপাত যা মহানবী (সা.) তার সময়কালে অনুমোদন করেছিলেন। অধিকন্তু, মৃতের (বীমা গ্রাহক) সন্তান-সন্ততিদের বস্তুগত নিরাপত্তার লক্ষ্যে আগে ভাগেই ব্যবস্থা করার জন্য প্রণীত জীবন বীমা ব্যবস্থাও উক্ত ঐতিহ্যের সাথে সমাঞ্জস্যশীল।

সাহাবায়ে কিরামের অনুশীলন

'আল-আকিলা' মতবাদ থেকে বীমা ব্যবস্থা উদ্ভুত হয়েছে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর আমলের শেষ দিকে তিনি তা পালন করেছেন এবং তা পালন করার জন্য নাগরিকদের নির্দেশ দিয়েছেন।

২. সাদৃশ্যমূলক উৎস

বীমা ব্যবস্থার ধারণা ও অনুশীলনের আরো যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার জন্য কিয়াস, ইসতিহসান, ইজমিসহাবের মতো সাদৃশ্যমূলক উৎস ব্যবহার করা যেতে পারে, যতক্ষণ না তা পবিত্র কোরআন ও মহানবীর (স.) সুন্নাহ'র পরিপন্থী হয়। তাছাড়া মহানবী (স.) নিজেও পরামর্শ দিয়েছেন, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী না হলে প্রয়োজনবোধে সাদৃশ্যমূলক সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করার, আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি, শিক্ষা গ্রহণ করো।'

আধুনিক বীমা ব্যবস্থা ও ইসলাম

বীমা ব্যবস্থার আধুনিক রূপটি ঠিক একইভাবে মহানবী (স.) এর সময়ে বিদ্যমান ছিল না। অবশ্য, মানুষের প্রয়োজন এবং মানবজাতির অবস্থান সময় ও যুগের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হয়ে আসছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বীমা ব্যবস্থা প্রচলনের প্রয়োজন হয়, যাতে করে সমাজের অপ্রত্যাশিত ক্ষীত, লোকসান বা দুর্দশার শিকার লোকদের বস্তুগত নিরাপত্তা দেয়ার একটি পথ বের করা যায় জরুরি ভিত্তিতে। তাই বীমা ব্যবস্তা জনস্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয়, যা ক্ষতিগ্রস্তকে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে উদ্ধার করে। মানুষের জন্য বীমা ব্যবস্তার তাৎপর্য হলো অন্য অনেক কিছুর মধ্যে জীবনকে সাবলীল করা, যা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না। (আল কুরআন)

ফিকহ শাস্ত্র ও ইসলামী বীমা

ফিকহ শাস্ত্রে বীমা ব্যবস্থার পক্ষে রায় রয়েছে। 'ফিকহ আল-সুন্নাহ' নামক গ্রন্থে বীমা ব্যবস্থার বৈধতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বীমা ব্যবস্থার সাধারণ মূলনীতির ভিত্তি হচ্ছে 'আল-আকদ', 'আল-মুদারাবা', আল-ওয়াকালা', 'আল-শিরকাহ' ইত্যাদি, যা তার পুস্তকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লামা মুরগিনানির "হেদায়া" গ্রন্থেও অংশীদারিত্ব, "ওয়াকালা" এবং বীমার সাথে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ফিকহ শাস্ত্রের অন্যান্য পুস্তকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, আংশিক বা পূর্ণভাবে, বীমা ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম মুহাম্মদ  (রহ.) এর আল মাবসুত নামক গ্রন্থেও ইসলামী বীমার আলোচনা রয়েছে।

দেশ-বিদেশের আইন ও বিদান এবং ইসলামী বীমা

সমসাময়িক বিশ্বে এখন শরীয়াহভিত্তিক অনৈক বীমা কোম্পানি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মালয়েশিয়া, সুদান, ব্রুনেই, কাতার, সৌদি আরব এবং আরো কিছু দেশ। এসব ইসলামী বীমা কোম্পানি শরীয়ার বিধান অনুযায়ী কাজ করেছে এবং নিজ নিজ দেশের পার্লামেন্টে কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়মকানুন দ্বারা অনুমোদিত। এ ব্যাপারে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো দি তাকাফুল অ্যাক্ট (মালয়েশিয়া) ১৯৮৪ (অ্যাক্ট নং ৩১২) । মালয়েশিয়ায় ইসলাম ভিত্তিক বীমা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেন্ট এই বিধান প্রণয়ন করেছে।

শরীয়াহ বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ

শরীয়াহভিত্তিক বীমা কোম্পনিতে "শরীয়াহ উপদেষ্টা বোর্ড" নামে একটি পরিষদ বা বোর্ড থাকে। এই বোর্ড কোন নির্দিষ্ট কোম্পানির ইসলামী বীমা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে, শরীয়াহর বিধানের সাথে কোম্পানির সমস্ত কার্যক্রম নিশ্চিত করে, এবং কিছু কিচু প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে ইসলামী বীমা কোম্পানিকে বিধি বিধানের মধ্যে চলতে বাধ্য করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 'মালয়েশিয়ান তাকাফুল অপারেশনকে 'দি তাকাফুল অ্যাক্ট', এর ৮(৫) 'অধ্যায় মতে, একটি 'শরীয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিল' তত্ত্বাবধান করে ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই প্রণীত সাধারণ তাকাফুল (বীমা) অ্যাক্টে এ ব্যাপারে লিখিত নির্দেশনা এবং কার্যপ্রণালী রয়েছে। অধিকন্তু সুদানে একটি 'শরীয়াহ সুপারভাইজরি বোর্ড' আছে, যা অন্য অনেক কিছুর সাথে সে দেশের বীমা ব্যবসা তত্ত্বাবধান করে এবং 'রুলস অব দি শরীয়াহ সুপারভাইজরি বোর্ড' অনুমোদন করেছে।

উপমা ও দৃষ্টান্ত

বীমার আইন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী নজিরও অন্যতম উৎস। অনেক সময়, ইসলামী বীমা ব্যবস্থার পরিচালনা ব্যবস্থার মধ্য থেকে অনেক আলেম অনেক বিষয়ের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। যেমন, ইবনে আবেদীন যে মতামত দিয়েছেন, তাই পরবর্তীকালে বীমা সংক্রান্ত বিষয়াবলীতে সরকারি বিভাগ ও বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ দিতে উচ্চ পর্যায়ের মুফতিদের প্রভাবিত করেছে। মুফতি মোহাম্মদ আব্দুহ অনেকবার বলেছেন, বীমা পলিসি ও ব্যবস্থা জায়েজ। নিরপেক্ষ ইসলামী ব্যক্তিদের এসবনজির ছাড়াও বীমা ব্যবস্থা সংক্রান্ত আদালতসমূহের রায় রয়েছে। বীমা আইনের বৈধ উৎস হিসেবে এসব নজিরও বিবেচনা করা যেতে পারে।

ইসলামী বীমা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও পর্যালোচনা হচ্ছে শুধু তা নয়। ইসলামী বীমার তৎকালীন আরব ধারণা মুহাম্মদ (স.) পূর্বেকার নবীদের সময়কালে পাওয়া যায়। সমাজ ব্যবস্থায় কতিপয় রীতিনীতির মধ্যে এর ধারণা পাওয়া যায়। রাসূলের যুগে এবং সাহাবায়ে কিরামের সময়কালে অসংখ্য ঘটনা এই ধারণাকে সমর্থন করে। ফলে প্রচলিত বীমা ব্যবস্থার ইতিহাস থেকে ইসলামী বীমা ব্যবস্থার ইতিহা অনেক প্রাচীন বলে ধারণা করার প্রমাণ পাওয়া যায়।