এবার বীমা গ্রাহক জুট টেক্সটাইল মিলের ভয়াবহ জালিয়াতি

মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার বিল-ভাউচার জালিয়াতি, দোকানীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্য গোপন ও মিথ্যা অভিযোগে দ্বিতীয় সার্ভেয়ার নিয়োগ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে বীমা দাবি। বীমা গ্রহীতা ও দ্বিতীয় জরিপকারীদের যোগসাজসে কারসাজি করে রাতারাতি ১২ কোটি টাকার বীমা দাবি হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।

প্রথম ও দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনের বীমা দাবির অংক দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। অথচ বিল-ভাউচার যাচাই-বাছাই না করে রহস্যজনকভাবে ২৪ কোটি টাকা বীমা দাবি ৭ দিনের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । এমনকি এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমলে না নিয়েই একতরফা রায় দিয়েছে আইডিআরএ।

এমন অসংখ্য জালিয়াতির অভিযোগ ভিন্ন ভিন্ন বীমা দাবির ক্ষেত্রের নয়, একটি মাত্র বীমা দাবি হাতিয়ে নিতেই এমন প্রতারণা করেছে খুলনার জুট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। ইন্সুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে চাঞ্চল্যকর এসব জালিয়াতির। বীমা দাবির অংক বাড়ানোর কারসাজিতে দ্বিতীয় জরিপকারীদের যোগসাজস, বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্তসহ অনুসন্ধানের বিস্তারিত তথ্য ইন্সুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।

আজ থাকছে প্রথম পর্ব:

খুলনার দিঘলিয়ায় অবস্থিত রফতানিমুখী জুট টেক্সটাইল মিলের ১ নং শেড আগুনে পুড়ে যায় ২০১৬ সালের ৪ মে সকালে। যার সম্পদ বীমা করে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, পলিসি নং সিআইএল/কেএইচএল/আইএআর/পি০০০১/০৩/২০১৬। অগ্নিকাণ্ডের পর ৯ ও ১৫ মে ২০১৬ তারিখে বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনকে প্রথম জরিপকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। 

কাগজপত্র ও কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রথম যৌথ বীমা জরিপকারী কর্তৃক নিরুপতি ক্ষতির অংক ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬১৪ টাকা। কিন্তু প্রথম জরিপকারীরা সরোজমিনে পরিদর্শন করেনি উল্লেখ করে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের আবেদন জানায় বীমা গ্রহীতা জুট টেক্সাটাইল মিলস। অগ্নিকাণ্ডের ১৯ মাস পর দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী হিসেবে নিয়োগ পায় ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশন।

দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী কর্তৃক নিরুপতি ক্ষতির অংক ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা উল্লেখ করে। এতে প্রথম যৌথ জরিপকারীর চেয়ে টাকার অংক বেড়ে যায় ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জুট মিল কর্তৃপক্ষের দেয়া কারখানা সংস্কারের ৯৬টি বিল ভাউচারের ভিত্তিতে টাকার অংক প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানায় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। পরে দেয়া সমুদয় বিল ভাউচার সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করে দেখার ‘সত্যতা নিশ্চিত’ করার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রহস্যজনক সেই ৯৬টি বিল ভাউচার নিয়ে ঢাকা ও খুলনায় অনুসন্ধানে নামে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।

অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে কোটি কোটি টাকার বিল!

জুট টেক্সটাইল মিলস কর্তৃপক্ষের দেয়া এবং দ্বিতীয় জরিপকারীদের প্রত্যায়ন করা ৯৬টির মধ্যে দু’টি বিল দেখানো হয়েছে চিন্ময় এন্টারপ্রাইজ নামে; ঠিকানা ৩৯২ নিউ ইস্কাটন রোড, মগবাজার, ঢাকা-১০০০। চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের নামে ১৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে ৮২ লাখ ৬৬ হাজার ৪’শ টাকার এবং ২৭ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে ১ কোটি ৮১ লাখ ৩২ হাজার টাকার বিল দেখানো হয়েছে।

চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের বিলে ব্যবহৃত ৩৯২ নিউ ইস্কাটন রোডের ঠিকানায় গিয়ে জানা গেল সেটি একটি ঔষধ কোম্পানির মালিকের অফিস ও বাসা। দু’ এক বছর নয়, গেল ৪০ বছর ধরে এখানে ঔষধ কোম্পানির রয়েছে বলে জানান গেটের বৃয়োবৃদ্ধ দারোয়ান। কেউ জালিয়াতি করে ঠিকানা ব্যবহার করেছে বলে জানান তিনি।  

অস্তিত্বহীন সেই প্রতিষ্ঠানের নামে দুই কোটি ৬৪ লাখ টাকার বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে। বীমা গ্রহীতার ভূয়া এসব বিল সঠিক এবং সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা যাচাই করা হয়েছে বলে লিখিতভাবে জানায় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। জুট টেক্সটাইল মিলস কর্তৃপক্ষ ও দ্বিতীয় জরিপকারী যোগাসাজসে এসব ভূয়া বিল ভাউচার  তৈরী করে ২৪ কোটি টাকা বীমা দাবি হাতিয়ে নিতে প্রতারণা করেছে বলে মনে করেন বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা।

বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের নামে আড়াই কোটি টাকার বিল!

ঢাকার নবাবপুর রোডের শফিক এন্টারপ্রাইজের নামে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের ৮টি বিল ভাউচারে দেখানো হয়, মোট ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বিল। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৯২ নবাবপুর রোডের রাজধানীর ওয়াইজ মেশিনারি মার্কেটে গিয়ে পাওয়া যায়নি শফিক এন্টারপ্রাইজের অস্তিত্ব।

মার্কেটের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে জানান, ‘শফিক এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী ওয়াসিম উদ্দিনের মৃত্যুর পর ২০১৫ সালেই বন্ধ হয়ে গেছে শফিক এন্টারপ্রাইজ। তাই তাদের নামে ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।’

২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওয়াসিম উদ্দিন মারা যান বলে জানান তার বড় ভাই নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কোথাও কোনো মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। ২০১৬  ও ২০১৭ সালে শফিক এন্টারপ্রাইজের নামে দেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃক আড়াই কোটি টাকার সবগুলো বিল ভাউচার তৈরী করা বলেও জানান তিনি। ’

প্রতারণার গল্পটা এখানেই শেষ নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানার যন্ত্রপাতি মেরামতসহ সংস্কারের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটেশন সংগ্রহ করে জুট টেক্সটাইল মিল। যেখানে বন্ধ হয়ে যাওয়া শফিক এন্টারপ্রাইজের নামে ১৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার কোটেশন দেখানো হয়েছে। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিভাবে এত টাকার কাজের কোটেশন দেয়ায় যা তা নিয়ে বিস্মিত মৃত ওয়াসিম উদ্দিনের বড় ভাই।  ভাউচার ও কোটেশনের দেয়া স্বাক্ষর জাল করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

মজার ব্যাপার প্রতিটি বিল দোকানে গিয়ে যাচাই করে মালিক পক্ষের স্বাক্ষর নেয়ার উল্লেখ আছে ২য় দফা জরিপকারীর প্রতিবেদনে। শফিক এন্টারপ্রাইজের বিলগুলো চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ‘উল্লেখিত মালামাল জুট মিলের কাছে বিক্রি করেছি ’মর্মে দোকানীর স্বাক্ষর ও সীল দেখানো হয়েছে । যদিও বিল ভাউচার ও কোটেশনপত্রে ব্যবহৃত হয়েছে পৃথক পৃথক সীল।

শুধু তাই নয়, নবাবপুর রোডের ওই মার্কেটের আরেক দোকান হাজী এন্টারপ্রাইজের বিলগুলো একই তারিখে সত্যতা যাচাই এর স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায় কোনো জরিপকারীই স্বাক্ষর নিতে তাদের দোকানে আসেনি।

বিল দেয়ার আগেই টাকা পরিশোধ !

রহস্যজনক ৯৬ টি বিলের বেশ কিছু দেখানো হয়েছে খুলনার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এরমধ্যে খুলনার দিপু ইঞ্জিনিয়ারিং নামে লেদ কারখানার নামে ১৫ লাখ টাকার বিল দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ানি। অবিশ্বাস্যভাবে জুট টেক্সটাইল মিলস বিল পরিশোধ দেখিয়েছে ৭ দিন আগে অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি।

একইভাবে খুলনার এ আর ফাংশন ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার  বিল ইস্যু করে ২২ ডিসেম্বর ২০১৬। এখানেও মিল কর্তৃপক্ষের টাকা পরিশোধ সীল ও স্বাক্ষর রয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬। শুধু বীমাখাত নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিল দেয়ার আগে টাকা পরিশোধের নজিরবিহীন বলে মনে করে বীমাখাত বিশ্লেষকরা।

দোকানের নাম ও সীলে নেই মিল!

খুলনার ৮ পুরাতন যশোর রোডের খুরশীদ ইলেকট্রিক হাউজের নামে ১২ বিলে ৬২ লাখ টাকার কেনাকাটা দেখানো হয়। অথচ দোকান মালিক জানান, জুট টেক্সটাইল মিলস’র ভাউচারে ব্যবহৃত সিল ও স্বাক্ষর কোনোটাই তাদের নয়। আর তাদের কাছে কখনই কোনো জরিপকারী সত্যতা যাচাই এ আসেনি বলে জানান দোকান মালিক মঈনু্দ্দিন আহমেদ। জুট টেক্সটাইল মিলস’র ভাউচারগুলো যে তাদের নয় এই সত্যতা যাচাইয়ে খুরশিদ ইলেকট্রনিক্স হাউজের সঠিক সিল স্বাক্ষরের ভাউচার আমাদের হাতে তুলে দেন মঈনুদ্দিন আহমেদ। 

একই চিত্র পাওয়া গেছে সাগর ইঞ্জিনিয়ারিংসহ আরও কয়েকটি দোকানের বিল ভাউচারে।

এ আর ফাংশন নামের দোকানটি আমরা খুঁজে পাই নদীর ওপারে দিঘলিয়ার কলেজ রোডে। ছোট্ট একটি দোকান। এ দোকানের নামেই ৩৬ লাখ টাকা বিল দেয়া হয়েছে। একইভাবে খুলনার আরেক প্রতিষ্ঠান ঢাকা মিল ও মেশিনারাজি স্টোর নামের ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার ৭ টি বিল দেখিয়েছে দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনে। (চলবে...)