তিন মাসে ঝরে পড়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার বীমা গ্রাহক
আবদুর রহমান আবির: ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ৩৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৬২৩ গ্রাহক ঝরে পড়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৮১৫ গ্রাহক ঝরে পড়ে।
লাইফ বীমা খাতের গ্রাহক গ্রাহক ঝরে পড়ার এই হিসাব প্রকাশ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । গত ১২ ও ১৩ জুন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে ল্যাপস বা তামাদি পলিসির অনিরীক্ষিত এই হিসাব প্রকাশ করা হয়।
এই গ্রাহক ঝরে পড়া তথা তামাদি পলিসির সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে বছরের পর বছর তাগিদ দিয়ে আসছে খাতটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইসঙ্গে পলিসি তামাদি ঠেকাতে জারি করা হচ্ছে নতুন নতুন নির্দেশনা।
বীমা কোম্পানিগুলো বলছে- দ্বিতীয় বর্ষ থেকে কমিশন হার কম হওয়ায় গ্রাহকের নিকট এজেন্টদের না যাওয়া, গ্রাহকের নিকট ভুল তথ্য প্রদান, প্রিমিয়াম প্রদানে গ্রাহকের অনিহা, এজেন্টদের যোগ্যতার অভাব ও কোম্পানি পরিবর্তন, বীমার সুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং গ্রাহকের আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে বীমা পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে সর্বোচ্চ পলিসি তামাদি হয়েছে সোনালী লাইফের, ৬৭ হাজার ৫৫৫টি। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ডেল্টা লাইফ, কোম্পানিটির ৫৭ হাজার ৯৮১টি বীমা পলিসি তামাদি হয়েছে। এছাড়াও ন্যাশনাল লাইফের ৩১ হাজার ৬৬৭টি পলিসি তামাদি হয়েছে এ বছরের শুরুতে।
এর আগে ২০২৩ সালেও সর্বোচ্চ পলিসি তামাদি হয় সোনালী লাইফের, ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫২২টি। গেলো বছর ডেল্টা লাইফের ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫৯টি পলিসি তামাদি হয়। এ ছাড়াও পপুলার লাইফের ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭১২টি এবং ন্যাশনাল লাইফের ১ লাখ ৫১ হাজার ৪০৫টি পলিসি তামাদি হয় ২০২৩ সালে।
পলিসি তামাদি কী
সাধারণত বীমা গ্রাহক তার পলিসির অনুকুলে প্রিমিয়ামের কিস্তি প্রদানের নির্দিষ্ট তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পরও গ্রেস পিরিয়ড বা অনুগ্রহকাল হিসেবে ৩০ দিন অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকেন। এই অনুগ্রহকালের মধ্যে যদি বীমা গ্রাহকের মৃত্যু হয়, তাহলেও বীমাটি কার্যকর বলে গণ্য হবে এবং পলিসির নমিনি বা ওয়ারিশরা বীমার প্রদেয় সুবিধা প্রাপ্য হবেন।
তবে অনুগ্রহকালের মধ্যে প্রিমিয়ামের অর্থ জমা দেয়া না হলে ‘বিচ্যুতি’ ঘটেছে বলে বিবেচিত হবে। দু’বছর নিয়মিত প্রিমিয়াম দেয়ার পূর্বে অনুরূপ ‘বিচ্যুতি’ ঘটলে সংশ্লিষ্ট তারিখ হতে বীমা পলিসিটি অচল ও তামাদি হয়েছে বলে গণ্য হবে। পলিসি তামাদি অবস্থায় গ্রাহকের মৃত্যু হলে পলিসির নমিনি বা ওয়ারিশরা বীমার প্রদেয় সুবিধা পাবেন না।
বীমা পলিসি কেন তামাদি হয়
বীমা কোম্পানিগুলো বলছে- নিড বেজড সেল তথা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বীমা পলিসি বিক্রি না করা, এজেন্ট কর্তৃক বীমা গ্রাহককে অবাস্তব প্রতিশ্রুতি বা ভুল তথ্য প্রদান, বীমা চালু রাখার সুফল সম্পর্কে গ্রাহকের অজ্ঞতা, এজেন্টদের যোগ্যতার অভাব ও বীমা কোম্পানি পরিবর্তন এবং গ্রাহকের আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে বীমা পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে।
কতিপয় কোম্পানি বীমা দাবি পরিশোধ না করে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি, প্রিমিয়ামের কিস্তি প্রদানে গ্রাহকের অনিহা, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে কমিশন হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকের নিকট এজেন্টদের না যাওয়া, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং প্রবাসী গ্রাহকদের প্রিমিয়াম যথাসময়ে জমা না করার কারণে পলিসি তামাদি হচ্ছে বলেও দাবি বীমা কোম্পনিগুলোর।
এ ছাড়াও প্রিমিয়াম জমার পদ্ধতি যদি সহজ না হলেও পলিসি তামাদি হতে পারে। আবার কমিশন অ্যাডজাস্টমেন্ট করলে মিস সেলিং এর সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে প্রকৃত এজেন্ট তৈরি হয় না এবং পলিসি তামাদি হয়। এজেন্টের মধ্যে নৈতিকতা ও সততার জ্ঞান না থাকলে বা এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ না দেয়া হলে তার দ্বারা বিক্রিত পলিসি তামাদি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তামাদি পলিসির সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র পাঠানো চিঠির জবাবে এমন তথ্য দিয়েছে বেসরকারি খাতের লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো।
পলিসি তামাদি হলে গ্রাহকের কী ক্ষতি
পলিসি তামাদি হলে বীমা গ্রাহক আর্থিক ক্ষতির সম্মখীন হয়। কেননা, পলিসি তামাদি হলে আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে গ্রাহকদের জমাকৃত টাকাও ফেরত দেয়া যায় না। আবার বিশেষ ক্ষেত্রে জমাকৃত প্রিমিয়ামের আংশিক ফেরত দেয়া গেলেও তা পরিমাণে অত্যন্ত কম।
এ ছাড়াও পলিসি তামাদি হলে বীমা গ্রাহকের জীবন বীমাবৃত থাকে না। ফলে পলিসি তামাদি অবস্থায় বীমা গ্রাহকের অকাল মৃত্যু ঘটলে তার নমিনী বীমার কোন সুবিধা পায় না। ফলে বীমা গ্রাহকের নমিনী তথা পরিবার এক অনাগত, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়। একইসঙ্গে এটা বীমা শিল্পের প্রতি গ্রাহকদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরী করে।
পলিসি তামাদি কমাতে আইডিআরএ’র উদ্যোগ:
দেশের বীমা শিল্পে তামাদি পলিসির সংখ্যা কমিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কর্তৃপক্ষের এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে-
লাইফ বীমা কোম্পানির ১ম বর্ষ ও ডেফার্ড প্রিমিয়ামের ওপর প্রদেয় কমিশনের ১০ শতাংশ ২য় বর্ষের নবায়ন প্রিমিয়াম সংগৃহীত হওয়ার পর প্রদেয় নবায়ন কমিশনের সাথে এজেন্ট এবং সকল স্তরের উন্নয়ন কর্মকর্তাগণকে পরিশোধ করতে হবে।
বিলম্বিত কমিশনের ওপর পূর্ববর্তী বছরের বিনিয়োগ আয়ের হার অথবা বাৎসরিক ৩ শতাংশ সরল সুদ এই দু’টির মধ্যে যেটি কম সে হারে মুনাফা প্রদান করে বিলম্বিত কমিশন বিল তৈরী করতে হবে।
কমিশনসহ অন্য যেকোন রকম ব্যয় যেমন- বোনাস, যাতায়াত, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি সংগৃহীত প্রিমিয়ামের সাথে সমন্বয় করা যাবে না। এজেন্ট এবং সকল উন্নয়ন কর্মকর্তাকে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংসহ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে কমিশন পরিশোধ করতে হবে।
এ ছাড়াও লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোতে বিগত ৫ বছরের কম সময় ধরে যে সকল পলিসি তামাদি হয়ে আছে সেগুলোর কোন বিলম্ব ফি ছাড়াই পুনর্বহালের সুযোগ প্রদানের জন্য গত ৭ জুলাই, ২০২০ বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন কর্তৃক ‘মুজিব বর্ষে বীমা কোম্পানির উপহার’ শীর্ষক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।
পলিসি তামাদির বিষয়ে যা বলছেন বীমার মুখ্য নির্বাহীরা
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ও জেনিথ ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী এস এম নুরুজ্জামান বলেন, পলিসি তামাদি লাইফ বীমা খাতের জন্য ক্যান্সার সরূপ। পলিসি তামাদির কারণে গ্রাহক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি বীমা কোম্পানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তামাদি পলিসির গ্রাহক অন্যদের মাঝে নেতিবাচক ইমেজ তৈরিতেও সহায়তা করে।
পলিসি তামাদি রোধের বিষয়ে এস এম নুরুজ্জামান বলেন, গ্রাহকের সাথে কোম্পানির নিয়মিত যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন অকেশনে গ্রাহককে উইশ করতে হবে। কোম্পানির বীমা দাবি পরিশোধের তথ্য নিয়মিত গ্রাহকদের জানানো বা প্রচার করতে হবে। গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে পলিসি কাস্টমাইজ করে সেটা চালু রাখতে হবে। প্রিমিয়াম জমা সহজ করতে ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মধ্যেমে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে হবে।
তামাদি পলিসির কারণ ও প্রতিকারের বিষয়ে বেঙ্গল ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী এম এম মনিরুল আলম বলেন, বীমা খাতের গুড উইলের ক্ষেত্রে তামাদি পলিসি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নানা কারণেই পলিসি তামাদি হতে পারে। আমাদের পলিসিগুলো যেহেতু এজেন্টের মাধ্যমে পলিসি বিক্রি হয়। তাই এজেন্টরা গ্রাহককে পলিসি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিয়ে বিক্রি করছে কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি বলেন, পলিসি তামাদি রোধে কল সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে গ্রাহকের সাথে কোম্পানির সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ভালো গ্রাহকসেবা দেয়া সম্ভব হয়। গ্রাহকের প্রয়োজন অনুযায়ী পলিসি সেল করতে হবে। মিস সেলিং বন্ধ করতে হবে। কোনভাবেই কমিশন অ্যাডজাস্ট করা যাবে না।
এম এম মনিরুল আলম বলেন, গ্রাহকের প্রয়োজন অনুযায়ী তথা নিড বেজড সেলের বিষয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট বীমা পলিসির সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে গ্রাহককে ভালোভাবে জানাতে হবে। অনলাইনে প্রিমিয়াম জমা দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ক্যাম্পেইন বা বিশেষ সুবিধা দিয়ে তামাদি পলিসি পুনরায় চালু করতে গ্রাহকদের আগ্রহী করতে হবে।
এ ছাড়াও পলিসি আন্ডাররাইটিংয়ের সময় গ্রাহকের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। গ্রাহক বীমার সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জেনে-বুঝে গ্রাহক পলিসি করছে কিনা সেটা জানতে হবে এবং তার আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে পলিসি ইস্যু করতে হবে। তাহলে পলিসি তামাদি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।