সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় জাতীয় বীমা নীতি ২০২৩
আবদুর রহমান আবির: জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ অধিকতর পরিমার্জন, সংশোধন ও পরিবর্ধন করে নতুন বীমা নীতি প্রস্তুত করেছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ‘জাতীয় বীমা নীতি ২০২৩’ নামে খসড়া নীতিটি এরইমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটি এখন সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নতুন এই বীমা নীতিতে ৩৫টি কর্মপরিকল্পনা বা প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের সম্পদ ও জীবনের ঝুঁকির শতভাগ বীমার আওতায় নিয়ে আসাকে মিশন এবং জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে এই বীমা নীতির রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন বীমা নীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এসডিজি ২০৩০ এবং রূপকল্প ২০৪১ বিবেচনায় রেখে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী বীমা নীতি প্রয়োজন। বীমা নীতিকে যুগোপযোগী এবং বীমা ব্যবসাকে ডিজিটালাইজড করাসহ বীমা খাতের বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম প্রতিরোধ করে বীমা সেবাকে দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বীমার সুফল নিশ্চিত করাই নতুন বীমা নীতির লক্ষ্য।
একই সাথে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস করাই নতুন বীমা নীতির উদ্দেশ্যে।
এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক ও মুখপাত্র (উপসচিব) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় বীমা নীতি আরো যুগোপযোগী করা হয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে এটি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোন সিদ্ধান্ত আসেনি।
জাতীয় বীমা নীতি ২০২৩ সম্পর্কে বীমা মালিকদের সংগঠন বিআইএ’র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ (পাভেল) বলেন, বীমা খাতের উন্নয়নে সব দেশেই একটি জাতীয় বীমা নীতি প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় বীমা নীতি করা হয়েছিল। তবে সেটি আমরা নির্ধারিত সময়ে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের সেই বীমা নীতি কিছুটা পরিমার্জন-পরিবর্ধন করে সময়োপযোগী করা হয়েছে এবং সেটি বাস্তবায়নে নতুন একটি সময়-সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি পুনর্নিধারিত এই সময়ে আমরা জাতীয় বীমা নীতি ২০২৩ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব। অবশ্য এ জন্য সবার সহযোগিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
জাতীয় বীমা নীতিতে চিহ্নিত দেশের বীমা খাতের সমস্যা:
দেশের বীমা খাতে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে নতুন বীমা নীতিতে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে- বীমার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে জানাতে এবং আগ্রহ সৃষ্টি করতে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক প্রচার বা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব। বীমাকর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব। লঙ্ঘন হচ্ছে বীমা এজেন্ট নিয়োগের আইনগত শর্ত।
দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউটে বীমা সম্পর্কিত স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম নেই। বীমা কোম্পানিসমূহের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতীত অন্যান্য উচ্চ পদধারীদের জন্য বীমা ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ বা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি থাকার কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
এ ছাড়াও দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল ও যুগপোযোগী নয়। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধিমালার মাধ্যমে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সুস্পষ্ট কর্মপরিধির অভাব। পেশাগত বীমা শিক্ষা যেমন- ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, প্রশিক্ষণ ইত্যাদিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করায় বীমা শিল্প উন্নয়নে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা।
বীমা কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাব। জীবন বীমা কোম্পানিগুলোতে একচ্যুয়ারির অভাব। মূলধনের অপর্যাপ্ততা। বীমা কোম্পানিগুলো কর্তৃক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অভাব। উচ্চ হারে ব্যবস্থাপনা বায়।
অধিকাংশ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানাসহ যাবতীয় সম্পত্তি পরিপূর্ণ বীমা সুবিধার আওতায় না আসায় দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক জান-মাল ও সম্পদের ক্ষতিজনিত কারণে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।
বীমা কোম্পানিগুলোতে নীতি ও নৈতিকতার আলোকে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার অভাব। বীমা ডিপ্লোমা, ডিগ্রি, একচ্যুয়ারিয়াল সায়েন্সসহ অন্যান্য পেশাগত ডিগ্রি প্রদানের অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। বীমা শিল্পের জন্য প্রমিত আচরণবিধির অনুপস্থিতি।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানির মত বিপর্যয়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় বীমা শিল্পকে কাজে লাগানোর অধিকতর কার্যকর পরিকল্পনা না থাকা।
বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে জীবন, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধে সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীর জ্ঞানের অভাব। বীমার জন্য ব্যয়িত অর্থকে পরিবারের ও ব্যবসায়ের অতিরিক্ত খরচ হিসেবে বিবেচনা করা।
জাতীয় বীমা নীতি ২০২৩ এর প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয়:
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বীমা শিল্পে চলমান সংস্কার কার্যক্রম লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক করা। বীমা সংক্রান্ত প্রচলিত আইন-কানুন যুগোপযোগী করা। সকল বীমা কোম্পানির সামঞ্জস্যপূর্ণ ন্যূনতম মূলধনের পরিমাণ অর্জনের সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণ। ইলেক্ট্রনিক ডাটা ও তথ্য প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহারের মাধ্যমে বীমা খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। ঝুঁকি ও তারল্যের ভিত্তিতে কোম্পানিগুলোর বা বীমাকারীর বিনিয়োগ কর্মকৌশল পরিবীক্ষণ করা।
বীমা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক আইনসমূহ পর্যালোচনা করা। বীমাযোগ্য থাকা সাপেক্ষে বিভিন্ন নীতি, আইন, পরিকল্পনা ইত্যাদিতে বীমার সার্বজনীন আইনি বিধান রাখার বিষয় নিশ্চিত করা। প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা। সকল ক্ষুদ্রবীমা সেবার পরিসর বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। একই শ্রেণীর সকল বীমাকারীর জন্য একইরূপ সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন ও তা যুগোপযোগীকরণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা।
বীমা শিল্পে পেশাদারিত্ব সৃষ্টি ও মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিকে শক্তিশালী করা। সম্পদ ও দায়ের একচ্যুয়ারিয়াল মূল্যায়ন সম্পর্কিত রেগুলেশন পর্যালোচনা করা। গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণে অটোমেশন ব্যবস্থা জোরদার করা। পাবলিক ডিসক্লোজার নিশ্চিতের কার্যক্রম গ্রহণ করা। বীমা কোম্পানীর হিসাব মান ও আর্থিক বিবরণীসমূহের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের ব্যবস্থা করা।
দেশীয় প্রয়োজন ও আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় নুন্যতম মূলধনের পাশাপাশি সলভেন্সি মার্জিন নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা। বীমা শিল্প সংশ্লিষ্টদের আচরণ বিধি এবং প্রমিত প্র্যাকটিস নির্ধারণ করা। জীবন বীমার প্রিমিয়াম সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন প্রাপ্যতার পুনর্বীমাকারী চিহ্নিত করা। ইসলামী বীমা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শরীয়াহ ভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
ব্রোকার বা সার্ভেয়ারদের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশীয় পুনর্বীমা বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বীমা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ। বীমার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থনীতির খাতসমূহের ঝুঁকি মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় বা বিভাগের উদ্যোগে সহযোগিতা করা। শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের জন্য বীমা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।
গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে বীমা পলিসি যুগোপযোগী এবং বহুমুখীকরণে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার উৎসাহিত করা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্রুপ বীমা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। বীমা বিপণন ব্যবস্থা বহুমুখীকরণ নিশ্চিত করা। বহির্বিশ্বে দেশীয় বীমাকারীর সেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বীমা শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান এবং নারীবান্ধব প্রোডাক্ট উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা।
বৃহৎ ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। দরিদ্র শ্রেণীর জন্য কল্যাণমূলক বীমা পলিসি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান করা। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের অংশ হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা বীমা কর্মসূচী চালু করা এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইন প্রণয়ন করা।