আড়াই বছরেও টাকা না পাওয়ার অভিযোগ ৩১ গ্রাহকের

নওগাঁ-নাটোরের শত শত গ্রাহকের টাকা দিচ্ছে না সানলাইফ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা করে বিপদেই পড়েছেন নওগাঁ ও নাটোরের শত শত গ্রাহক। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বীমা টাকা পাচ্ছেন না সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকরা। আড়াই বছর কেটে গেলেও বীমার টাকা পায়নি বলে অভিযোগ করেছেন কোম্পানিটির ৩১ বীমা গ্রাহক। শাখা কার্যালয় থেকে শুরু করে প্রধান কার্যালয়েও ধর্ণা দিয়ে টাকা তুলতে পারেননি এসব গ্রাহক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের নওগা ও নাটোর অঞ্চলের ৩১ জন বীমা গ্রাহকের মধ্যে ২৪ জনের পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। বাকী ৭ জনের পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে। দশ বছর মেয়াদী এসব বীমা পলিসি ইস্যু করা হয়েছে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে। তাদের মূল পাওনা ৬ লাখ ২৭ হাজার ৬২৮ টাকা।

এ ছাড়াও অঞ্চল দু'টিতে আরো কয়েকশ' বীমা গ্রাহকের পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের কারো পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর দেড় থেকে দু'বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো টাকা ফেরত পায়নি। লাভ তো দূরের কথা, তাদের জমানো টাকা কবে নাগাদ ফেরত পাবেন সে বিষয়েও তারা কিছুই জানেন না।  

নাটোরের নলডাঙ্গার বীমা গ্রাহক রেজাউল হক জানান, ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে তিনি একটি বীমা করেন। ১০ বছর মেয়াদী এ বীমা পলিসির নম্বর ১৭৯৭০০০১৭-৮। মাসিক ২০০ টাকা হারে ১২০টি কিস্তি পরিশোধ করেছেন তিনি। ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তার বীমা পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। এরপরই সব ধরণের কাগজপত্র ও ব্যাংক হিসাব নম্বর জমা নিয়েছে বীমা কোম্পানি।

কিন্তু আড়াই বছরের বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত তিনি বীমার টাকা পাননি। কবে পাবেন সে বিষয়েও কিছুই জানায়নি বীমা কোম্পানিটি। পেঁয়াজের ব্যবসা করে অনেক কষ্টে এসব টাকা জমিয়েছেন বলে জানান ভুক্তভোগী এ বীমা গ্রাহক। তিনি বলেন, খরচ যোগাতে না পেরে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া প্রায় বন্ধের পথে। এই দুঃসময়ে বীমার টাকাটা পেলে তার অনেক উপকার হতো।

রেজাউল হক আরো জানান, তার বড় ভাবি নাজমা বেগমের বীমার টাকাও পাচ্ছেন না। দু'বছর আগের তার পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর বীমা কোম্পানি সকল কাগজপত্র জমা নিয়েছে। ব্যাংক হিসাব নম্বরও নিয়েছে। বলেছিল, মাসখানিকের মধ্যেই টাকা পাবেন। কিন্তু আজ দু'বছরের বেশি সময় হলো কিন্তু টাকা পাননি নাজমা বেগম। এখন বীমা কোম্পানির লোকজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। যিনি তাদের বীমা করিয়েছেন তিনি এখন শিক্ষকতা করতে নিজ এলাকা নওগাঁ চলে গেছেন।

নওগাঁর রানীনগরের ভুক্তভোগী বীমা গ্রাহক রিনা বেগম জানান, তিনি ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে মাসিক ২০০ টাকা কিস্তিতে ১০ বছর মেয়াদী একটি বীমা করেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে। দু'ই মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতেই কষ্ট হচ্ছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। অনেক টাকা প্রয়োজন। বীমার টাকার আশায় আছেন তিনি। কিন্তু আড়াই বছর পার হলেও সে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।

রিনা বেগম আরো জানান, বীমা কোম্পানি থেকে তাদের জানিয়েছেন কোন লাভ দেয়া হবে না। শুধু মূল টাকাটা ফেরত পাবেন তারা। তিনি বলেন, এতো দিন ধরে কষ্ট করে টাকা জমিয়েছি কিছু লাভ পাব বলে। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা মূল টাকাই ফেরত পাচ্ছি না। মূল টাকা ফেরত দিলে তাও আমারা বেঁচে যাই।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের নাটোর শাহগোলা ব্লকের ম্যানেজার মো. রাব্বিল হোসাইন জানান, তিনি বীমা কোম্পানিটির ১৫২টি পলিসি বিক্রি করেছেন। এরমধ্যে প্রায় ১শ' পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রিমিয়াম বাবদ গ্রাহকরা এসব পলিসিতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা জমা দিয়েছে। মুনাফা তো দূরের কথা এখন আসল টাকাই ফিরে পাচ্ছে না গ্রাহক।

তিনি বলেন, প্রথম দফায় ৪৫ জন বীমা গ্রাহকের তালিকা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে পাঠানো হয়েছে। যাদের বীমা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে আড়াই বছরের বেশি সময় হলো। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫টি পলিসির চেক পেয়েছেন গ্রাহক। সম্প্রতি এই ১৫ গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করা হলেও বিলম্বে পরিশোধ করা জন্য তাদের কোনো সুদ দেয়া হয়নি। এমনকি কোন লাভও দেয়ানি বীমা কোম্পানি।

স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাব্বিল হোসাইন জানান, আড়াই বছর ধরে তিনি বীমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয় ও শাখা কার্যারয়ে ধর্ণা দিয়েও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব গ্রাহকের জন্য কোনো প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূখ হয়ে পড়েছেন তিনি। শুধু তার করা পলিসিই নয়, আশাপাশে আরো কয়েকশ' বীমা গ্রাহক কোম্পানিটির কাছে টাকা পাবেন বলেও জানান রাব্বিল হোসাইন।

অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, এগুলোর প্রায় সবই ক্ষুদ্রবীমার পলিসি। তবে তালিকার প্রায় অর্ধেক পলিসির টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকীগুলোর টাকাও প্রধান কার্যালয় থেকে ছাড় করা হয়েছে। খুব শিগগির বাকীরাও টাকা পেয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, আগের কিছু দাবি কোম্পানি থেকে পরিশোধ না করায় এখন অনেক দাবি পাওনা রয়েছে। তবে এখন সব দাবিই পরিশোধ করা হচ্ছে। বড় বড় ফান্ড এখন ছাড় করা হচ্ছে দাবি পরিশোধের জন্য। জটিলতার কারণে কিছু সময় লাগলেও খুব শিগগিরই সবাই টাকা পেয়ে যাবেন।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী আরো বলেন, নওগাঁ ও নাটোরের গ্রাহকদের টাকা দ্রুত পরিশোধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আগামী দু'এক দিনের মধ্যেই সবাই টাকা পাবেন। সেখানকার বীমা কর্মী হয়তো আর কাজ করছে না, এ জন্য দাবি পরিশোধে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে গ্রাহকদের লাভ দেয়া হচ্ছে না, এমন কোন অভিযোগের কথা আমার জানা নেই।

উল্লেখ্য, বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারায় বলা হয়েছে মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে দাবি পরিশোধ করতে হবে। এতে দেরি হলে প্রচলিত ব্যাংক রেটের অতিরিক্ত শতকরা ৫ ভাগ হিসেবে মাসিক ভিত্তিতে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।