অপরাধ প্রমাণের পৌনে ২ বছরেও শাস্তি হয়নি সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের
আবদুর রহমান আবির: অপরাধ প্রমাণের পৌনে দুই বছরেও শাস্তি হয়নি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের। ১০টি দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মেলায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত দল। গেলো বছরের ২৫ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করে এই সুপারিশ করা হয়।
একইসঙ্গে প্রমাণিত এসব দুর্নীতির ফলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপনে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস ‘একনাবিন’কে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করে আইডিআরএ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশের প্রেক্ষিতে গেলো বছরের ৪ এপ্রিল এই নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন’কে।
তবে এখন পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি নিরূপন করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেনি আইডিআরএ।
সংস্থাটির সদস্য (প্রশাসন অনুবিভাগ) মইনুল ইসলাম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বিষয়টি আইডিআরএ’কে তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছিল। সে অনুসারে আমরা তদন্ত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এখন পুরো বিষয়টি দেখছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আমরা এ বিষয়ে আর কিছু জানি না।
এদিকে প্রমাণিত এসব দুর্নীতির কারণে সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক কোন ব্যবস্থা না নেয়া হলেও সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে তার নিয়োগ নবায়ন করা হচ্ছে না বলে প্রতিষ্ঠানটির একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
এই প্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকালে অনুষ্ঠিত সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় সম্ভাষণ (ফেয়ারওয়েল) জানানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সূত্রটি।
আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে প্রথম দফায় ৩ বছরের জন্য তাকে সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর দ্বিতীয় দফায় তার মেয়াদ আরো ৩ বছর বৃদ্ধি করা হয়।
এ দিকে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের দুর্নীতির সুরাহা না করেই তাকে সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে রিলিজ দেয়া হলে সেটি হবে তাকে দায়মুক্তি দেয়ার সামিল। এ ছাড়াও তার এই দুর্নীতির ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার দায় বয়ে বেড়াতে হবে সাধারণ বীমা করপোরেশনকে। অন্যদিকে এটি বীমা খাতের সুশাসনের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সূত্র মতে, সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম। তবে তার পদবি বা কোন ঠিকানা উল্লেখ করেননি ওই অভিযোগপত্রে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ তিনি এই অভিযোগ দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের অক্টোবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অভিযোগটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে দুদক।
এই প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি তদন্ত করে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর ৮ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের সদস্য মইনুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আইডিআরএ। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করে কর্তৃপক্ষের তদন্ত দল।
তদন্ত প্রতিবেদনে শাহরিয়ার আহসানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ আর্থিক সংশ্লিষ্ট ৮টি অভিযোগ তদন্তে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস ‘একনাবিন’কে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে আইডিআরএ। একইসঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে এক মাস সময় বেধে দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
এসবিসি’র এমডি’র যেসব দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে তদন্ত দল:
শাহরিয়ার আহসানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত দুর্নীতিগুলো হলো- ঢাকাস্থ গুলশান-১ এ অবস্থিত এসবিসি’র দখলীয় দ্বিতল বাড়িটি টেন্ডার না করে নিজ ক্ষমতার মধ্যে বারবার আরএফকিউ এর মাধ্যমে সাড়ে ৬১ লাখ টাকা ব্যয়, যা বিধি ও ক্ষমতা বহির্ভূত; সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া বাড়িতে বসবাস করেও ৯০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে বদলি করণ;
পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের বকেয়া প্রায় ১১৮০ কোটি টাকা, পুনর্বীমার অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম এবং পুনর্বীমা বিভাগ ও পুনর্বীমা হিসাব বিভাগ একজন ডিজিএম’র মাধ্যমে পরিচালনা করে অনিয়ম-দুর্নীতির আড়াল করা; সরকারি নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করে সিলেকশন কমিটির সুপারিশ ছাড়াই গাড়ি চালক পদে নিয়োগ এবং সরকারি অনুমোদন বিহীন ও মামলা থাকা অবস্থায় চারজন লিফটম্যান নিয়োগ;
সরকারি আর্থিক নীতি উপেক্ষা করে এসবিসি’র তহবিল বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা; নিয়ম ভেঙ্গে নিজের জন্য কোটি টাকার জিপ গাড়ি ক্রয়; চুক্তি ছাড়াই ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য সংস্কার কাজে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়; এসআরও’র নির্দেশনা অমান্য করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রিম ঋণ অনুমোদন এবং আয়কর উপদেষ্টা নিয়োগের নামে বেতন ভাগ-বাটোয়ারা।
তদন্ত দলের সুপারিশ:
উল্লেখিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়ায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত দল। একইসাথে এসব দুর্নীতির ফলে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপনে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত দল।
আর্থিক সংশ্লিষ্ট যেসব দুর্নীতি তদন্ত করবে বিশেষ নিরীক্ষক:
শাহরিয়ার আহসানের বিরুদ্ধে আর্থিক সংশ্লিষ্ট ৮টি দুর্নীতির ক্ষতি নিরূপন করবে বিশেষ নিরীক্ষক। সেগুলো হলো- ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাসভবন (গুলশান-১ এ অবস্থিত এসবিসি’র দখলীয় দ্বিতল বাড়ি) পুনরায় মেরামত করার জন্য সাড়ে ৫৮ লাখ টাকার বেশি ব্যয়, সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া বাড়িতে বসবাস করেও বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; নিয়ম ভেঙ্গে নিজের ব্যবহারের জন্য কোটি টাকার জিপ গাড়ি ক্রয়;
চুক্তি ছাড়াই ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য সংস্কার কাজে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়; পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের প্রায় ১১৮০ কোটি টাকা বকেয়া রাখাসহ পুনর্বীমার অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম; এসআরও’র নির্দেশনা অমান্য করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রিম ঋণ অনুমোদন; সরকারি আর্থিক নীতি উপেক্ষা করে এসবিসি’র তহবিল বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা এবং আয়কর উপদেষ্টা নিয়োগের নামে বেতন ভাগ-বাটোয়ারা।
এ বিষয়ে জানতে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল্লাহ হারুন পাশার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি পরবর্তীতে কথা বলবেন বলে খুদে বার্তা পাঠান। তবে পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।