বিদেশে পুনর্বীমায় নতুন শর্ত, প্রিমিয়াম রেট বৃদ্ধির শঙ্কায় নন-লাইফের মুখ্য নির্বাহীরা

আবদুর রহমান আবির: দেশের নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর বিদেশে পুনর্বীমা করার ক্ষেত্রে নতুন শর্ত আরোপ করেছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই শর্তের ফলে নূন্যতম ‘বি-প্লাস’ রেটিং সম্পন্ন বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানি ছাড়া প্রিমিয়াম রেট আনতে পারবে না দেশের নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। আগামী ৬ নভেম্বর থেকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর ঘোষণা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

এদিকে নতুন শর্তের ফলে দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে প্রিমিয়াম রেট বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহীরা। তারা বলছেন, ভালো মানের বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম রেট বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এসব পুনর্বীমা কোম্পানি থেকে রেট আনতে আগের চেয়ে বেশি প্রিমিয়াম গুণতে হবে। তবে নতুন এই সিদ্ধান্ত সঠিক এবং খাতটির উন্নয়নে এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলেও মনে করেন মুখ্য নির্বাহীরা।

গত ৩ নভেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত সার্কুলার নং নন-লাইফ-৯০/২০২২ –এ বলা হয়েছে, যে সকল বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানি থেকে দেশিয় বীমা কোম্পানিগুলো রেট সংগ্রহ করে তাদের মধ্যে কিছু কিছু পুনর্বীমা কোম্পানির মান, রেটিং স্ট্যাটাস এবং আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক নয়।

এসব পুনর্বীমা কোম্পানি অত্যন্ত নিম্ন হারে (লো রেট) প্রিমিয়াম রেট উদ্ধৃত (কুঔট) করে থাকে। যার ফলে দেশিয় বীমা কোম্পানিগুলো অযাচিত এবং অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের বীমা কোম্পানিগুলো যদি এ ধরণের পুনর্বীমা কোম্পানির সাথে পুনর্বীমা করে তাহলে স্বভাবতই দাবি আদায়ের সময় বড় ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।

এই প্রেক্ষিতে পুনর্বীমা কোম্পানিগুলোর রেটিং স্ট্যাটাস মান নূন্যতম ‘বি প্লাস’ হতে হবে। একইসঙ্গে এসব রেটিং স্ট্যাটাস নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান যেমন- এ এম বেস্ট, এস এন্ড পি অথবা মুডি’স দ্বারা রেটিং মানের প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে বলেও সার্কুলারটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিয়ম অনুসারে, দেশের নন-লাইফ বীমা খাতের কোন বীমা পলিসির বীমা অংক কান্ট্রি লিমিট এর বেশি হলে সেই পলিসি বিদেশি কোম্পানিতে ফ্যাকাল্টেটিভ পুনর্বীমা করতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশিয় বীমা কোম্পানি। এক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানি থেকে আনা পুনর্বীমার রেট সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি (সিআরসি) থেকে ভেটিং বা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি (সিআরসি)’র তথ্য অনুসারে- অগ্নি বীমা পলিসির ক্ষেত্রে বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও নৌ-হাল বীমা পলিসির ক্ষেত্রে বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ৩০ কোটি টাকা এবং নৌ-কার্গো বীমার বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ১০০ কোটি টাকা।

বিদেশে পুনর্বীমা করার ক্ষেত্রে আইডিআরএ’র নতুন শর্ত আরোপের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নন-লাইফ খাতের কয়েকজন মুখ্য নির্বাহী ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, নতুন সার্কুলারের ফলে পুনর্বীমা নিয়ে একটি সংকট সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ‘বি-প্লাস’ রেটিংয়ের পুনর্বীমা কোম্পানি যেমন কম, তেমনি তাদের প্রিমিয়াম রেটও বেশি। ফলে বর্তমানে দেশের নন-লাইফ বাজারে যে রেটে পলিসি ইস্যু করা হয় সেই রেটে আর পলিসি ইস্যু করা সম্ভব নাও হতে পারে।

আবার বিদেশে পুনর্বীমা করতে না পারলে বাধ্য হয়ে এসব কোম্পানিকে দেশিয় পুনর্বীমাকারী সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে পুনর্বীমা করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশিয় পুনর্বীমাকারীর কাছ থেকে যথাসময়ে বীমা দাবির টাকা না পেলে কোম্পানিগুলোর জন্য গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধ করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই নতুন সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের আগে দেশিয় পুনর্বীমাকারীকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এসব মুখ্য নির্বাহী।

এ বিষয়ে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শফিক শামীম বলেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তটি সঠিক এবং দেশের বীমা খাতের উন্নয়নে এটি প্রয়োজন। তবে সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে অন্তত এক বছর সময় প্রয়োজন। ভালো মানের বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানি খুঁজে পেতে এই সময়ের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

শফিক শামীম বলেন, দেশের বীমা বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘বি’ রেটিংয়ের পুনর্বীমা কোম্পানি-ই যেখানে আমাদের সাথে ব্যবসা করতে খুব এটা আগ্রহ দেখায় না। সেখানে ‘বি প্লাস’ রেটিংয়ের পুনর্বীমা কোম্পানি খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য একটু বেশি কষ্টকর হবে। কারণ, বিদেশি কোম্পানিগুলোর দৃষ্টিতে আমাদের দেশে মোরাল হ্যাজার্ড বেশি। তবে আইডিআরএ’র নেয়া সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী আরো বলেন, আইডিআরএ’র নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম রেট কিছুটা বাড়াতে হবে। কারণ, বর্তমানে নন-লাইফ খাতে যে রেটে বীমা পলিসি ইস্যু করা হয়ে থাকে তা দিয়ে নতুন এই শর্ত পরিপালন করা কঠিন। এক্ষেত্রে বীমা গ্রাহকদের সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আইডিআরএ’র সার্কুলারটিকে স্বাগত জানিয়ে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালেদ মামুন বলেন, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তটি সঠিক এবং সময়োপযোগী। তিনি বলেন, নিরাপদ কোম্পানি সবারই প্রত্যাশা। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রিমিয়াম রেট কিছুটা বেড়ে যাবে। কারণ, বর্তমানে যে রেটে পলিসি ইস্যু করা হয়ে থাকে সেই রেটে ‘বি-প্লাস’ রেটিং সম্পন্ন বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানি পাওয়া সম্ভব নয়।

খালেদ মামুন বলেন, পুনর্বীমা কোম্পানির রেটিং যত বাড়বে তাদের প্রিমিয়াম রেটও তত বাড়বে। ফলে ভালো কোম্পানির কাছে পুনর্বীমা করতে গেলে আমাদেরও বেশি রেটে পলিসি ইস্যু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে সাধারণ বীমা গ্রাহকদের ওপর। তবে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হলে বীমা গ্রাহক ও কোম্পানি সবার জন্যই ভালো বলে মন্তব্য করেন রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যেমে দেশিয় পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের রেটিং মান নির্ধারণ করা হয়নি উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মুখ্য নির্বাহী বলেন, বিদেশি পুনর্বীমাকারীর ক্ষেত্রে যদি নূন্যতম রেটিং মান নির্ধারণ করে দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে দেশিয় পুনর্বীমাকারীর ক্ষেত্রেও এর বাস্তবায়ন থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, নতুন এই সার্কুলার যেন রাষ্ট্রীয় পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি না করে সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দেখা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটি (বিআইপিএস)’র সাধারণ সম্পাদক এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, আইডিআরএ’র সিদ্ধান্তটা ভালো। তবে আমার জানা মতে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা ‘বি-প্লাস’ রেটিং সম্পন্ন পুনর্বীমা কোম্পানির সংখ্যা বিশ্বে খুব কমই আছে। ফলে দেশিয় বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ভালো পুনর্বীমা কোম্পানি খুঁজে পাওয়াটাই এখন কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যাদের রেটিং কম তারাই বাংলাদেশে পুনর্বীমা করতে আসে। আর যারা ভালো কোম্পানি তারা বাংলাদেশ পুনর্বীমা করতে আসে না। তাছাড়া ভালো সিকিউরিটির পুনর্বীমা কোম্পানির কাছে পুনর্বীমা করতে গেলে প্রিমিয়াম রেটও বেশি দিতে হবে। কারণ, ভালো জিনিসের দাম যেমন সব সময়ই বেশি থাকে তেমনি ভালো সিকিউরিটির পুনর্বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম রেটও বেশি হবে -এটাই স্বাভাবিক।