দেশে মাথাপিছু প্রিমিয়াম আয় কমেছে ১ ডলার
আবদুর রহমান আবির: ২০২০ সালে দেশে মাথাপিছু বীমার প্রিমিয়াম আয় কমেছে ১ ডলার। ২০১৯ সালে দেশে মাথা পিছু প্রিমিয়াম আয় ছিল ৯ ডলার, যা ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮ ডলারে। ‘ওয়ার্ল্ড ইন্স্যুরেন্স: দি রিকভারি গেইনস পেস’ নামের সর্বশেষ সিগমা রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সুইস রি গত ১৪ জুলাই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
এদিকে দেশের বীমা খাতে প্রিমিয়াম আয় কমে যাওয়ার পেছনে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আমদানী-রফতানী কমে যাওয়া, থার্ড পার্টি মোটর বীমা বন্ধ করে দেয়া এবং লাইফ বীমার মাঠকর্মীদের অবাধ চলাফেরায় বিঘ্নতাকে দায়ি মনে করছেন দেশের বীমা বাজারের পর্যালোচকগণ।
অঞ্চল ও দেশ ভিত্তিক প্রিমিয়াম আয়, জিডিপিতে বীমার অবদান, বীমার ঘনত্ব, বীমা বাজারের প্রবণতা, সামষ্টিক অর্থনীতি সূচক ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাপী বীমা বাজারের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ইন্স্যুরেন্স: দি রিকভারি গেইনস পেস’ নামের প্রতিবেদনে। বিশ্বের ১৪৭টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করা হলেও প্রতিবেদনটিতে স্থান পেয়েছে ৮৮টি দেশ।
যেখানে প্রিমিয়াম আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৯তম। মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৪ শতাংশ কমলেও ২০২০ সালে র্যাংকিংয়ে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশে। এ বছর দেশের মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ১ হাজার ৩২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের ০.০২ শতাংশ। আগের বছরে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ১ হাজার ৩৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে বীমার পেনিট্রেশন বা জিডিপিতে বীমার অবদানে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এই র্যাংকিংয়ে দেশের অবস্থান এখন ৮৬তম, যা আগের বছরে ছিল ৮৫তম। দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের বর্তমান অবদান ০.৪০ শতাংশ। এর আগে ২০১৯ সালে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল ০.৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপিতে বীমার অবদান ০.০৯ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশে বর্তমান বীমার ডেনসিটি তথা মাথাপিছু বীমার ঘনত্বের পরিমাণ ৮ মার্কিন ডলার, যা আগের বছরে ছিল ৯ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু বীমার প্রিমিয়াম কমেছে ১ ডলার। ২০২০ সালে বীমা ব্যবসা কমলেও বিশ্ব বাজারে বীমার ডেনসিটি তথা মাথাপিছু বীমার ঘনত্বের র্যাংকিংয়ে আগের অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। যেখানে বাংলাদেশের র্যাংকিং ৮৭তম।
এ বিষয়ে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও কর্ণফুলি ইন্স্যুরেন্সের ভাইস-চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলত তিনটি কারণে গেলো বছর দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে ব্যবসা কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে ফায়ার ও মেরিন ইন্স্যুরেন্সের ট্যারিফ রেট হ্রাস পাওয়া; থার্ড পার্টি মোটর ইন্স্যুরেন্স বন্ধ করা এবং আমদানী-রপ্তানী কম হওয়া।
অন্যদিকে লাইফ বীমা ব্যবসা কমে যাওয়ার মূল কারণ- বীমাকর্মীদের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন। বাংলাদেশে এখনো গ্রুপ এবং অনলাইন বীমা ব্যবসা ব্যাপকভাবে চালু হয়নি। ফলে করোনাকালে কনভেনশনাল পদ্ধতির বীমা ব্যবসা বেশ খানিকটা হোঁচট খেয়েছে। তাছাড়া বীমা কোম্পানিগুলোকে এখন একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে। ফলে প্রিমিয়াম সংগ্রহ প্রাথমিকভাবে কিছুটা কমেছে। তবে চূড়ান্তভাবে এগিয়ে যাবে দেশের বীমা খাত, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনাল সোসাইটি (বিআইপিএস)’র সাধারণ সম্পাদক এ কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই এ বিষয়ে বলেন, থার্ড পার্টি মোটর ইন্স্যুরেন্স বন্ধ করায় এর ব্যাপক একটা প্রভাব পড়েছে দেশের নন-লাইফ বীমা ব্যবসায়। সব দেশেরই একটা বড় অংশ প্রিমিয়াম আসে এখান থেকে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে মেরিন ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম রেটও নিম্নমুখী। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নন-লাইফের বিজনেস ভলিউম কমতে পারে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে। এর কারণটা আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত।
প্রাইম ইসলামী লাইফের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কাজী মোরতুজা আলী বলেন, আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই দেশের জিডিপিতে বীমার অবদান কমছে। এর একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে কেন কমছে- এ ব্যাপারে একটি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আইডিআরএ বা বিআইএ’র মাধ্যমে সেটা হতে পারে। অথবা তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও এই তদন্ত করা যেতে পারে।
দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতিও যখন দ্রুত বড় হচ্ছে- তখন বীমা খাতের এই অবস্থা কেন হবে সেটা আমাদেরকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়ার কারণে বীমা প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে। কিন্তু পেছনে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো ভালোভাবে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কাজী মোরতুজা আলী।
এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্মসচিব) ও মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতার বলেন, সুইস রি যে তথ্য দিয়েছে সেটাকে আমি সঠিক মনে করি। কারণ, থার্ড পার্টি মোটর ইন্স্যুরেন্স বন্ধ করে দেয়ায় দেশের প্রিমিয়াম আয় অনেক কমে গেছে। অথচ সারাবিশ্বেই থার্ড পার্টি মোটর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলকভাবে চলে।
আবার করোনার কারণে আমদানী-রফতানীও কমেছে অনেক। যার প্রভাব পড়েছে দেশের নন-লাইফ বীমার প্রিমিয়াম আয়ে। তাছাড়া আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনো শক্তিশালী হতে পারিনি। দেশের অর্ধেক বীমা কোম্পানিই দুর্বল। গেলো বছর কারোনার কারণে লাইফ বীমা কর্মীরা তেমন কোন পলিসি বিক্রি করতে পারেনি। এ কারণেও খাতটির ব্যবসা কমে গেছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি ৮১টি বীমা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে লাইফ বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৩৫টি, যার মধ্যে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। অন্যদিকে দেশের নন-লাইফ বীমা কেম্পানির সংখ্যা সর্বমোট ৪৬টি, যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে একটি।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে গত ১৭ মে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের তথ্য অনুসারে আগের বছর দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে এ বছর মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬৩ মার্কিন ডলার বা ৯ শতাংশ।
মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা আগের বছরে ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ। যা আগের অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।