জাতীয় সম্মাননা পেলেন একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি এবং উন্নয়ন ও বীমার সঞ্চালক সুশান্ত সিনহা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে প্রশংসনীয় অবদান রাখায় ‘তামাক নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সম্মাননা ২০২৩’ পেয়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি এবং ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র ‘উন্নয়ন ও বীমা’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সুশান্ত সিনহা। রোববার (১১ জুন) দুপুরে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সাংবাদিক (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) ক্যাটাগরিতে তামাক নিয়ন্ত্রণে গবেষক সুশান্ত সিনহার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ পত্র তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ আয়োজিত বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস ২০২৩ উদযাপনের এই অনুষ্ঠানে ৯টি ক্যাটাগরিতে সুশান্ত সিনহাসহ দেশের ১০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় সম্মাননা পাওয়ায় ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে সাংবাদিকতা ও গবেষণার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সুশান্ত সিনহার গুরুত্বপূর্ণ অবদান সংক্ষেপে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

তামাক নিয়ন্ত্রণে সুশান্ত সিনহার অবদান:

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে তামাকের কর কাঠামো নিয়ে সুশান্ত সিনহা গেল ১০ বছর ধরে নিরলসভাবে টেলিভিশনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করেছে আসছেন। সিগারেটের প্যাকেটের মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা করে জনগণের কাছ থেকে বাড়তি আদায় এবং রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে তিনি প্রথম তুলে ধরেন গণমাধ্যমে। https://www.youtube.com/watch?v=BztQKmbLCXU এতে মাসে ৬০০ কোটি এবং বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যেখানে সরকারের রাজস্ব পাওয়ার কথা ৫ হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটায় ফাঁকি দিচ্ছে দেশি বিদেশি সিগারেট কোম্পানিগুলো। তার আলোচিত সংবাদটি আমলে নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে সাথে অনুসন্ধান করে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পায়। পরবর্তীতে সুশান্ত সিনহার সংবাদ শিরোনামটির হুবুহু ‘প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা জনগণের কাছে থাকে বাড়তি নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো’ শিরোনামে বাড়তি দামে সিগারেট বন্ধে প্রতিবেদন দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে। এরই অংশ হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের প্যাকেটে ‘আইন অনুযায়ী সবোর্চ্চ খুচরা মূল্য লেখা এবং বিক্রির কোন পর্যায়েই সবোর্চ্চ খুচরা মূল্যের অধিক দাম বিক্রি করা যাইবে না বলে’ এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সিগারেটের কর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন।

তামাক নিয়ন্ত্রণজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ঠেকাতে ২০২২ সালে তামাক কোম্পানিগুলো নাম স্বাক্ষর ও নামসর্বস্ব দোকান মালিক সমিতির প্যাড ব্যবহার করে ভূয়া এক হাজারের বেশি  চিঠি দিয়েছিল । ‘আইনের সংশোধনী ঠেকাতে ভূয়া চিঠি’ https://www.youtube.com/watch?v=1aKlCYGJN4c শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে সুশান্ত সিনহা তামাক কোম্পানির জালিয়াতি ও হস্তক্ষেপের বিষয়টি নীতি নির্ধারকসহ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। জালিয়াতির বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরায় আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে সুশান্ত সিনহার গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তামাক নিয়ন্ত্রণের কর্মীরা।

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে কাজ করতো তামাক কোম্পানি সৃষ্ট মিথগুলো। বিশেষ করে তামাক কোম্পানি সবচেয়ে বেশি কর দেয়ার বিষয়টি। এই মিথ ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সুশান্ত সিনহা। ২০১৯ সাল থেকে বিএনটিটিপি, বিইআর, তামাক বিরোধী জোট, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টসহ বিভিন্ন সংগঠনে প্রশিক্ষণসমূহে রাখা প্রেজেন্টশন ও বক্তব্যে  থেকে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন যে, কর দেয় জনগণ, ক্রেডিট নেয় কোম্পানি। অথ্যাৎ কোম্পানি যে রাজস্ব দেয়ার কথা বলছে তার মধ্যে জনগণ তথা সিগারেটের ভোক্তারা ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জসহ ৯৬ শতাংশ টাকা দিচ্ছে সিগারেটের ভোক্তা তথা জনগণ। যে টাকার পুরোটায় সিগারেটের দামের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে। জনগণের দেয়া ভ্যাটের টাকায় কোম্পানি নিজের কর হিসাবে ক্রেডিট নিচ্ছে-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও পুরস্কৃত করে আসছে। এতে নীতিনির্ধারকদের অনেক বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে যে সিগারেট কোম্পানি সবচেয়ে বেশি কর দেয়। আসলে এটা একটা মিথ, কারণ সিগারেট কোম্পানির মোট রাজস্বের মধ্যে তার আয় থেকে আয়কর দেয় মাত্র ৪ শতাংশ। বছরের পর বছর ৪ শতাংশ রাজস্ব দিয়ে শতভাগ রাজস্ব দেয়ার ক্রেডিট দেয়ার মিথ ভেঙ্গে দেয়ায় এনবিআর, নীতি নির্ধারক এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীসহ সবার সামনে পরিস্কার ভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ আবদান রেখেছেন তিনি। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় তামাক নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখায় ২০১৭ সালে প্রজ্ঞা তামাক নিয়ন্ত্রণ পুরস্কার পেয়েছেন সুশান্ত সিনহা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা কর্মে সুশান্ত সিনহার ভূমিকা:

সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তামাক কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি, বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রমসহ বেশি কিছু গবেষণা করেছেন। এরমধ্যে ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিড়ি কারখানা ও শ্রমিক সংখ্যা নিয়ে দেশব্যাপী গবেষণা করেন যৌথভাবে। আর্ন্তজাতিক সংস্থা সিটিএফকের অর্থায়নে সুশান্ত সিনহা ও আমিন আল রশীদের গবেষণায় উঠে আসে সারা দেশে সচল বিড়ি কারখানার সংখ্যা ১১৭ টি এবং কার্ডধারী শ্রমিকের সংখ্যা ৬৫ হাজার, সহযোগী শ্রমিকসহ যা ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি নয়। এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিড়ি কারখানা মালিকদের লাখ লাখ বিড়ি শ্রমিকের প্রচার প্রাপাগান্ডা মুখথুবড়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্সটিটিউট অব গ্লোবার  টোব্যাকো কন্ট্রোল(আইজিটিসি), জন হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর  কমিউনিকেশন(বিসিসিপি) স্কলারশিপ পেয়ে বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রম পরিস্থিতি এবং করণীয় শীর্ষক গবেষণা করেন। গবেষণাটি আন্তর্জাতিক একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

২০২১ সালে বৈশ্বিক সংস্থা  ভাইটাল স্ট্র্যাটেজি ও দ্যা ইউনিয়নের যৌথ সংস্থ STOP এর অর্থায়নে ব্রিটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর ১০ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেন। বিশেষ করে গ্রুপ কোম্পানি বিএটিতে বিভিন্ন খাতে আর্থিক লেনদেন, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের সচিবসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদ দিয়ে সরকারি দপ্তরে হস্তক্ষেপ এবং  বছরে মাত্র ৬ কোটি টাকার নামমাত্র টাকার সিএসআর করে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার প্রচরণার বিষয়গুলো তার এ গবেষণার মাধ্যমে উঠে আসে। সিগারেট কোম্পানির আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়ে দেশে এ ধরনের গবেষণা কর্ম প্রথম। এ গবেষণা প্রকাশের কিছু দিনের মাথায় বিএটিবিতে সিএসআর তহবিলের ২০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ ৩ কর্মকর্তাকে বহিস্কার করে বিএটিবি। যদিও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির এত বড় আর্থিক প্রতিবেদনের সাথে জড়িত অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা এবং টাকা উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্চ কমিশন, এনবিআরসহ সরকারি সংস্থাগুলোর।

আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে সুশান্ত সিনহার গবেষণা উপস্থাপন

শুধু দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে গবেষণা উপস্থাপন নয়, বিশ্ব দরবারে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশান্ত সিনহার অংশগ্রহণ বেশ উল্লেখ্যযোগ্য। তিনি ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণা উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্কলারশিপ পাওয়ার মাধ্যমে।

প্রথমবারের মতো গবেষক হিসেবে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল শহরে অনুষ্ঠিত তামাক ও যক্ষা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আয়োজন দ্যা ইউনিয়ন গ্লোবাল কনফারেন্স অন লাং হেলথ এর ৪৭তম আসরে স্বশরীরে উপস্থাপন করেন ১০ মিনিটের বক্তব্যে। পরবর্তীতে তার জাতীয় দৈনিকে তামাক কর সংক্রান্ত সংবাদে তামাক কোম্পানির প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণাটি ২০১৮ সালে সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন টোব্যাকো অর হেলথ এর ১৭তম আসরে উপস্থাপন করেন সুশান্ত সিনহা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অনুষ্ঠিত এশিয়া প্যাসিফিক কনফারেন্স অন ট্যোবাকো অর হেলথ এর ১২তম আসরে তুলে ধরেন বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রমিকদের নামমাত্র আয়ের বিপরীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি সংক্রান্ত গবেষণাটি। ২০২০ সালে করোনার কারণে স্পেনে অনুষ্ঠিতব্য দ্যা ইউনিয়ন গ্লোবাল কনফারেন্স অন লাং হেলথ এর ৫১তম আসরটি ভার্চুয়ালি আয়োজন করা হয়, যেখানে সুশান্ত সিনহা তার তামাক নিয়ন্ত্রণের আরও একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন। 

তামাক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে ভাইট্যাল স্ট্র্যাটেজির আয়োজনে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে অনুষ্ঠিত পাবলিক হেলথ জার্নালিজম বিষয়ক ৩ দিনব্যাপী ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজিএন) আয়োজিত ৪ দিনব্যাপী এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়াও তিনি সাংবাদিক হিসেবে রাশিয়া, ভারত, ফিলিপাইন, বতসোয়ানা, স্কটল্যান্ড, তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন। আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল প্রেস ফাউন্ডেশন (এনপিএফ) এর উদ্যোগে সিঙ্গাপুরে হতে যাওয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড বিষয়ক অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণে স্কলারশীপ পেয়ে মনোনীত হয়েছেন। আগামী জুলাই মাসে অনুষ্ঠিতব্য ৪ দিনের এই প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন ১৩ দেশের ২৫ জন অর্থনৈতিক সাংবাদিক।