কুমিল্লার অর্থ আত্মসাৎ মামলা: আপোষে বসছে রূপালী লাইফ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ৩ মূখ্য নির্বাহী কারাগারে প্রেরণের মামলায় গ্রাহকের টাকা পরিশোধে আপোষে বসছে রুপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। আগামী ১৩ মার্চ কুমিল্লায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে উভয় পক্ষের আইনজীবী। তবে বাদি পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, আদালত আপোষের শর্তে জামিন দিলেও তা নিয়েই নানা টালবাহনা করছে কোম্পানিটি।

উল্লেখ্য, গত বছর ১৯ ডিসেম্বর কুমিল্লায় দায়ের হওয়া এক অর্থ আত্মসাৎ মামলায় হাজির হলে রূপালী লাইফের সাবেক ও বর্তমান ২ মূখ্য নির্বাহি কর্মকর্তা এবং একজন ডিএমডি (বর্তমানে যমুনা লাইফের মূখ্য নির্বাহী)'সহ ৫ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। পরবর্তীতে ২০ ডিসেম্বর আপোষের শর্তে তাদেরকে ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন জামিন দেন কুমিল্লার অবকাশকালীন জেলা ও দায়রা জজ।

কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা করেন কোম্পানিটির রূপালী সঞ্চয় বীমা প্রকল্পের সাবেক পিআই (উন্নয়ন) ছারোয়ার আলম। । মামলা নম্বর ৫৭২/১৩।

মামলার বাদী সূত্রে জানা গেছে, জামিনে বের হয়ে আসার পর নানা তাল বাহানা শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। আপোষের জন্য বাদীকেই প্রধান কার্যালয়ে ডেকে পাঠিয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু সে চিঠি পায়নি বাদি। পরে প্রথম চিঠির বরাত দিয়ে আবারও চিঠি দেয় কোম্পানি।

মূখ্য নির্বাহি কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে আদালতের বাইরে আপোষ-মীমাংসা করার আদেশ দিয়েছেন উল্লেখ করে ৭ দিনের মধ্যে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে বাদিকে উপস্থিত হতে বলা হয়। এ চিঠি পাঠানো হয় গত ২৬ জানুয়ারি। এই চিঠিতেই উল্লেখ করা হয় গত ১০ জানুয়ারি অপর এক চিঠিতে বাদিকে দাবির সমর্থনে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ ৭ দিনের মধ্যে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছিল।

এ চিঠির কড়া জবাব দিয়ে চিঠি দেন বাদীর আইনজীবী। তিনি বাদীকে আসামীর কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো এবং আদালতের আদেশের ভুল উপস্থাপনের প্রতিবাদ জানান। জামিন নিতে আসামীরা বাদীর সঙ্গে আপোষ করার প্রস্তাব দিলে আদালত এই শর্তে তাদের জামিন দিয়েছেন, জানান তিনি।

মামলার ঘটনাস্থল কুমিল্লার বাইরে আপোষ নিষ্পত্তিতে বসতে অসম্মতি জানান বাদীর আইনজীবী।

বাদীর আইনজীবী শক্ত অবস্থান নেয়ায় অন্তবর্তীকালীন জামিন স্থায়ী করা নিয়ে আশঙ্কায় পড়েন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে মামলার হাজিরার তারিখ এগিয়ে আসে। এতে টনক নড়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের। তারা বাদীর আইনজীবীর শর্তেই আপোষ নিষ্পত্তিতে বসতে সম্মতি জানিয়ে চিঠি পাঠায়। এরপর ১৩ মার্চ আপোষ নিষ্পত্তিতে বসার তারিখ ঠিক করে উভয় পক্ষের আইনজীবী।

শেষ মূহুর্তে আপোষে বসতে সম্মত হ্ওয়ায় এটাকে চাল হিসেবে দেখছেন বাদী।

এ বিষয়ে বাদী বলেন, তারা আমাকে একটি চিঠি না পাঠিয়ে গোপন করেছে। আদালতের আদেশ ভুলভাবে তুলে ধরেছে। আমাকে তাদের অফিসে ডেকেছে। এতোদিন তালবাহানা করে মামলার তারিখের আগের দিন আপোষে বসছে। বুঝতে পারছি না কতটুকু কী হবে। গ্রাহকের টাকা পাওয়ার বিষয়ে আশঙ্কায় আছি।  

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ছরোয়ার আলম ২০০৭ সালে রূপালী লাইফের সঞ্চয় বীমা প্রকল্পে ডেপুটি ডিরেক্টর পদে কুমিল্লার বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগদান করেন। এসময় তিনি রূপালী লাইফে ২০০০ গ্রাহককে পলিসি করান।

২০১২ সালে বীমাগ্রাহক রনি বাবুর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সুমি বেগম মৃত্যু দাবি আদায়ে প্রধান কার্যালয়ে যায়্। এ সময় দেখা যায়, ছারোয়ার গ্রাহকদের টাকা কোম্পানিতে জমা করলেও এন্ট্রি দেয়া হয়নি প্রধানকার্যালয়ের কম্পিউটারের ডাটাবেজে। গ্রাহকদের টাকা জমা করতে ছারোয়ার বারবার প্রধান কার্যালয়ে ধরণা দিতে থাকে। টাকা জমা করাতো দুরের কথা এক পর্যায়ে প্রধান কার্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয় ছারোয়ারকে।

অন্যদিকে গ্রাহকদের জানিয়ে দেয়া হয় ডাটাবেজে কোনো টাকা জমার এন্ট্রি নেই। প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তারা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন ছারোয়ারের দিকে। এতে গ্রাহকরা টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ এনে ছারোয়ারে বিরুদ্ধে জিডি করেন। নথিপত্র যাচাই করে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ছারোয়ারকে পরামর্শদেন আইনের আশ্রয় নিতে।

এরপর ২০১৩ সালের ১১ জুন ছারোয়ার আদালতে মামলা করেন। অর্থ আত্মসাতের এ মামলার প্রধান আসামী রূপালী লাইফের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর মোহাম্মদ ভূঁইয়া (বর্তমানে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যূরেন্সের মূখ্য নির্বাহী), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল (বর্তমানে যমুনা লাইফের মূখ্য নির্বাহী), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন ও সংস্থাপন) গোলাম কিবরিয়া (বর্তমানে রুপালী লাইফের মূখ্য নির্বাহী), সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা (অর্থ ও হিসাব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও প্রদীপ চন্দ্র সূত্রধর।

আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের জমা করা প্রিমিয়াম, বেতন-ভাতা, কমিশন, কার্যালয়ের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, টিএডিএ বিল ও দাফতরিক খরচ বাবদ ১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন ছারোয়ার।

আদালতের নির্দেশে প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আইয়ুব আলী। পরে আইয়ুব আলী বদলি হয়ে গেলে পরবর্তীতে মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক মো. সামসুজ্জামান। সামসুজ্জামান তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন ২০১৫ সালের ২২ জুন। অর্থাৎ মামলা করার ২ বছর পর। এ প্রতিবেদনে আসামীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বা যায়নি এ ধরনের কোনো বক্তব্য আনা হয় না।

এতে ছারোয়ার ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দাখিল করেন। আদালত নারাজির আবেদন মঞ্জুর করে গত ৬ অক্টোবর ২০১৫ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন কে (পিবিআই) দায়িত্বদেন। পিবিআই পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মো. মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়াকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।

পিবিআই এক বছর তদন্ত করে গত ৪ অক্টোবর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৬ অক্টোবর শুনানী হয়। প্রতিবেদনটিতে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। ৯ তারিখে আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে ২২ নভেম্বর ৪ সপ্তাহের অন্তবর্তীকালিন জামিন নেন। ১৯ ডিসেম্বর কুমিল্লার আদালতে হাজির হলে আমলী আদালত ৩ মূখ্য নির্বাহীসহ ৫ বীমা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

ছারোয়ার বলেন, আমি ন্যয় বিচার চাই। গ্রাহকের টাকা কোনোভাবেই যেন কেউ আত্মসাৎ করতে না পারে, সে বিষয়ে সকলেরই আরো সচেতন হতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে রূপারী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. গোলাম কিবরিয়ার মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।