করোনায় বড় কষ্টে দিন কাটছে বীমা কর্মী খোকনদের

আবদুর রহমান আবির: খোকন কুমার দাস। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার কল্যাণপুর গ্রামে তার বাড়ি। বাবা-মা আর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সংসার। অভাব অনটনের সংসারে হাল ধরতে ছাত্র জীবনেই যোগদান করেন খণ্ডকালীন চাকরিতে। পেশা হিসেবে বেছে নেন বীমা এজেন্ট। বেসরকারি একটি বীমা কোম্পানির ফিনান্সিয়াল এসোসিয়েট বা এফএ হিসেবে শুরু হয় তার কর্মজীবন।

সেই ২০০১ সালের অক্টোবরে কর্মজীবন শুরু করেন খোকন। আর থেমে যাওয়া হয়নি। দীর্ঘ এই ১৯ বছরে টেবিল বদল হলেও বদল হয়নি তার পেশা। বর্তমানে তিনি একটি বীমা কোম্পানি ডিস্ট্রিক কো-অর্ডিনেটর বা ডিসি। এফএ, ইউএম, বিএম, বিসি ও পিওনসহ ২৫ জনের বেশি লোক কাজ করছেন তার অধীনে। বীমা আইন ও কোম্পানির বিধান অনুসারে সবাই কমিশন ভিত্তিতে কাজ করছেন।

বীমা কোম্পানির বেধে দেয়া ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর ভিত্তি করে আসে অফিস পিওনসহ খোকনদের বেতন-ভাতা। নবায়ন প্রিমিয়াম ছাড়াও বছরে আধা কোটি টাকার বেশি নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেন তারা। কিন্তু কমিশনের বাইরে অতিরিক্ত কোন সুযোগ-সুবিধা দেয় না বীমা কোম্পানি। তারপরও থেমে নেই তাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের লড়াই। এ যেন চলছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।

ভালোই যাচ্ছিল খোকনদের জীবন সংসার। তবে সব কিছু থমকে দিয়েছে করোনা ভাইরাসের মহামারী। সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রেক্ষিতে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে সাধারণ ছুটি। নির্দেশনা অনুসারে বন্ধ রয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান। ঘর থেকে বের হতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।  

এদিকে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির কমিশন ভিত্তিক এসব এজেন্ট। দীর্ঘ এই বন্ধে বীমা শিল্পের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী মাস শেষে বেতন-ভাতা পেলেও কোন কমিশন পাবেন না এসব বীমা এজেন্ট। নিয়ম অনুসারে বীমা পলিসি বিক্রির নির্ধারিত কমিশনের বাইরে তাদের কোন বেতন-ভাতা নেই।

বীমা কর্মী খোকন বলেন, প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে যে কমিশন আসতো তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোন মতে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে যেতো। কিন্তু করোনা আমাদের এই সামান্য উপার্জনও বন্ধ করে দিয়েছে। লকডাউনের কবলে পড়ে বন্ধ হয়েছে সব ব্যবসা বাণিজ্য। তাই আসছে না কোন প্রিমিয়াম। আর প্রিমিয়াম না আসায় একটা টাকাও আমাদের ঘরে আসার সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় বড় বিপদে আছি পরিবার ও কর্মীদের নিয়ে।

খোকন কুমার দাস বলেন, বীমা কর্মীরা প্রায় প্রতিদিনই আমাকে ফোন করছে। বলছে, ভাই আমাদের জন্য কিছুই করলেন না! এক মুষ্টি চাল বা একটা মরিচও দিলেন না! সবকিছু একদম লকডাউন করে রেখেছেন। প্রিমিয়াম আসছে না বলে কোন কমিশনও পাচ্ছি না। হাতে থাকা টাকা-পয়সাও শেষ। এখন আমরা কারো কাছে হাত পাততেও পারছি না। আবার কোম্পানিও কোন সহযোগিতা করছে না। আমরা বেঁচে আছি কিনা সেই খোঁজটাও নিচ্ছে না কোম্পানি।

কুষ্টিয়ার এই বীমা কর্মী বলেন, ছেলে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আর মেয়েটা সেভেনে পড়ে। তাদের পড়ালেখার খরচ ঠিকই বহন করতে হচ্ছে। আবার অসুস্থ বাবা-মা আছেন আমার ঘরে। তাদের ওষুধপত্রও কিনতে হয় নিয়মিত। আমি অন্য কোন পেশায় জড়িত নই, তাই বিকল্প উপার্জনও নেই। প্রায় ১৯ বছর ধরে জীবন-মরণ সপে দিয়েছি বীমা কোম্পানিকে। কোটি কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছি কোম্পানির জন্য। কিন্তু আজ এই বিপদের সময়ে পাশে পাচ্ছি না নিজের কোম্পানিকে।

ডিস্ট্রিক কো-অর্ডিনেটর খোকন বলেন, কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করেছি। মাঠ কর্মীদের কষ্টের কথাগুলো তাদের জানিয়েছি। বলেছি, আমরা বড় কষ্টে আছি। সংকটের এই মুহুর্তে বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু হলেও কর্মীদেরকে সহযোগিতা দেয়া বড় প্রয়োজন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অফিস বলছে, সব টাকাইতো গ্রাহকদের। কমিশনের অতিরিক্ত কোন খরচ করার সুযোগ নেই। তাছাড়া লকডাউনের কারণে এখন সবাই ছুটিতে আছে। তাই বিকল্প কিছু করতেও পারছি না।  

উল্লেখ্য, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি ৭৮টি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। নতুন আরেকটি লাইফ বীমা কোম্পানি সম্প্রতি অনুমোদন লাভ করেছে। এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্টসহ এসব বীমা কোম্পানির বিভিন্ন পদে কাজ করছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ নারী-পুরুষ।

২০১৮ সালের হিসাব অনুসারে দেশের ৩২টি লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট সংখ্যা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৫১। আর এমপ্লয়ার অব এজেন্ট রয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ১৭৮। অন্যদিকে ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট সংখ্যা ২ হাজার ৬০৭। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বর্তমানে এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্ট সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়েছে।