ফারইস্টের বকেয়া দাবি বেড়ে ১৩শ’ কোটি টাকা, আইডিআরএ’র কাছে শত শত গ্রাহকের অভিযোগ
আবদুর রহমান আবির: ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা। কোম্পানিটির নতুন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিন গত ৬ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’কে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানিয়েছিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবির পরিমাণ প্রায় ৭৮০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গেলো বছরের শেষ তিন মাসে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫২০ কোটি টাকা।
দীর্ঘ দিনেও এসব বীমা দাবি পরিশোধ না করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন শত শত ভুক্তভোগী গ্রাহক। তবে নগদ তহবিলের সংকটের কারণে এসব বীমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানিয়েছে বীমা কোম্পানিটি।
এদিকে বীমা গ্রাহকদের দায় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও সম্পদের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই বীমা কোম্পানির। গত ১৮ নভেম্বর এক চিঠিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’কে এমন তথ্য দেয় বিএসইসি নিযুক্ত কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
বীমা কোম্পানিটির একজন ভুক্তভোগী গ্রাহক আলাউদ্দিন। লক্ষ্মীপুরের রামগতি থানার চরলক্ষ্মী গ্রামে তার বাড়ি। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি বলেন, আমি ও আমার ভাই ফখরুদ্দিন ফারইস্টে দু’টি বীমা করেছিলাম। ২০২০ সালের এপ্রিলে এগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকা দেয়নি বীমা কোম্পানি।
আলাউদ্দিন বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে কোম্পানিটি ঘুরাচ্ছে। বলছে, অফিসের অবস্থা ভালো না তাই টাকা দিতে পারছে না। গেলো বছর আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত বীমার টাকা পাইনি। অনেক কষ্ট করে আমরা কিস্তি দিয়েছি। এখন লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাও পাচ্ছি না।
রামগতির আরেক বীমা গ্রাহক আইয়ুব আলী বলেন, এক বছর আগে আমার বীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে। সব কাগজপত্র জমা নিয়েছে। কিন্তু এখনো বীমার টাকা পাইনি। মাঠকর্মী আবুল বাশার বলেছে, কোম্পানি থেকে এখনো টাকা দেয়নি, তাই তারা দিতে পারছে না। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে অভিযোগ করেছি কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না।
একই এলাকার বীমা গ্রাহক আবদুল কুদ্দুস, দেড় লাখ টাকার বেশি পাওনা ফারইস্ট ইসলামী লাইফের কাছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তার পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কাগজপত্র জমা দেয়ার পর বছর শেষ হলেও বীমার টাকা দিচ্ছে না কোম্পানিটি। তিনিও আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু টাকা পাননি এখনো।
এদিকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী হিসেবে অনুমোদন পেতে কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিলকৃত কোম্পানিটির ব্যবসা বৃদ্ধির পরিকল্পনায় ওয়াসিউদ্দিন লিখেছেন, দীর্ঘদিন যাবত গ্রাহকের মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারার কারণে মাঠ পর্যায়ে মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহ ব্যহত হচ্ছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বিগত সময়ে প্রতিমাসে যেখানে নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ ৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ হতো বর্তমানে তা কমে ৫০ কোটি টাকাতে নেমে এসেছে। বকেয়া বীমা দাবিগুলো পরিশোধ করা গেলে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম ও নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এ ছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত নগদ অর্থের অপ্রতুলতার কারণে বীমা দাবি পরিশোধ না করায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রাহকগণ তাদের বীমার দাবির জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে বকেয়া মেয়াদোত্তর বীমা দাবি পরিশোধ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আইডিআরএ’র বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন ওয়াসিউদ্দিন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দেয়া বিগত তিন বছরের অনিষ্পন্ন বীমা দাবির তথ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ জানিয়েছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও মৃত্যুদাবি বাবদ কোম্পানিটির কাছে ১ লাখ ৯২ হাজার ২৪৭ গ্রাহকের পাওনা বকেয়া রয়েছে। টাকার অংকে যার পরিমাণ ১২৫৩ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার ৯১৬ টাকা। এ সময়ে ২৭২৩ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৭ কোটি টাকার ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১২০টি বীমা দাবি উত্থাপন করা হয়।
২০২০ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মোট প্রিমিয়াম আয় ছিল ৯৭৩ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫৯৪ টাকা। যা আগের বছর ২০১৯ সালে ছিল ১০৫৬ কোটি ৪ লাখ ১১ হাজার ১৫৯ টাকা এবং ২০১৮ সালে কোম্পানিটির মোট প্রিমিয়াম আয় ছিল ১০৫৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৩৮ টাকা।
উল্লেখিত প্রিমিয়াম সংগ্রহে বীমা কোম্পানিটি ২০২০ সালে ২৬২ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার ২৭৩ টাকা, ২০১৯ সালে ৩৪৬ কোটি ১৯ লাখ ১৮ হাজার ৪৪০ টাকা এবং ২০১৮ সালে ৩৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৬ টাকা ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী (সিসি) চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি কথা বলার বিষয় উল্লেখ করে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।