২৬ কোটি টাকার তহবিল তছরূপ-ভ্যাটের ১৩ কোটি: 'আইডিআরএ বলেনি, আমরাও কিছু করিনি'
আবদুর রহমান আবির: ভ্যাট ফাঁকি ও তহবিল তছরূপ সহ ১৩০টি অনিয়ম করায় মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে ৪ কোটি টাকা জরিমানা করে বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। পরে জরিমানার এই টাকা কমিয়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা করা হয়। কিস্তিতে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে চাইলে তাও অনুমোদন করে আইডিআরএ।
তবে ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের টাকা আড়াই বছরেও পরিশোধ করেনি মেঘনা ইন্স্যুরেন্স। অন্যদিকে কোম্পানিটির তছরূপকৃত প্রিমিয়ামের সাড়ে ২৬ কোটি টাকা উদ্ধারেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
বীমা কোম্পানিটি বলছে, পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কিছু না বলায় তারা ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করেনি। আর তহবিল তছরূপের বিষয়ে কোম্পানিটির বক্তব্য- এ জন্য তো জরিমানা দিচ্ছি।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ যেমন ১৩ কোটি টাকার বেশি হবে, তেমনি তছরূপ করা প্রিমিয়ামের পরিমাণও অনেক বেশি।
আইডিআরএ’র তদন্তে ভ্যাট ফাঁকি ও তহবিল তছরূপের পরিমাণ কমে যাওয়ার তথ্যটি পাওয়া গেছে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দলের তদন্তে তুলে ধরা মোট প্রিমিয়াম আয়ের তুলনায় বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকাশিত মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায়।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র পরিদর্শন দলের প্রতিবেদন অনুসারে ভ্যাট ফাঁকি ১৩ কোটি টাকা। প্রতিবেদনটিতে ভ্যাট ফাঁকির এই হিসাবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ধরা হয়েছে ১৯৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩১ টাকা।
অথচ বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালেই মোট প্রিমিয়াম আয় ১৪১ কোটি ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ৪১৮ টাকা।
যদিও বীমা কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় দেখানো হয়েছে ১১৪ কোটি ৮১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৪৫ টাকা।
অর্থাৎ আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম আয় কম দেখিয়েছে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৩ টাকা। যার ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট হিসাব করা হলে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ আরো বেড়ে যায় ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৬ হাজার ৩৩৬ টাকা।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, আর্থিক প্রতিবেদন ও প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের হিসাব ধরা হলে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ বাড়ে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৬ হাজার ৩৩৬ টাকা।
অপর দিকে আইডিআরএ’ পরিদর্শন প্রতিবেদনে মোট প্রিমিয়াম আয়ের হিসাবে সাথে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের তুলনা করা হলে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ আরো বাড়বে।
পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মোট প্রিমিয়াম ৭১ কোটি ৪০ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৯ টাকা। আর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রকৃত প্রিমিয়াম আয় ১৪১ কোটি ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ৪১৮ টাকা।
অর্থাৎ আইডিআরএ’র পরিদর্শন দলের প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের চেয়ে ৭০ কোটি ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫৮৯ টাকা কম। এই হিসাবে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ আরো বাড়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৮ টাকা।
অর্থাৎ আইডিআরএ’র পরিদর্শন দলের প্রিমিয়াম আয়ের সাথে প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের তুলনা করলে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ আরো বেড়ে যায় ১০ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৮ টাকা।
সোয়া কোটি টাকা জরিমানায় চাপা পড়েছে সাড়ে ২৬ কোটি টাকার প্রিমিয়াম গোপন
শুধু ভ্যাটের টাকাই যে পরিশোধ করেনি তা নয়, বরং অপ্রদর্শিত প্রিমিয়ামের টাকাও পরবর্তীতে কোম্পানির হিসাবে দেখায়নি মেঘনা ইন্স্যুরেন্স। ফলে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েই ধামাচাপা পড়েছে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৩ টাকার গোপনকৃত প্রিমিয়াম।
তবে আইডিআরএ’র পরিদর্শন প্রতিবেদনের সাথে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ তুলনা করলে প্রিমিয়াম গোপনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫৮৯ টাকা।
পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মোট প্রিমিয়াম ৭১ কোটি ৪০ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৯ টাকা। আর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রকৃত প্রিমিয়াম ১৪১ কোটি ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ৪১৮ টাকা।
অর্থাৎ আইডিআরএ’র পরিদর্শন দলের প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের চেয়ে ৭০ কোটি ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫৮৯ টাকা কম।
বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রিমিয়াম আয় গোপন করার অর্থ হচ্ছে গ্রাহকের প্রিমিয়াম হিসাবে জমা করা অর্থ আত্মসাৎ করা।
তবে আইডিআরএ বীমা কোম্পানিটির গোপন প্রিমিয়াম প্রদর্শনের বিষয়ে যেমন কোন নির্দেশনা দেয়নি, তেমিন গ্রাহকের জমা করা প্রিমিয়াম আত্মসাতের বিষয়েও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও প্রশাসক নিয়োগ সহ ফৌজদারী আইনে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল মেঘনা ইন্স্যুরেন্সকে।
তথ্য অনুসারে, বাকী ব্যবসা, ক্যাশ লেনদেন, প্রিমিয়াম আয় কম দেখানো, ভ্যাট-ট্যাক্স ও উৎসে কর ফাঁকি, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তহবিল তছরূপ সহ ১৩০টি অপরাধে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং কোম্পানিটির ১০টি শাখা ম্যানেজারকে মোট ৪ কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করে আইডিআরএ।
একইসাথে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালে ফাঁকি দেয়া কোম্পানিটির ভ্যাট-ট্যাক্স ও উৎসে করের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষের ভিজিলেন্স টিমের দেয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই অনুষ্ঠিত শুনানিতে এ দণ্ড দেয়া হয়।
একই অপরাধ আবারো
১৩০টি অনিয়মে জরিমানা আরোপের পর কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক হলফনামা দিয়ে বলে ছিলেন, ‘২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত যেসকল অনিয়ম উৎঘাটিত হয়েছে, ভবিষ্যতে অনুরূপ অপরাধের পুনরাবৃত্তি কোম্পানিতে আর সংঘটিত হবে না’।
তবে এমন অঙ্গীকার করার পর আবারো একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স।
অপরাধ না করার হলফনামা দিয়ে আবোরো অপরাধ করায় আইনের বিধান ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা কঠোর ব্যবস্থা নিবে। কিন্তু মজার বিষয় হলো- আগের বার অপরাধের শাস্তি জরিমানা করলেও এবার শুধু সতর্ক করেছে।
কর্তৃপক্ষের তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের চট্টগ্রামস্থ জুবলী রোড শাখা পরিদর্শন করে। তদন্ত দল ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেরিন ও ফায়ার সংশ্লিষ্ট নথি দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে।
তদন্তে ১টি নৌ বীমা ও ৫টি অগ্নি বীমা পলিসি বাকীতে ইস্যু করার প্রমাণ পায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কর্তৃপক্ষের এই তদন্ত দলের নেতা ছিলেন পরিচালক (উপসচিব) মো. শাহ আলম। আর জুনিয়র অফিসার মো. শামছুল আলম ও মো. সোহেল রানা ছিলেন সদস্য।
তবে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের জুবিলি রোড শাখায় বাকি ব্যবসার বিচারের জন্য ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত শুনানিতে ‘ভবিষ্যতে এ ধরণের ভুল যেন আর না করা হয় সে জন্য কোম্পানিকে কঠোরভাবে সতর্কতা অবলম্বনের বার্তা দিয়ে পত্র প্রেরণ করতে হবে’ বলে সিদ্ধান্ত নেয় আইডিআরএ।
এর আগে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিলেও বীমা কোম্পানিটির জুবলী রোড শাখা পরিদর্শন করে বাকী ব্যবসাসহ ৪টি অপরাধের প্রমাণ পায় আইডিআরএ। সে সময়ে কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ ।
এসব বিষয়ে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনেই আমরা ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা করছি। তবে বাজার পরিস্থিতির কারণে সব বিধিবিধান এখনো পুরোপুরিভাবে মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী বলেন, কর্তৃপক্ষের আরোপিত জরিমানা প্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ভ্যাট ও স্ট্যাম্পের ১৩ কোটি টাকা এখনো সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। এনবিআর বা আইডিআরএ থেকে আর কিছু না বলায় বিষয়টি একই অবস্থায় রয়েছে।
শুনানির সিদ্ধান্ত অনুসারে ফাঁকি দেয়া ভ্যাট ও স্ট্যাম্পের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও কেন তা পরিশোধ করা হয়নি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নিয়মিত যেসব ভ্যাট আসছে তা পরিশোধ করা হচ্ছে। তারা চাইলে বকেয়া ভ্যাটও পরিশোধ করতে হবে।
অর্জিত প্রকৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ পরিবর্তন করে নামমাত্র প্রিমিয়ামের রেকর্ড করে তহবিল তছরূপের সাড়ে ২৬ কোটি টাকা সমন্বয় করা হয়েছে কিনা -এমন প্রশ্নের জবাবে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এ জন্য তো জরিমানা দিচ্ছি।
জুবলী রোড শাখার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফায় বাকী ব্যবসার অভিযোগের বিষয়ে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, বিষয়টি আসলে বাকী ব্যবসা নয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ইস্যুকৃত পলিসির প্রিমিয়াম বাবদ দেয়া পে-অর্ডার যথা সময়ে সংগ্রহ করতে পারেননি। বিষয়টি আমরা আইডিআরএকে বলেছি। তারা আমাদের জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছে এবং এ জন্য কোন জরিমানাও করেনি।