প্রফেসর রুবিনা হামিদসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রাহকদের দায়ের করা প্রতারণার মামলায় প্রফেসর রুবিনা হামিদসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। গত বছর অক্টোবরে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম এম মোর্শেদ পৃথক ২টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির তৎকালীন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম, বর্তমান অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম রেজা, এ এম ডি (অর্থ ও হিসাব) মো. সাইদুর রহমান রনি এবং কোম্পানি সচিব মো. রবিউল ইসলাম। বীমা দাবির টাকা পরিশোধ না করায় প্রতারণার অভিযোগ এনে এসব মামলা করেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কুষ্টিয়ার বীমা গ্রাহকরা।
মামলার প্রধান আসামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রুবিনা হামিদ। তিনি কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রয়াত কর্নেল (অব.) এ মালেক পিএসি এর মেয়ে ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি’র বোন।
এর আগে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি।
গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে আজ বুধবার বেলা ১টার দিকে বনানী থানার ডিউটি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করা হলে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, আমরা ওয়ারেন্টের কপি হাতে পেয়েছি। তবে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে সরাসরি থানায় যোগাযোগ করতে বলেন।
মামলার আইনজীবী আবদুল মতিন জানিয়েছে, আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে আসামিদের ধরে আনার আদেশ দিয়েছে আদালত। এই সময়ের মধ্যে আসামিরা আদালতে হাজির না হলে পরবর্তীতে আসামিদের স্থাবর-অবস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ জারি করবেন আদালত।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও মামলার আসামিদের মধ্যে কেউ গ্রেফতার হয় নাই। এর মধ্যে যারা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কর্মরত তারা নিয়মিত তাদের অফিস করছেন। মামলার অপর আসামি শরীফুল ইসলাম সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে পদ্মা ইসলামী লাইফে যোগদান করেছেন। সেখানে তিনি নিয়মিত অফিস করছেন বলে নিশ্চিত করেছেন পদ্মা ইসলামী লাইফের কর্মকর্তারা।
প্রতারণার এ ২টি মামলা করেন দৌলতপুরের খলিশাকুন্ডি গ্রামের মো. মনিরুজ্জামান ডাবলু। তিনি এ মামলা করেন কুষ্টিয়ার ৮৮ জন গ্রাহকের পক্ষে। এসব গ্রাহকের বীমা দাবি বাবদ পাওনা টাকার পরিমাণ ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭২ টাকা। দণ্ডবিধি ৪০৬/ ৪২০/ ৩৪ ও ৫০৬(বি) ধারায় মামলা দু’টি করা হয়। মামলা নং- সি/আর ২৫৬/২০২০ এবং সি/আর ৩০৯/২০২০। গত ১ মার্চ কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম এম মোর্শেদ গ্রেফতারি পরোয়ানার এ আদেশ দেন।
এছাড়া আরো ৪টি মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে দৌলতপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে সিআর-৪৭৫/২০২০ নং মামলায় ২৫ জানুয়ারি, ২০২১; সিআর- ৪৫৮/২০২০ নং মামলায় ২০ জানুয়ারি, ২০২১, সিআর- ৪৩৫/২০২০ নং মামলায় ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ এবং সিআর-৩৯২/২০২০ নং মামলায় ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে এ আদেশ জারি করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বাদী মনিরুজ্জামান ডাবলুসহ এলাকার ৮৮ জন বাসিন্দা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে বীমা করেন। এসব গ্রাহক নিয়ম অনুসারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন। তবে মেয়াদ শেষ হলে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ না করে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
এ অবস্থায় ২০২০ সালের ১৫ জুলাই ও ১৩ সেপ্টেম্বর পৃথক দু’টি লিগ্যাল নোটিশে তিন দিনের মধ্যে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে বলেন বাদী মনিরুজ্জামান ডাবলু। এ প্রেক্ষিতে টাকা নিতে কুষ্টিয়ার খলিসাকুন্ডি বাজার শাখায় বীমা গ্রাহকদের আসতে বলেন আসামিরা।
কিন্তু গত ৩০ জুলাই ও ১৭ সেপ্টেম্বর বাদীসহ অন্যান্য গ্রাহকরা টাকা নিতে আসলে আসামিরা পাওনা পরিশোধে অস্বীকার করেন। এ সময় গ্রাহকদের হুমকি-ধামকিও দেয়া হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ১৬ আগস্ট ও ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন বাদী মনিরুজ্জামান ডাবলু। মামলা নং সি আর- ২৫৬/২০২০ এবং মামলা নং সি আর- ৩০৯/২০২০।
আইনজীবী আবদুল মতিন খন্দকার বলেন, মেয়াদ শেষ হলেও ৪/৫ বছর ধরে গ্রাহকদের পাওনা টাকা দিচ্ছে না সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আমার কাছে যেসব অভিযোগ রয়েছে তাতে কোটি টাকার বেশি পাওনা এসব গ্রাহকের। কোনভাবেই গ্রাহকদের পাওনা টাকা দিচ্ছে না আসামিরা। এ কারণে প্রায় ৪০টি মামলায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কেউ গ্রেফতার হয়নি।
আবদুল মতিন জানান, সবশেষ ৩০৯/২০২০ নং মামলায় আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে এবং ২৫৬/২০২০ নং মামলায় আগামী ৩ মে’র মধ্যে আসামিদের ধরে আনতে বলা হয়েছে। তা না হলে পরবর্তীতে আসামিদের স্থাবর-অবস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ জারি করবেন আদালত। তবে এই সময়ের মধ্যে আসামিরা আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করতে পারবেন। আদালত চাইলে তাদের জামিন মঞ্জুর করতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান প্রফেসর রুবিনা হামিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।
কোম্পানিটির বর্তমান মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি কল কেটে দেন, মেসেজ দিলেও সাড়া দেননি।
তবে সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন।
বর্তমানে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। রুবিনা হামিদ কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রয়াত কর্নেল (অব.) এ মালেক পিএসি এর মেয়ে ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি’র বোন। এর আগে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি’।
কোম্পানিটি অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন, কর্ণেল মালেকের স্ত্রী ফৌজিয়া মালেক, জাহিদ মালেকের স্ত্রী শাবানা মালেক ও ছেলে রাহাত মালেক, রুবিনা হামিদের স্বামী ড. কাজী আখতার হামিদ ও ছেলে রায়ান হামিদ।
এ ছাড়াও কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন- এক্সিম ব্যাংকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ফজল বুলবুলের স্ত্রী অ্যাডভোকেট শায়লা ফেরদৌস শান্তাজ বানু, আলহাজ মফিজুর রহমান কোম্পানির স্পন্সর ডাইরেক্টর, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম ও জয়নাল আবেদিন এফসিএ কোম্পানির ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডাইরেক্টর।
কোম্পানিটির তথ্য অনুসারে, ২০০০ সালের ১ মার্চ ব্যবসা শুরু করে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১২ সালের ১ অক্টোবর। সর্বশেষ ২০২০ সালে কোম্পানিটি ১০২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। বর্তমানে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ১৮৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং মোট বিনিয়োগ ১৩০ কোটি ১৮ লাখ টাকা।